ঐতিহ্যের শেকড় বাঁচাবে কে?

121

মূল সড়কের অদূরেই অবস্থিত বাঁশখালীর কালিপুর ইউনিয়নের রুদ্রপাড়া। ইটের পথ টুকুন শেষে মেঠোপথ ধরে এগোলেই সহসা দেখা মিলবে জনপদটির। যেখানে বাস করেন রুদ্ররা। স্থানীয়ভাবে তারা কুমোর নামে বেশি পরিচিত। এক সময় এ পাড়ায় আশপাশের সবক’টি এলাকার মাটির তৈরি তৈজসপত্র তৈরি হত। সময়টা যদি এখন না হয়ে কয়েকযুগ আগে হত, তাহলে হয়ত প্রত্যক্ষ করা যেত রুদ্রপাড়ায় মৃৎশিল্পীদের ব্যস্ততা কেমন ছিল। মৃৎশিল্পীদের হাতের আঁচড়ে তৈরি তৈজসপত্রের চাহিদা কেমন ছিল। লোকেমুখে শোনা অতীত আর বর্তমান চিত্র দেখে এমনই কল্পিত চিত্র বারবার মাথায় আসছিল। প্লাস্টিকের দাপটে বিলুপ্তপ্রায় রুদ্রপাড়ার মৃৎশিল্প। প্রশ্ন উঠছে, ঐতিহ্যের শেকড় আঁকড়ে থাকা রুদ্রদের বাঁচাবে কে ?
এক সময় পার্শ্ববর্তী উপজেলা সাতকানিয়া ও চকরিয়া থেকে কুমোররা বাড়ি-ভিটা বিক্রি করে এসে রুদ্র পাড়ায় বসতি গড়ত। কারণ এ পাড়ায় বাস করার মর্যদাই ছিল আলাদা। তাছাড়া দৈনন্দিন জীবনে নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্র ক্রয় করতে ক্রেতার হিড়িক পড়ত পাড়াটিতে। এখানে তৈরি মাটির জিনিসপত্র নৌকাযোগে চলে যেত গ্রাম ছাড়িয়ে শহর থেকে শহরান্তে। বাজারে ছিল বেশ চাহিদা, ব্যস্ততা ছিল রুদ্রপাড়ায় আর পরিবেশ ছিল বিশুদ্ধ। কিন্তু পরিবেশ দূষণকারী প্লাস্টিকের তৈজসপত্রের বাজার দখলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে রুদ্রপাড়ার কুমোরদের মৃৎশিল্প। তাইতো রুদ্রপাড়ায় এখন আর ব্যস্ততা নেই। পেশা ছেড়ে অনেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, আবার কেউবা শহরে কায়িক শ্রমের পেশা বেছে নিয়েছেন। তারপরও দু-একজন এখনো শেকড় আঁকড়ে ধরে আছেন। তেমনই একজন ৪৫ বছর বয়সী রুদ্রপাড়ার হরিভক্ত রুদ্র। তিনি বলেন, প্লাস্টিক নিয়ে গবেষণা হয়, কিন্তু আমাদের নিয়ে কোনো বিনোয়োগ নেই। এখানে অনেকে আসেন আমাদের ছবি তোলেন, ভিডিও করেন কিন্তু আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হয় না। দরকার আমাদের নিয়ে গবেষণা করার। তাহলে হয়ত আধুনিক পদ্ধতিতে মাটি থেকে তৈরি হবে তৈজসপত্র আর পরিবেশ থাকবে দূষণমুক্ত।
হরিভক্তের বাড়ির উঠোনটায় বেশ কয়েক সারি মাটির পাতিল সাজানো রয়েছে। গাছে আবৃত পুকুরটির পাড়ে সিগারেটে মৃদু টান দিতে দিতে অলস দুপুরটি পার করছিলেন তিনি। অনুরোধে রাজি হন কিভাবে মাটি থেকে তৈজসপত্র তৈরি হয় তা দেখাতে। বাড়ির বারান্দায় রয়েছে সব আয়োজন। বারান্দার একপাশে বেলে-এঁটেল মাটির মিশ্রণে তৈরি করা আছে ‘মন্থন’। পানি আর মাটির মিশ্রণ কয়েকদিন ধরে মিশিয়ে এ মন্থন তৈরি করা হয়। একহাতে সিগারেট আর আরেকহাতে মন্থন নিয়ে বসে পড়লেন বারান্দার কোণায়। যেখানে মাটির গর্তে একটি চাকা বসানো। সে চাকা চালিয়ে নিলেন হাতের জাদুতেই। তারপর হালকা পানির ছিটায় ভিজিয়ে নিলেন হাতে থাকা মন্থন। তারপরই শুরু হলো হরিভক্তের হাতের জাদুর খেল। চাকা ঘুরছে আর হাতের কারিশমায় পাতিল, কলসি তৈরি করে দেখালেন। সদ্য তৈরি কাঁচা পাতিলগুলোর নির্দিষ্ট আকার আর কারুকার্য করার দায়িত্ব বাড়ির মেয়েদের। তারপর সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হয়।
কাজের ফাঁকে হরিভক্ত বলছিলেন, আমাদের মূল বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলায়। জায়গা-জমি বিক্রি করে আমার দাদা এখানে একটি ভিটা কিনেছিলেন। তারপর থেকে আমাদের এ পাড়ায় বসবাস শুরু হয়। এখানে প্রায় ২শ পরিবারের ১ হাজার মানুষ দিনরাত মাটির জিনিসপত্র তৈরি করত। সেগুলো বিক্রি করতে কখনো বাইরে যেত হত না। সওদাগররা এখান থেকে সাম্পানযোগে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যেত। যখন সিলভারের জিনিসপত্র বাজারে আসে তখনো আমাদের পেশায় আঘাত আসেনি। যখন প্লাস্টিকের পণ্য সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে তখন থেকে আমাদের দুর্দিন শুরু হয়। এমনকি এ পাড়ায় এখন মাত্র তিন-চার পরিবার নামমাত্র কাজ করছে।
আগের মত ব্যস্ততা নেই। তবে হরিভক্তকে লোকজন নিয়ে যান বিভিন্ন মেলায় বা প্রদর্শনীতে। যেখানে তিনি কিভাবে মাটি থেকে তৈজসপত্র তৈরি হয় তা দেখান। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় থেকে অর্ডার আসে। সে অর্ডার অনুসারে জিনিস তৈরি করে দেন। বন্ধু চুলার ঢাকনা আর ছোট পাতিল ছাড়া নিয়মিত তেমন কিছু তৈরি হয় না বলে জানান হরিভক্ত। লাকড়ির দাম বেড়ে যাওয়া খরচ পোষাতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয় তাদের। শুধু কালীপুরের রুদ্রপাড়া নয় বাণীগ্রাম, সাধনপুর, উত্তর চাম্বল, দক্ষিণ চাম্বল এলাকায় মৃৎশিল্পের তৈরি দৃষ্টি নন্দন মাটির সামগ্রী কলসি, হাঁড়ি, পাতিল, সরা, মটকা, দৈ পাতিল, মুচি ঘট, মুচি বাতি, মিষ্টির পাতিল, রসের হাঁড়ি, ফুলের টব, জলকান্দা, মাটির ব্যাংক, ঘটি, বাটি, জালের চাকা, প্রতিমা, বাসন-কোসন, ব্যবহারিক জিনিসপত্র ও খেলনা সামগ্রী তৈরি হত। কিন্তু এখন সব যেন অতীত হয়ে যাচ্ছে, বিলুপ্তপ্রায় বাঁশখালীর ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।