ওআইসি ও মুসলিম বিশ্বেও সমস্যা : একটি পর্যালোচনা

158

সাম্প্রতিক এক টেলিভিশন ‘টকশোতে’ ঢাকার বিশিষ্ট সাংবাদিক রিয়াজুদ্দিন আহমদকে বলতে শুনলাম ‘ মুসলমানদেও আন্তর্জাতিক সংস্থা’ ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামি কো-অপারেশন) হলো একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠান, যারা কোনো সমাধান উদ্যোগ গ্রহণ করার পরিবর্তে বলতে থাকে ইংরেজিতে ও আইসি ‘অর্থাৎ আচ্ছা আমি দেখি। অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকই এই মন্তব্যের সাথে হয়তো সহমত করবেন।
উল্লেখযোগ্য যে ইসরাইল ১৯৬৯ সালে ২১ আগস্ট জেরুজালেমের ‘আল আকসা’ মসজিদে অগ্নিসংযোগ কওে এর ফলে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়ায় জের ধওে ওই বছরের ২২-২৩ সেপ্টেম্বও মরক্কোর রাবাতে ২৫টি মুসলিম দেশের সম্মেলনে ওআইসির জন্ম হয়। ১৯৭৪ সালে এই সংস্থার দ্বিতীয় সম্মেলনে ৩২তম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সদস্যপদ লাভ করে। বর্তমানে ৫৭টি দেশ এর সদস্য প্রতিষ্ঠাতাদের স্বপ্ন ছিল এই সংস্থা হবে মুসিলম বিশ্বেও সম্মিলিত কন্ঠস্বর। মুসলিম বিশ্বেও সদস্যগুলোর সমাধানে একটি বিশাল ভূমিকা রাখবে। কিন্তু অর্ধশতাব্দীকাল পেরিয়ে আসার পর বিশেষ কওে মধ্যপ্রাচ্যেও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি একে (ওআইসি) প্রশ্নের মুখেও দাঁড় করিয়েছে। সংস্থাটি ব্যর্থ হয়েছে বলে নানা মহলে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে বর্তমান বিশ্বেও হানাহানি, সংঘাত নিরসনে এই সংস্থা তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছেনা। সংস্থার নেতৃত্বেও মধ্যে নানা রকম মতপার্থক্যও দেখা যায়। বিশেষ কওে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যে সংঘাত দেখা যায় বা ছিল তা এখনও রয়ে গেছে। মুসলিম বিশ্ব বিশেষ কওে মধ্যপ্রাচ্যে যে সংঘাত বা মনকষাকষি চলছে তাতে আপাতদৃষ্টিতে মুসলমানদেও মধ্যে বিভাজন একটি আকার ধারণ করছে বলেও মনে হতে পারে। এই বিভাজন রোধ করতে ভূমিকা রাখতে পারছেনা ‘ওআইসি’। ওআইসির সামনে আত্মসমালোচনা করার এবং আত্ম উপলব্ধি সৃষ্টির সুযোগ এসেছে। এটা মুসলিম বিশ্বকে সুসংহত করতে পারে। মুসলিম বিশ্বেও নেতাদেও একথা বোঝার সময় এসেছে এবং পুনর্জাগরণের সময় এসে গেছে।
একসময় তুরস্ক বেশ নীরব ছিল। মালয়েশিয়ার মহাথির মোহাম্মদ আগের তুলনায় এখন বেশি সরব ও সোচ্চার। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেংগে যাওয়ার পর মধ্য এশিয়ায় বেশি কিছু মুসলিম রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, যেগুলো আগে ওআইসির সদস্য ছিলনা, সেগুলো এখন সদস্য হয়েছে। এগুলো ইতিবাচক লক্ষণ, যা উপেক্ষা করা ঠিক হবেনা। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট মুসলিম বিশ্বেও সামনে ঐক্যমত হওয়ার যে সুযোগ দৃষ্টি হয়েছে তা তাদেরকে কাজে লাগাতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাকের মধ্যে সংঘাতে যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা হলো সম্ভবত কোনো রাষ্ট্র এই প্রথম সরাসরি মার্কিনিদেও চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখাল । ইরাকে মার্কিন ঘাঁটির ওপর সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কম সাহসের কাজ নয়। ক্ষয়ক্ষতি কি হয়েছে সেটা বড় কথা নয়। এর প্রতীকী মূল্যও রয়েছে। পরাশক্তি আমেরিকানদেও ঘাঁটির ওপর কোনো দেশের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্ভবত এটাই প্রথম এবং তাও একটি মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। ইরানের এই কৌশলগত উপলব্ধি কিন্তু মুসলমানদেও শক্তিকেই প্রকাশ করেছে। ইরান যদি এই সাহস না দেখাত তা হলে হয়তো পরিস্থিতি আরো খারপ হতো। জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে তেহরান যদি পাল্টা হামলা করে তা হলে ইরানের অর্ধশতাধিক লক্ষবস্তুতে হামলা করা হবে বলে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষনা দিয়েও পওে সেই ঘোষণা থেকে পিছিয়ে গেছেন।
আসলে সংঘাত ও যুদ্ধেও বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ঐক্যমত্য রয়েছে। আমেরিকানদেও মধ্যেও রয়েছে যুদ্ধেও বিরুদ্ধে কংগ্রেস দাঁড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শত শত শহওে যুদ্ধেও বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। এর মানে হলো সাধারণ মানুষ বিশ্ব শান্তির প্রত্যাশী। পারমানবিক বোমা থাকলেই সবাই ভয় পাবে তা নয়। ঘটনা তার প্রমাণ। পারমানবিক বোমা মারলে শুধু অন্যে মরবে না, নিজেকেও মরতে হবে। বিশ্বে যত পারমানবিক অস্ত্র আছে তা দিয়ে ৩৮ বার পৃথিবীকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা যাবে। তা হলে কেন এসব অস্ত্রেও মজুদ করা হচ্ছে পারমানবিক বোমা দিয়ে তা আঞ্চলিক সংঘাত রিসন করা যাবেনা। আরেকজনকে মারতে গিয়ে কেউ নিজে মরতে চাইবে কী ? তাই ওআইসি একেবাওে কিছুই কাজ করেনি একথা বলা যাবেনা। ওআইসির কারণেই আজ গাম্বিয়ার মত দেশের রোহিঙ্গা ইস্যুতে এগিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। আফ্রিকার ছোট একটি দেশ তাদেও চেয়ে আয়তন ও শক্তিতে বড়ো মিয়ানমারকে আদালতে দাঁড় করিয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রায় দিতে পেয়েছে। চীন, ভারতের মতো মিয়ানমারের বন্ধু বড় বড় শক্তিগুলো গাম্বিয়াকে থামাতে পারেনি। সমস্যা হলো আমরা সব সময় নেতিবাচক দিকগুলোকে বড় কওে দেখানোর চেষ্টা করি। সফলতাগুলো তেমন আলোচায় আসে না। আগামী এপ্রিলে পাকিস্তানে ওআইসির যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সেখানে এই সংস্থাকে আরো শক্তিশালী করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে নেতারা। তারা মুসলিম বিশ্বেও জন্য আগামী ২৬/৩০ বছরের এজেন্ডা নির্ধারণ করতে পারেন। কারণ সামনের এই শতাব্দী হবে মুসলমানদের।
পিউ রিসার্সেও মতে সংস্থা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে চলতি শতকের ষাটের দশক থেকে মুসলমানরা হবে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠী, যার লক্ষণ এরই মধ্যে প্রতিবাত হয়েছে হয়ে উঠেছে। আজ প্রতিবেশী ভারতের কিন্দুত্ববাদী সরকার যখন মুসলিমদেও একঘওে করার চেষ্টা করছে তখন সেখানকার অমুসলিমরাও মুসলমানদেও পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। এটা অবশ্যই মানবতার জয়। মানুষ্যতের জয়। এখানেই মনে হয় ওআইসির একটি ভূমিকা রয়েছে। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই এই সংস্থার জন্ম হয়েছিল।
এই মুহূর্তে ওআইসির সবচেয়ে বেশিজোর দেয়া উচিত মৌলিক গবেষণার ওপর। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে শিক্ষা বিস্তারের ওপর নজর দিতে হবে। এখন যা কিছু হচ্ছে তা ভারত সবকিছুই জ্ঞানভিত্তিক। জ্ঞানভিত্তিক। জ্ঞানের ওপর জোর দেয়ার কারণেই ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে ইরান অনেক দূও এগোতে পেরেছে। তাই তাদের পক্ষ থেকে নিখুঁতভাবে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালানো সম্ভব হয়েছে। এটা এক দিনে হয়নি। মিসরের শাসব্যবস্থা নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকলেও জামাল আবদুল নাসের সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা ওপর জোর দিয়েছিলেন। মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি দেশে কৌশলগত শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল তৈরী করতে হবে। ওআইসিকে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় ভাষায় বড় বড় মনীষীর লেখাগুলো অনুবাদেও ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে ভর্তুকিও দেওয়া যেতে পারে। অস্ত্র কেনার পেছনে মুসলিম বিশ্ব আজ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। ২০১৮ সালে সৌদি আরব তার জিডিপির ৮.৮ শতাংশ ব্যয় করেছে এই খাতে। মধ্যপ্রাচ্যেও তেলসমৃদ্ধ প্রায় প্রতিটি দেশের একই অবস্থা অথচ এসব দেশ গবেষণা খাতে জিডিপির ভগ্নাংশও ব্যয় করে না। সমস্যা হলো গবেষণা খাতে কেউ খরচ করতে চায়না। কারণ এতে ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে দেখা যায়না। একটি বড় কোন অবকাঠামো প্রকল্প করে অত্যাধুনিক জঙ্গিবিমান বা মিসাইল কিনে বাহবা পাওয়া সহক। মুসলিম বিশ্বে উদ্ভাবন, আবিষ্কার নেই বললে চলে। সায়েন্টিফিক জার্নালে লেখার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। মুসলিম বিশ্বে পাঁচ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে অথচ এ দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নিজস্ব উদ্ভাবিত পণ্য আছে কয়টি? অথচ বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রায় ৭০ শতাংশের অধিকারী মুসলিম দেশগুলো। এজন্যই গবেষণার ওপর জোর দেওয়া উচিৎ। একসময় মধ্যপ্রাচ্যের একচেটিয়া সম্পদ ছিল তেল। এখন জ্বালানির নানা বিকল্প আবিষ্কার হচ্ছে। ফাঁকা বুলি হলেও ট্রাম্প এখন বলার সাহস পাচ্ছে যে মধ্যপ্রাচ্যের তেল তার দরকার নেই। মোট কথা মুসলিম দেশগুলোকে পণ্য তৈরিতে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। অর্থনীতিতে বৈচিত্র আনতে হবে। মুসলিম দেশগুলোর অর্থনীতির মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। পাকিস্তানের আসন্ন সম্মেলন থেকে ভারতকে এ ব্যাপারে বার্তা দেয়া যেতে পারে।
মনেহয় রাষ্ট্রগুলোকে উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে আগামী দেশগুলোতে মুসলিম বিশ্বেও বিশাল প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদ অপেক্ষাকৃত সুলভ ও তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী উন্নয়নের জোয়াওে শামিল হবে। মানবতা ও বিশ্বশান্তির এ উন্নয়নের এ জোয়ারের ওআইসি বলিষ্ট অবদান রাখতে পারে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহারের জন্য এখনই প্রস্তুতি শুরু করা দরকাল। এর জন্য ব্যাপক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, কারণ সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট