এ সুন্দর পৃথিবীর বাংলাদেশে সীমিত সময়ের জন্য আমরা বেড়াতে এসেছি হানাহানি করতে নয়

109

এ সুন্দর পৃথিবীর বাংলাদেশ নামের সুন্দর দেশটিতে আমরা সীমিত সময়ের জন্য ‘বেড়াতে এসেছি ; হানাহানি করতে নয়, কবি বলেছেন ‘মরিতে চাহিনা আমি এ সুন্দর ভুবনে’ কিন্তু তা হবার নয়। আমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না ফেরার দেশে চলে যেতেই হবে। কথাটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যদি এটাই না হতো, তবে পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে এত গোলযোগ হানাহানি, রক্তারক্তি ও খুন খারাবি কেন ? দেশ ও সমাজ এমন ‘সাত সতীনের সংসার’ হয়ে উঠছে কেন ? আমরা সমাজে ও রাষ্ট্রে নিয়ম কানুন ও শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, রক্ষা ও মান্য করে চলতে ব্যর্থ হচ্ছি কী কারণে ? অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতির প্রতি এত আকর্ষণ কেন ? দিন দিন এটা বাড়ছে কেন ? এক সময় আমাদের দেশ ও সমাজ এত উত্তপ্ত ও বিশৃঙ্খলা ছিল না।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির শিথিলতা সব যুগেই ছিল। তবে এখন যতটা দেখা যাচ্ছে তেমন নৈরাজ্যকর অবস্থা আগে ছিল না। বর্তমানে মাদক সেবন করে বাবা-মাকে সন্তান খুন করছে কিংবা রাস্তায় বন্ধুকে বন্ধু প্রকাশ্যে কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে মারছে। প্রতিনিয়ত মানুষ গুম হচ্ছে, অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে। মানুষকে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে। যথেচ্ছ ব্যভিচার চলছে- গুলো কি এতটা ব্যাপক হারে কোনো কালে আমাদের দেশে ছিল ? নিশ্চয়ই নয়, আমার ভাবতে অবাক লাগে সমাজপতিরা, মনোবিজ্ঞানিরা, শিক্ষাবিদরা এসম্বন্ধে একপ্রকার নীরব ভ‚মিকা পালন করছে। সবকিছু যেন তাদের সবার গা-সয়হা হয়ে গেছে। আরো বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছেÑ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী শত চেষ্টা করেও এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বরং শোনা যায় এসব বাহিনীর কোনো কোনো বিপথগামী সদস্য এসবে জড়িয়ে যাচ্ছে। এসবই ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হওয়ার মত কার্যকলাপ। এ জন্য আমরা কাকে দোষ দিব ? দেশের মানুষকে না যথাযথ কর্তৃপক্ষকে। যারা দেশ পরিচালনা করে শুধু তাদের কথাই বলবো। বাবা-মা, সমাজপতি বা এ ধরনের যারা সমাজে আছেন ; তাদের কি কোনো দায় নেই ? নিশ্চয়ই আছে। দেশে যে প্রতিহিংসার ও অসহিষ্ণুতার রাজনীতি চলছে এর দায় নিতে হবে সব রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে। কারণ রাজনৈতিক অঙ্গনে এসব হানাহানি, বিশৃঙ্খলা ও খুনখারাবি বেশি। দেশের সব দলের রাজনীতিকদের ভাষা, বক্তব্য ও কার্যকলাপ এসব করার জন্য সবাইকে উসকে দিচ্ছে। যখন একটি রাষ্ট্র জাতীয় ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়, তখন অনিয়মের ঢল বাধভাঙ্গা জোয়ারের মতো ছুটে আসে। কারণ, জাতীয় দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা-সমঝোতার সুযোগ তখন আর থাকে না। আমাদের দেশেও তার বড়ই অভাব। ছোট্ট একটি দেশ এটা। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা বিশাল, আয়-রোজগারের সুযোগ-সুবিধা সীমিত। বিশাল, আয়-রোজগারের সুযোগ-সুবিধা সীমিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সিট নিয়ে ২০ থেকে ৩০ জন কাড়াকাড়ি করে। হলের সিট নিয়েও একই দশা ৪/৫ সরকারি বা বেসরকারি চাকুরির জন্য ২ থেকে ৩ হাজার দরখাস্ত পরে। প্রায় সময় বিশেষ রাজনৈতিক আনুগত্যের বিবেচনায় হলে স্থান পাওয়া নির্ভর করে। শিক্ষা ব্যবস্থা আজ প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম। আগেই বলেছি এক, দুটি পদের জন্য প্রতিযোগিতা করে বেশুমার চাকরি প্রার্থী। সুবিধাবঞ্চিত বেকার ও উপার্জনহীন লোকে দেশ ছেয়ে গেছে। কাকে রেখে কাকে সুযোগ দেয়া যায় ? এর ওপর আছে আগুনে ঘি ঢালার মতো নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব। তাই কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চায়না। নিয়ম মানতে চায় না। না পাওয়ার বোধ তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। শুরু হয় আইন অমান্য আন্দোলন, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, খুন-খারাবি। এসব দমনে এগিয়ে আসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, শুরু হয় বিক্ষোভকারী ও বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ, উভয় পক্ষে হতাহত হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধান সহজে হয় না।
চাপা আক্রোশে ফুসতে থাকে বঞ্চিতরা, কেউ বা হতাশায়, তাদের সামনে কোনো আদর্শ নেই, ভবিষ্যৎ নেই। হতাশাগ্রস্থর শরণাপন্ন হয় মাদকের কিংবা এর চেয়েও মারাত্মক অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। সমাজে অস্বস্থির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। দেশের কর্ণধার রাজনীতি ফেরা সেদিকে নজর দেন কমই। তা না হলে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ও শ্রমিকদের দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করেও বেঁচে থাকার মতো ন্যায্য বেতন বা মজুরির দাবিতে রাস্তায় নামতে হয় কেন ? কেন পুলিশের গুলি খেতে হয়, টিয়ার গ্যাস, জল কামান সহ্য করতে হয়। পুলিশকেই বা কেন তাদের হাতে নাস্তানাবুদ হতে হয় ? এর উত্তর কারা দিবেন।
ভুললে চলবে না, এ দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ লোক গ্রামে বাস করে। তাদের বেশির ভাগই মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তাদের ছেলেমেয়েরা যখন শহরে প্রবেশ করে, তারা শহরের জাঁকজমক দেখে অবাক হয়ে যায়। শহরের এই গাড়ির বহর, সুরম্য অট্টালিকা তাদের নয়Ñ এটা তারা অনুভব করে বা তাদের অনুভব করতে দেয়া হয়। আসলে পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের দৈত্য বা ভূত আমাদের এই ছোট্ট এবং দরিদ্র দেশটিতে জেকে বসেছে। বাংলাদেশে বিত্তবান ছোট, অথচ প্রবল ক্ষমতাধর একটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এদের বিচরণ অবাধ ও অবারিত, শ্রম-ঘামে সিক্ত খেটে খাওয়া মানুষের উৎপন্ন দ্রব্যাদি ও সাধারণ জনগণের সেবা ঔপনিবেশিক শক্তির মতো তারাই ভোগ করছে। ওদের একমাত্র লক্ষ্য ক্ষেত্র ভেদে মুনাফা লুট আর দুর্নীতি করা। কৃষক-শ্রমিককে তারা মানুষ বা তাদের কেউ মনে করে না। এই শ্রেণিটি প্রতিদিন যে ডলার গোনে তা যে এ দেশেরই রক্ত-ঘাম ঝরানো শ্রমিকের ও সাধারণ মানুষের সন্তানদের শ্রমেরই ফসল। তা তারা উপলব্ধি করে না। তারা কেবলই হিসাব দেখায়Ñ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০-৪০ বিলিয়ন ডলার। একবার ও বলে না, এটা কাদের অর্জন ও উপার্জন। কাদের শ্রমের বিনিময়ে এ প্রাপ্তি ? তারা ভোগ করে কিন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। আজ আর শ্রমিক ও সাধারণ জনগণ অন্ধ বা অসচেতন নয়। তাদের চোখ কিছুটা হলেও ফুটেছে। স্বাভাবিক কারণেই তারা বঞ্চনার প্রতিবাদ করে। কোনো সময় আন্দোলন করে। ঔপনিবেশিক আমলে আমরা জাতিগতভাবে অন্যায়, অবিচার, শোষণ-বঞ্চনা, নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদ করেছি। যেসব রাজনীতিক আজো রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন। তারা কি দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য অতীতে আন্দোলন করেননি ? তা না হলে দেশটা স্বাধীন হলো কিভাবে ? প্রতিনিয়তই সরকার রেডিও-টেলিভিশনে নতুন প্রজন্মকে সেসব কাহিনী শোনাচ্ছে ? তারা আমাদেরই উত্তরসূরি। প্রতিবাদী বীরের রক্ত এদের ধমনীতে প্রবাহিত। আমরা এদের দোষ দিব কিভাবে ? আমাদের দেশ আজ শুধু শ্রেণিবিভক্তই নয়, প্রায় সবক্ষেত্রেই বিভক্ত। এর কুফল আমরা ভোগ করছি। সামাজিক শান্তির জন্যে এ ভুল আমাদের শোধরাতেই হবে। যারা অভিভাবক তাদের একটি বড় দোষ হলো তারা সবুর করতে বা সংযত হতে নিজেরা যেমন পারেন না, তেমনি উত্তরসূরিদেরও তা শেখান না। ন্যায়-অন্যায়দের মতো ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো সমাজ থেকে আমরা বিদায় করে দিয়েছি। মানবপ্রেম ও মানবতাবোধ এখন নির্বাসিত। কিন্তু সব মানবিকতার যে ধর্ম, তা মধ্যযুগীয় বা মৌলবাদ বলে পাশ্চাত্যের অনুকরণে উপেক্ষিত হচ্ছে। অথচ এককালে ধর্মই ছিল প্রাচ্যের সমাজে মানববন্ধনের মূলমন্ত্র। বর্তমানকালে আমরা দেখছি, দেশে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা আছে, কিন্তু এর আমল নেই বা কিছু থাকলেও তা খুবই কম। এর ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
পাশ্চাত্যে বস্তুবাদী সভ্যতার অস্থিরতা এবং মানুষের প্রতি মানুষের অবহেলার রোগটি আমাদের পেয়ে বসেছে। পাশ্চাত্যের মতো আমাদের সমাজের মানুষও একে অন্যের অনাত্মীয় হয়ে সবাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। পাশ্চাত্য সমাজের মতো আমাদের সমাজের মানুষ কেবলই বস্তু আহরণের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। এই প্রক্রিয়ায় জনগণ একে অন্যের ঘোষিত বা অঘোষিত শত্রæতে পরিণত হচ্ছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার অনেকগুলোর পাশে এটিই দোষ। সমাজে নিখাদ ধর্মচর্চা নেই বলে ধর্ম আজ আর আকাক্সিক্ষত দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। পাশ্চাত্য ধর্মকে ভয় পেতে শিখিয়েছে, প্রকৃত ধার্মিকদের মৌলবাদী, জিহাদি ও জঙ্গিবাদী বলে ভয় পেতে শিখিয়েছে।
আমাদের এ উচ্ছৃঙ্খল জীবনধারাকে সামাল দিবে ? রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা কি সম্ভব হবে মনে হয় না। এটা আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। অস্ত্র ব্যবসায়ী পাশ্চাত্য দেশ এবং তাদের অনুগত বিশ্ব ব্যাংক বা আইএমএফের পরামর্শ নয়, প্রাচ্যদেশীয় বিশুদ্ধ ধর্মাচারই আমাদের সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারে। আজ নেতাদের স্মরণ করতে হবে। ‘তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ করো না, যারা আল্লাহর অনুগ্রহের বদলে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং নিজেদের জাতিকে ধ্বংসের স্তরে নামিয়ে এনেছে’ ? (সূরা ইব্রাহিম ১৪, আয়াত ২৮)। দেশে ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের পÐিতরা আমাদের যা-ই শেখাতে চান না কেন, আমাদের অনুধাবন ও অনুসরণ করতে হবে। রাসূল (সা.) এর অমিয় বাণী, ‘আল্লাহর শান্তির অর্থ- তার ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পিত করা। মানুষের শান্তির অর্থ- এমন জীবন-যাপন করা, যা কোনো মানুষের শক্তি বিনষ্ট হওয়ার কারণ না হয়’ (বুখারী ২/৩)। এই পথ অনুসরণ করে ইসলামের সুবর্ণ যুগে মুসলমানেরা রোমান ও পারস্য সমাজের ঘোষ অমানবিকতা দূর করতে পেরেছিল, সেই পথ অনুসরণ করে এ যুগে আমরাও সমাজের কালিমা দূর করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
আমরা লেখার শেষ প্রান্তে চলে আসার আগে আমাদের পূর্বদেশের সম্মানিত সম্পাদক জনাব মুজিবুর রহমানকে অভিনন্দন জানাতে চাই। পোশাকশিল্প রপ্তানিখাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য দেশের খ্যাতনামা শিল্প পরিবার স্মার্ট গ্রæপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে আবারও ‘বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ (সিআইপি) নির্বাচিত করেছে সরকার। এ নিয়ে সপ্তমবারের মতো সিআইপি মর্যাদা পেলেন জনাব মুজিবুর রহমান। তাঁর জন্য আমরা গর্বিত এবং তাঁকে আবারও এই কৃতিত্বের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আজকের লেখাটি এখানেই শেষ করছি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট