কক্সবাজারে কৃষি জমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়

49

কক্সবাজার সদর ও রামু উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় সরবরাহ করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। প্রতিবাদ করলেই প্রভাবশালীদের নিয়োজিত সন্ত্রাসীরা হামলা, মামলা ও প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে কৃষকদের। কখনো কখনো এস্কেভেটর দিয়ে রাতারাতি ফসলি জমির মাটি কেটে তারা পুকুর বানিয়ে ফেলছে। হতদরিদ্র কৃষক ও সবজি চাষিরা এর কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।
কোনো কোনো কৃষক এক ফুট থেকে দেড় ফুট গভীর পর্যন্ত জমির মাটি বিক্রি করলেও রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা ১০ ফুট থেকে ১৫ ফুট গভীর পর্যন্ত মাটি চুরি করে কেটে ইটভাটায় সরবরাহ করছে। সদর উপজেলা কৃষি স¤প্রসারণ অফিসের হিসাব অনুযায়ী সদর এবং রামুতে কয়েক বছর আগে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল চাষাবাদ করা হতো। আর বর্তমানে কৃষি জমির পরিমাণ ১২ হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে। কৃষি জমির মাটি গভীর করে কেটে নেয়ায় ফসলি জমি হারাচ্ছে কৃষক। বিপর্যয় ঘটছে পরিবেশের। আর ফসল উৎপাদন কমে যাওয়ায় কৃষকদের পরিবারে অভাব অনটন ও হতাশা দেখা দিয়েছে।
সদর ও রামুর দুই শতাধিক স্পট থেকে ফসলি জমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়। এতে শত শত বিঘা জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে। একই সঙ্গে উর্বরতা হারিয়ে অনাবাদি হয়ে পড়ছে আবাদি জমি। কমতে শুরু করেছে ফসলের উৎপাদন। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ইটভাটার মালিকরা কৃষকদের প্রলোভন দেখিয়ে দেদারসে মেশিন দিয়ে এসব ফসলি জমির মাটি কেটে নিচ্ছে। এরপরও স্থানীয় প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ঈদগাঁও, খরুলিয়া, দরগাহ, পাতলী, মোহসনিয়া পাড়া, ডিক পাড়া, ডেইঙ্গা পাড়া, শ্রীমুরা,চাকমারকুল, শাহমোদর পাড়া,ফুয়ার চর, কলঘর, তেচ্ছিপুল, রামুসহ দুই শতাধিক স্থানে মেশিনের মাধ্যমে ট্রাক এবং ট্রাক্টর দিয়ে ফসলি জমির মাটি বিভিন্ন ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জমির মালিকরা না বুঝেই তা ইটভাটার মালিকদের কাছে বিক্রি করছেন। এতে জমির উর্বরতা শক্তি কমতে শুরু করলেও এ বিষয়ে স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে কৃষকদের সতর্ক করা হচ্ছে না। এসব এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কলঘর বাজারের মাটি ব্যবসায়ী ফয়েজ এবং আলমগীর যৌথভাবে সেখানে চারটি মেশিন দিয়ে সবজি ক্ষেত ও বোরো চারা ধানের জমির মাটি প্রায় ১৫ থেকে ১৮ ফুট গভীর করে কেটে ইটভাটায় নিয়ে যাচ্ছেন। এতে পাশের জমির মালিক নাজিম উদ্দিন, লাল মিয়া, মুক্তারসহ ৬-৭ জন কৃষকের ফসলি জমি ভাঙনের মুখে পড়েছে। তারা স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনকে জানানোর পরও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন। এতে বাধা দিতে গেলে মাটি ব্যবসায়ীরা উল্টো বিভিন্ন হুমকি দেন।
এ ব্যাপারে মাটি ব্যবসায়ী ফয়েজ ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আমার মতো এখানে শত শত ব্যবসায়ী ফসলি জমির মাটি কেটে নিচ্ছেন, আগে তাদের বন্ধ করতে বলেন তারপরই আমি বন্ধ করব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রামুর এক ইটভাটা মালিক জানান, সদর এবং রামুতে এখন চলমান প্রায় ৫০টি ইটভাটা রয়েছে। আর এসব ভাটার ইট তৈরি করার জন্য সদর এবং রামুর বিভিন্ন এলাকার ফসলি জমির মাটিই সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে স্থানীয় প্রশাসনকে তারা ম্যানেজ করেই ফসলি জমির উপরি ভাগের মাটি কেটে নিচ্ছেন বলে তিনি জানান।
কলঘর এলাকার কৃষক আলী হোসেন জানান, বেশি টাকা পাওয়ার কারণে তার দুই বিঘা ফসলি জমির মাটি বিক্রি করে দিয়েছেন।
দরগা পাড়া গ্রামের সবজি চাষি জলিল মিয়া বলেন, সৌদি প্রবাসীর জমি চাষাবাদ করে তিনি সংসার চালাতেন। মাটি চোরদের কারণে তিনি এখন হতদরিদ্র দিনমজুর। এখন অভাব অনটনের মাঝে তার সংসার চলছে।
চাকমারকুল এলাকার কৃষক আবুল করিম বলেন, তিনি গত বছর হজ্ব করে দেশে ফিরে দেখেন তার কৃষি জমির মাটি দুর্বৃত্তরা কেটে নিয়ে পুকুর বানিয়ে ফেলছে। প্রতিবাদ করায় দুর্বৃত্তরা তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয় এবং এ ব্যাপারে থানায় কোনো অভিযোগ দিতে নিষেধ করে।
এগিকে কৃষিবিদরা বলেন, জমির মূল উর্বরতা শক্তি থাকে মাটির উপরিভাগে। আর এ মাটি (টপ সয়েল) কেটে নিলে তার উর্বরতা শক্তি সঞ্চয় করতে সময় লাগে ১০-১২ বছর। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০-১২ বছর পর কৃষি জমি অনাবাদি হয়ে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান জানান, সরকারি নিয়ম না মেনেই সদরে অনেক ইটভাটা তৈরি হয়েছে। আর এসব ভাটার জন্য মাটির প্রয়োজন। তাই উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের জমির টপ সয়েল তারা নিচ্ছে। আর এ টপ সয়েল নেওয়া বন্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। ইউএনও আরও বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।