ঐশীপ্রেমিক মির্জা গালিব

308

ঐশীপ্রেমিক কবি মির্জা গালিব আমাদের সাহিত্য, সুফিবাদ ও খোদাপ্রেমের ভক্তির অন্যতম প্রেরণাদায়ক মহাপুরুষ। জগদ্বিখ্যাত এই দার্শনিক ভারতীয় উপমহাদেশের গÐি পেরিয়ে সমগ্র পৃথিবীতে তাঁর অনুসরণীয় সুফিবাদ চর্চার কারণে বিখ্যাত। তাঁর নাম মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ, ডাক নাম গালিব। গালিব অর্থ সর্বোচ্চ। পূর্বের ডাক নাম আসাদ। আসাদ অর্থ সিংহ। জন্ম ১৭৯৭। মৃত্যু ১৮৬৯। ভারতবর্ষে মোঘল-সাম্রাজ্যের শেষ ও ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকের একজন উর্দু এবং ফার্সি ভাষার বিখ্যাত কবি ও গজলকার। সাহিত্যে তাঁর অনন্য অবদানের জন্য তাঁকে ‘দাবির-উল-মালিক’ ও ‘নাজিম-উদ-দৌলা’ উপাধি দেওয়া হয়। তাঁর সময়কালে ভরতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য তার ঔজ্জ্বল্য হারায় এবং শেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহীবিদ্রোহ এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা পুরোপুরিভাবে মোঘলদের ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসন দখল করে। তিনি তাঁর লেখায় এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। মহাবিদ্রোহের সময়কার তাঁর লেখা সেই দিনলিপির নাম দাস্তাম্বু। তিনি জীবনকালে বেশকিছু গজল রচনা করেছিলেন যা পরবর্তীতে বিভিন্ন জন বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্নভাবে বর্ননা করেছেন ও গেয়েছেন। পৃথিবীর বিখ্যাত সংগীতশিল্পী ও গজলশিল্পী খ্যাত জগজিৎ সিং মির্জা গালিবের লেখা গজলগুলো গেয়ে আলোচিত হয়েছেন এবং আলোকিত করেছেন। সারা পৃথিবীত তিনি গালিবের গজল গেয়ে নিজে পরিচিত হয়েছেন এবং গালিবকে পরিচিত করেছেন। প্রজন্মের কাছে গালিবচর্চায় এগিয়ে এনেছেন। সংগীত পিপাসুদের কাছে গালিবকে পরিচিত করেছেন। তাঁর গজলগুলো ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সংগীতসাধক ও গজলশিল্পী জগজৎ সিং এর বেস্ট অব মির্জা গালিব গজল’স বাই জগজৎ সিং (ভলিউম-১ ও ভলিউম-২) নামে সমগ্র পৃথিবীতে হিন্দি, উর্দু, ফারসি ও কিছু কিছু গজল বাংলায়ও পরিবেশিত হয়। সুফিবাদের মাধ্যমে ঐশীপ্রেম এবং স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার অনুপম নিদর্শন এই সংগীতগুলো। মির্জা গালিবের সংগীত সাধনা ইবাদতের ন্যায়। তিনি পরম স্রষ্টাকে পাওয়ার আশায় তাঁর সাহিত্য ও লেখালেখি। পরম স্রষ্টার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে সংগীতের মাধ্যমে। মির্জা গালিব ও তাঁর সংগীত সাধনা আজও পৃথিবীবাসীর কাছে এক নতুন থেকে নতুনত্ব। মির্জা গালিবকে মোঘল সাম্রাজ্যের সর্বশেষ কবি হিসেবে ও দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁকে উর্দু ভাষার সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি বলে মনে করা হতো। আজ শুধু ভারত বা পাকিস্তান নয় সারা বিশ্বেই গালিবের জনপ্রিয়তা রয়েছে ও তাঁকে নিয়ে চর্চা হয়। আমার সৌভাগ্য যে, আমার এই মহান কবির দিল্লিস্থ সমাধি শরীফ জিয়ারত করার সৌভাগ্য হয়। গত ১৫ আগস্ট সুফি হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া, সুফি ও সংগীতসাধক হজরত আমির খসরু (রা.) ও উর্দু ভাষার বিখ্যাত কবি দার্শনিক মির্জা মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ গালিব (রহ.) এর সমাধি জিয়ারত করার সৌভাগ্য অর্জন করি। এ সময় সহযাত্রী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেডের পরিচালক লায়ন আলহাজ্ব হাকিম আলী, জিএম কামাল উদ্দিন, ডিজিএম মোহাম্মদ আবদুর রহিমসহ আরও ভ্রমণ সহযাত্রীরা। আমরা বাংলাদেশ থেকে যাঁরা পর্যট গিয়েছি তাঁদের সাথে আরও বিভিন্ন দেশের পর্যটক সমাধিস্থলে পরিদর্শনে দেখা যায়। একই সাথে গজলের মাহফিলে বসে মাতোয়ারা হতেও দেখা যায়। সংগীতের এই মাহফিলে আগত পর্যটকরা নিজের মতো করে উপভোগ করছে। আমার বেশ ভালো লাগছিল। রাত্রে সাড়ে দশটার দিকে আমাদের গ্রæপের আসার সময় হলে আমাকেও চলে আসতে হয় তাঁদের সাথে। মির্জা আসাদুল্লাহ গালিব এর মাজার শরীফটি ছোটখাটো, খুব সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন। শ্বেতপাথরে বাঁধাই করা। সমাধির গায়ে এপিটাফে লেখা ফারসির বাংলা অনুবাদÑ
‘কিছুই যখন ছিল না তো খোদা ছিল / কোনো কিছু না হলেও তো খোদা হতো,
হয়ে যাওয়াই ডুবিয়ে দিল বন্ধু আমায় / নাই-বা যদি হতাম কী আর ক্ষতি হতো?’
মির্জা গালিব উপরিউক্ত বর্ণিত দর্শনটিই প্রচার করেছেন মানবীয় প্রেমের আবরণে জড়িয়ে। আর তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর গজলের প্রিয়া কেবল একটি প্রতীক (ঝণগইঙখ) মাত্র, যাকে তিনি ব্যবহার করেছেন সার্বিক প্রেমতত্ত¡কে বর্ণনার প্রয়োজনে। শরীর থেকে অশরীরী প্রেম, সৃষ্টি থেকে স্রষ্টার প্রতি তীব্র আকাক্সক্ষা, এই বিষয়টিই বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, গালিবের এত সব জটিল দর্শনের মাঝেও তাঁর কবিতার মানবীয় আবেদন ক্ষুণœ হয় না। আপামর জনসাধারণ নিছক মানবীয় প্রেম হিসেবেও তাঁর গজলের উক্তিগুলোকে ধরে নিতে পারেন। ২০১৯ সালের ১৭ মহররম তাঁর প্রয়াণদিবসে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাচ্ছি। আসুন আমরা সকলে মিলে গালিবের খোদাপ্রেম ও সুফিবাদের প্রতি প্রদর্শিত পথগুলো অনুসরণ করে মানুষের কল্যাণ ও স্রষ্টার প্রতি যথাযথ মর্যাদা ও নিজেদেরকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি।