কক্সবাজারে তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ এ মাসেই

52

চলমান মাদক বিরোধী অভিযানের মধ্যে ‘চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত’ ইয়াবা চোরাকারবারিরা আত্মসমর্পণের জন্য কক্সবাজার শহরে জড়ো হচ্ছেন। এ মাসের শেষেই তাদের আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা সারা হতে পারে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার তিনি বলেন, ‘আমি তাদের (পুলিশ) বলেছি, এরা (ইয়াবা কারবারি) কারা, তাদের আইডেনটিটি যেন রেডি করে রাখে। আমরা ৩০ তারিখ, অথবা ফেব্রæয়ারির প্রথম সপ্তাহে যে কোনো একদিন যাব’।
গতবছর মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সন্দেহভাজন মাদক কারবারিদের হতাহতের খবর এসেছে। তবে মাদক কারবারিদের তৎপরতা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। এই অবস্থায় নতুন বছরের শুরুতে ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়। পরে কক্সবাজারের চিহ্নিত মাদক পাচারকারীদের একটি অংশ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের আগ্রহ জানালে বিষয়টি আকার পেতে শুরু করে।
এর মধ্যে টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এনামুল হক গত ১৫ জানুয়ারি ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণের কথা জানালে বিষয়টি আলোচনার জন্ম দেয়। তার মত শতাধিক ‘তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী’ ইতোমধ্যে কক্সবাজার শহরের কোনো এক স্থানে জড়ো হয়ে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ এসেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। খবর বিডিনিউজের
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন গতকাল বলেন, ‘বেশ কয়েকজন ইয়াবা ব্যবসায়ীর সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ হয়েছে। তারা নিজেরাই যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে আলোচনা চলছে বলে তাদের অবহিত করেছি’। তবে তিনি দাবি করেন, কক্সবাজারে জড়ো হওয়া ইয়াবা চোরাকারবারিদের পুলিশ হেফাজতে থাকার তথ্য ‘সঠিক নয়। তারা নিজেরাই যোগাযোগের মাধ্যমে সমন্বিত হয়েছেন বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। তারা কক্সবাজার শহরের একটি স্থানে জড়ো হয়ে নিজেদের উদ্যোগে হেফাজতে রয়েছেন’।
কি ধরনের শর্তে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘স্বাভাবিক জীবনে না এলে মামলা চলবে। আর স্বাভাবিক জীবনে গেলে এদের মামলা আমরা দেখব’।
ইয়াবা পাচার করে বিপুল অর্থের মালিক হওয়া ব্যক্তিরা আত্মসমর্পণ করলে তাদের অবৈধ সম্পদ বৈধতা পাবে কি না- সে প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর মন্ত্রী দেননি। তিনি বলেন, ‘সম্পদের বিষয়- এটা দুদক বা এনবিআর দেখবে’।
মিয়ানমার থেকে আসা নেশার বড়ি ইয়াবা মূলত কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা দিয়েই বাংলাদেশে ঢোকে। এই পথে অন্যান্য মাদকও আসে। জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি সর্বশেষ তালিকায় থাকা চিহ্নিত ইয়াবা পাচারকারীদের ১ হাজার ১৫১ জন কক্সবাজারের। তাদের মধ্যে ৭৩ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী’ হিসেবে। এই ‘শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের’ একটি বড় অংশের বসবাস টেকনাফ উপজেলায়। তাদের সবাই কম বেশি প্রভাবশালী, কেউ কেউ আবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও।
পুলিশ সুপার বলেন, গত বছর ২০ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মহেশখালীতে ৪৩ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের বিষয়টি সম্ভব হয়েছিল ‘চ্যানেল২৪’- এর সাংবাদিক আকরাম হোসাইনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হওয়ার পর। ওই জলদস্যুরা এখন কক্সবাজার কারাগারে বন্দি আছেন। মাসখানেক আগে তাদের খোঁজ-খবর নিতে কারাগারে গিয়েছিলেন সাংবাদিক আকরাম। তখন ইয়াবা মামলার কয়েকজন আসামির সঙ্গে আকরামের পরিচয় হয়। তাদের কাছেই আকরাম খবর পান, মাদক চোরাকারবারিদের একটি অংশ জলদস্যুদের মত আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়’।
আকরাম পরে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের জানান। এরপর পুলিশের মধ্যেও এ বিষয়ে তৎপরতা শুরু হয়। পুলিশ সুপার মাসুদ বলেন, ইয়াবা চোরাকারবারিদের কাছ থেকে আত্মসমর্পণের ‘প্রস্তাব’ পাওয়ার পর বিষয়টি তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানান। এখন নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা সারা হবে। প্রক্রিয়াটি দ্রæতই শুরু হবে বলে আমরা আশা করছি।
আত্মসমর্পণে সম্মত ইয়াবা চোরাকারবারিদের একটি অংশের কক্সবাজার শহরে জড়ো হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে চ্যানেল-২৪ এর সাংবাদিক আকরাম হোসাইন বলেন, ‘প্রশাসনের সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের প্রতিদিনই যোগাযোগ হচ্ছে। এই ব্যবসায়ীরা নিজেরাই নিরাপদ হেফাজতে আসার ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করেছেন। ইতোমধ্যে অনেকে নিরাপদ হেফাজতে এসেছেন’। তবে সেই সংখ্যা কত, আর তারা কাদের হেফাজতে রয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি সাংবাদিক আকরাম। তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে এ নিয়ে সঠিক কোনো তথ্য জানানো হয়নি। তবে নানা মাধ্যমে পাওয়া খবরে এ পর্যন্ত শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ীর আত্মসমর্পণে সম্মত হওয়ার এবং সংশ্লিষ্টদের কাছে নিরাপদ হেফাজতে আসার কথা জানতে পেরেছি’।
আত্মসমর্পণের ঘোষণা ফেসবুকে
টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এনামুল হক গত মঙ্গলবার ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণের কথা জানান। ফেসবুকে ওই পোস্টে ‘প্রিয় মাতৃভূমি টেকনাফবাসী’ সম্বোধন করে তিনি লেখেন, ‘আত্মসমর্পণের জন্য আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করছি’। এই যাত্রায় টেকনাফ থানা পুলিশ এবং একজন স্থানীয় সাংবাদিক সঙ্গে থাকার কথাও এনামুল ওই পোস্টে জানান।
এনামুল হকের বড় ভাই নুরুল হক জানান, টেকনাফের স্থানীয় এক সাংবাদিকের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের ব্যাপারে প্রশাসনের সঙ্গে এনামুলের যোগাযোগ ঘটে। আলাপ আলোচনার পর গত মঙ্গলবার বিকালে এনামুল আত্মসমর্পণের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।
পুলিশ ও সেই সাংবাদিকের সঙ্গে এনামুল কোথায় গেছেন জানতে চাইলে নুরুল হক বলেন, ‘বিভিন্ন মারফতে শুনে মনে হয়েছে কক্সবাজার শহরের পুলিশ লাইনস এলাকার কোথাও রাখা হয়েছে। সে পুলিশের নিরাপদ হেফাজতে আছে’। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযানের সময় অপরাধীদের তালিকায় এনামুলের নাম আসার কথা জানতে পেরে পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং তারাই এনামুলকে বুঝিয়ে আত্মসমর্পণে রাজি করিয়েছেন বলে জানান নুরুল হক।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, ‘টেকনাফের ইউপি সদস্য এনামুল হক একজন তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। ইয়াবা পাচারসহ নানা অভিযোগে টেকনাফ থানায় তার বিরুদ্ধে ১৫ টি মামলা রয়েছে’।
বদির হুঁশিয়ারি
গতবছরের শেষ দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা ইয়াবা কারবারিদের হালনাগাদ তালিকায় যে ৭৩ জনকে ‘শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তার শীর্ষে ছিলেন কক্সবাজার-৪ (টেকনাফ ও উখিয়া) আসনের তখনকার সাংসদ আবদুর রহমান বদি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই নেতার পাঁচ ভাই আবদুল শুক্কুর, আবদুল আমিন, মুজিবুর রহমান, মো. সফিক, মো. ফয়সাল, ভাগ্নে সাহেদুর রহমান নিপু, বেয়াই শাহেদ কামাল, ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান রাসেলের নামও ওই তালিকায় ছিল বলে সে সময় গণমাধ্যমে খবর আসে।
গতবছর মে মাসে সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে অর্ধ শতাধিক মাদক কারবারি নিহত হলেও ওই পরিবারের প্রায় সবাই বহাল তবিয়তে ছিলেন। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকেও বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিতর্কিত বদির বদলে তার স্ত্রী শাহীন আক্তারকে মনোনয়ন দিলে গত ৩০ ডিসেম্বর তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এরপর গত ১০ জানুয়ারি স্বামী এবং দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে এক মাদকবিরোধী মতবিনিময় সভায় বসেন তিনি। সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান বদি ওই সভায় ‘চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত’ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের জন্য ৫ দিন সময় বেঁধে দেন। ওই সময়ের মধ্যে কেউ আত্মসমর্পণ না করলে ‘ভয়াবহ পরিণতি’ হবে বলে তিনি হুঁশিয়ার করেন।
নিজে ইয়াবার কারবারে জড়িত থাকার কথা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন বদি। তবে এমপি থাকা অবস্থায় এতটা কঠোর অবস্থান নিতে কখনও দেখা যায়নি তাকে। মতবিনিময় সভায় সাবেক এই সাংসদ বলেন, ‘কোন যুক্তিতে আমাকে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে? আমি কি কোনোদিন ইয়াবাসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছি? আমার নামে কি কোনো থানায় একটিও মাদক মামলা আছে? সংসদ নির্বাচনে আমার সহধর্মিনী শাহীন আক্তার নতুন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। জড়িত না থাকার পরও আমার বিরুদ্ধে ইয়াবার দুর্নাম দীর্ঘদিনের। এ দুর্নামটি যাতে স্ত্রীর উপরও না বর্তায় প্রশাসনকে সহায়তা করতে চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের জন্য এ ঘোষণা দিয়েছি’। বদি সেদিন বলেন, ইতোমধ্যে অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারা আত্মসমর্পণে সম্মতি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে।
কক্সবাজারে নিহত ৫১
পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন জানান, গতবছর মাদক বিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে এবং নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে’ কক্সবাজারে ৫১ জন ‘ইয়াবা ব্যবসায়ী’ নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ২৭ জনই টেকনাফের বাসিন্দা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার পরও কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত কিছু রোহিঙ্গা মাদক পাচারে লিপ্ত থাকায় ইয়াবার চালান আসা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি বলে মন্তব্য করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘অভিযানে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। অধিকাংশই এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকায় তাদের পক্ষে ইয়াবার চালান আনা সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে, ইয়াবার চালান আনার জন্য মিয়ানমারের ব্যবসায়ীরা এদেশের ব্যবসায়ীদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করছে; কিন্তু আতংকিত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এ ব্যাপারে অনীহা জানিয়েছে। তবে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত কিছু রোহিঙ্গা পাচারকাজে জড়িত থাকায় খুচরা চালানের অনুপ্রবেশ ঘটছে’।
ইয়াবার চালানের অনুপ্রবেশ আগের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে বলে এসপি মাসুদের ধারণা। তিনি বলেন, কক্সবাজার সীমান্তে আগে প্রতি মাসে ২০ থেকে ৩০ লাখ ইয়াবা উদ্ধার হতো; অভিযানের কারণে এখন তা অনেক কমে গেছে। গত ডিসেম্বরে উদ্ধার করা ইয়াবার সংখ্যা ৭-৮ লাখের বেশি হবে না।