এলো খুশির ঈদ

16

আবু তালেব বেলাল

ফুটফুটে চেহারার শুভ, পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। বাবার হাত ধরে ছুটছে ট্রেন ধরার জন্য। যাবে কুমিল্লায়। চোখেমুখে আনন্দের ছাপ। হাওয়ায় উড়ছে মন। দাদুর বাড়ি বলে কথা। হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিল শুভ’র সাথে, সে বলছিল, ‘আব্বু-আম্মুর সাথে দাদুর বাড়িতে যাচ্ছি, দাদুর সাথে ঈদ করব। জানেন, গতবছর এবং আগের বছরও দাদুর বাড়িতে যেতে পারিনি। আব্বুটা নেনটি। ঐ যে করোনা রোগ! আব্বুতো বের হতেই দেননি। বাসায় টেলিভিশন আর মোবাইলে গেম খেলে খেলে ঈদ করেছি। এবার অনেক মজা হবে।’
এভাবে হাজারো শুভ’র জীবনে ঈদ বা উৎসবের আনন্দ ম্লান হয়ে গিয়েছিল করোনার তান্ডবে। আজ কারোনা নামক মহামারি নেই, নেই কোন স্বাস্থ্য সতর্কতা। মুক্ত হাওয়ায় চলছে মানুষ, ছুটছে মানুষ নাড়ির টানে। গ্রামের সবুজ প্রান্তরে। যে মাটিতে তার জন্ম, যে কাঁদামাটি গায়ে মেখে তার দূরন্তপনা, সেই মাটির গন্ধ শুকতে মানুষ ব্যাকুল। দুটি বছর করোনা মহামারির তান্ডবে স্থবির জীবনের কপাট যখন খুললই, তখনই মায়ের আঁচলে একটু শান্তির নিঃশ্বাস। চারিদিকে আনন্দের জয়গান। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই চিরায়ত ঈদের গানখানা- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে/ এল খুশির ঈদ,/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে/ শোন আসমানী তাগিদ’।
আজ আকাশে চাঁদ উঠলে কাল হবে ঈদ। আর চাঁদ উঠলেই ঘরের ছাদে, পুকুর পাড়ে স্বচ্ছ জলে চোখ দুখানা ভিজিয়ে কিংবা আকাশের পানে হাত উচিয়ে ‘ঐ যে চাঁদ উঠেছে’- এমন হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠবে দূরন্ত কিশোর-কিশোরী, ছোট-বড়, বৃদ্ধা-বনিতা সবাই।
দুই বছর করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে এবারের ঈদ সম্পূর্ণ আনন্দময় পরিবেশে উদ্যাপিত হবে। পুরো রমজানজুড়ে চলেছে ঈদের আমেজ। গত দুইবছর যেখানে ঈদ শপিং কল্পনা করা যায়নি, এবার দুহাত খুলে ঈদ শপিং করছে মানুষ।
ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের সকল মার্কেট, দোকানপাট, শপিংমল, ফুটপাত থেকে শুরু করে গাঁওগেরামেও সরগরম ঈদবাজার। তবে গত দুই বছরে মানুষের আর্থিক সংকট বেড়েছে। আর বাজারে সকল পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিতে উচ্ছ¡াস-আনেন্দর মধ্যে হোঁচট খেতে হয়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষকে।
রমজানের শুরু থেকে ইফতার ও সাহরি সামগ্রির দাম এবং ঈদ মার্কেটে পোশাক-পরিচ্ছেদ থেকে শুরু করে প্রসাধন সামগ্রিতে অগ্নিমূল্যের প্রভাব ছিল লক্ষ্য করার মত। সবমিলিয়ে যাপিত জীবনের নানা বাঁকে নানা ঘাগ-প্রতিঘাত অতিক্রম করে এবার মুক্তমনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল মুসলিম আজ বা কাল অথবা পরশু ঈদ উদ্যাপন করবে।
চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় ঈদের প্রধান জামাত বরাবরের মতোই হবে নগরীর দামপাড়াস্থ জমিয়তুল ফালাহ্ মসজিদে। সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ঈদ জামাত সরকারের শর্ত মেনে মসজিদের ভেতরেই হবে। প্রথম জামাত হবে সকাল সাড়ে আটটায়। দ্বিতীয় জামাত হবে ৮টা ৪৫ মিনিটে।
কেন্দ্রীয় ঈদ জামাত কমিটি যথারীতি স্টেডিয়ামে আয়োজন করবে ঈদের নামাজ। দ্বিতীয় বৃহত্তর জামাত হবে নগরীর আন্দকিল্লা শাহী জামে মসজিদে। এছাড়া নগরীর উন্মুক্ত ময়দানসহ নির্ধারিত জায়গায় ঈদ জামাত আয়োজনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম. রেজাউল করিম চৌধুরী অনুরোধ জানিয়েছেন।
এদিকে পবিত্র ঈদ-উল ফিতর উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এক শুভেচ্ছা বার্তায় রাষ্ট্রপতি দেশ-জাতি ও বিশ্ব মানবতার সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি কামনা করেন।
অন্যদিকে দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল এক ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘প্রিয় দেশবাসী আসসালামু আলাইকুম। আপনাকে এবং আপনার পরিবারের সকলকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। এক মাস সিয়াম সাধনার পর আবার এসেছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতর মানে আনন্দ। আসুন, ঈদুল ফিতরের আনন্দ সবাই ভাগাভাগি করে নিই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে যার অবস্থান থেকে ঈদুল ফিতরের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করি। সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন। ঈদ মোবারক।’

এছাড়া দৈনিক পূর্বদেশসহ দেশের সব প্রিন্ট মিডিয়া এ উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ এবং সব ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে।
ঈদের সর্বজনীনতার মধ্যে যে নির্মল খুশীর আবেদন, তা এবার প্রস্ফুটিত হবে, অন্ধকার ঘুছিয়ে একদিন আলো আসবে- এ বিশ্বাস সবার মধ্যে ছিল, সেই আলোতেই সবাই এবার ঈদ উৎসব পালন করবে।
দেশবাসী ঠিক আগের মতই ঈদের আনন্দে মাতবেন। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর প্রতিটি জাতির জীবনেই উৎসব রয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের আনন্দ উৎসব পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠী-ধর্মের উৎসবের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। ইসলাম প্রবর্তিত আনন্দ-উৎসব ইহকালীন ও পরকালীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলমানদের ঈদ নিছক উৎসবই নয় বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও বটে। এটিই ইসলামের সৌন্দর্য।
মুসলমানদের ঈদের ইহকালীন তাৎপর্য হলো, রমজান শেষে সাদাকাতুল ফিতর দিয়ে অসহায়-গরীবদের আর্থিক সহায়তার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। অস্বচ্ছল পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে বা কর্মহীনদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে দুু’টি ঈদ যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। সঙ্গতকারণে এবার এ বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা আরো অধিক। ঈদের পরকালীন তাৎপর্য হলো- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রমজান মাসকে বিভিন্ন ধরনের নিয়ামতে ভরপুর করেছেন। এ মাসেই মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজিল হয়। দিনে রোজা রাখার এবং রাত্রিকালীন ইবাদতের মধ্যে অনেক ফযীলতের কথা বিবৃত হয়েছে। লাইলাতুল কদর নামক হাজার রাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ একটি মহিমান্বিত রাত দান করা হয়েছে এ মাসে। পাপ মোচনের এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ এসে যায় রমজান মাসে। এ সমস্ত নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ আনন্দ উৎসবের ব্যবস্থা। কাজেই ঈদ নিছক আনন্দ উৎসব নয়, এটি একটি ফযীলতপূর্ণ ইবাদত এবং সে কারণেই ঈদের রাতে এবং ঈদের দিনের অনেক ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে হাদিস শরীফে।
এদিকে পবিত্র ঈদ-উল ফিতর উপলক্ষে চট্টগ্রাম নগরবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।
গণমাধ্যমে প্রেরিত শুভেচ্ছা বার্তায় তিনি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর শান্তি, স¤প্রীতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে বলেন, পবিত্র ঈদ উল ফিতর বিশ্ব মুসলিম জাহানের জন্য মহাখুশীর একটি দিন। পবিত্র আল কোরআন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। যে পবিত্র মাসে ধরাধামে নাজিল হয়েছিল পবিত্র কোরআন। রহমত, ক্ষমা ও মুক্তির মাস রমজানের কঠোর সিয়াম-সাধনা শেষে ঈদের দিনে মুমিনগণ মেতে ওঠেন পবিত্রতায় পরিপূর্ণ আনন্দময় সম্মিলনে। ধনী, গরীব, শত্রু, মিত্র, ছেলে, বুড়ো নির্বিশেষে ঈদগাহে গিয়ে কাতারবদ্ধ হয়ে নামাজ আদায় ও পারস্পরিক কোলাকুলিতে ভূলে যান সকল ভেদাভেদ।
তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ তত্বাবধানে সফলতার সাথে করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে এখন আমরা সফল হয়েছি। দুই বছর পর ঈদে মহামিলনের সুযোগ পেয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ঈদ মোবারক। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমার প্রাণের চট্টগ্রাম মহানগরের সকলকেও জানাই ঈদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। একই সাথে তিনি ঈদের দিনটির সাথে বিশ্বের সকল শ্রমিকদের মহান মে দিবসের শুভেচ্ছা জানান।
এছাড়া পবিত্র ঈদ-উল ফিতর উপলক্ষে নগরবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ, সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, মহানগর বিএনপির আহব্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন। পৃথক শুভেচ্ছা বার্তায় তারা দেশবাসীর শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন।