এডভোকেট জালাল আহমেদ (১৯১৬-২০১০)

73

জন্ম: লেলাঙ্গারা গ্রাম, রাউজান, চট্টগ্রাম, ১৯১৬। তিনি এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান। তবে তিনি রাউজানের যে এলাকায় জন্মলাভ করেন তা বছরের প্রায় সময় জলমগ্ন, কর্দমাক্ত ছিল। চলাচলের রাস্তাও আলো বিদ্যুৎ বিহীন। সেখানে ছিলনা কোন লেখাপড়ার উপযুক্ত পরিবেশ ও একটি পরি”ছন্ন ও সাদামন সমৃদ্ধ জনসমাজ।
প্রাথমিক শিক্ষা পারিবারিক পরিমন্ডলে সম্পন্ন হয় তাঁর। অল্প বয়সে তিনি তাঁর পিতা মৌলভী খলিলুর রহমানকে হারান এবং দাদা ও জেঠা মশাইয়ের স্নেহে তিনি পালিত হন এবং তাঁর মেধা ও ধী-শক্তির পরিচয় পেয়ে তাঁর ওই গুর“জনদ্বয় লেখা-পড়ায় সর্বোতভাবে সহায়তা করেন। তাঁরা তাঁকে রাউজান উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া চালিয়ে নেয়ার সহায়তার অংশ হিসেবে নিজ খরচে হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। ওই বিদ্যালয়ে সর্বশেষ পরীক্ষায় সাফল্য অর্জনের পর ১৯৩৮ সালে ফেনি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪১ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। তাঁর দাদা তাঁকে এতই ভালোবাসতেন যে, নিজের জমি বিক্রি করে কোলকাতায় এলএলবি পড়ার জন্য প্রেরণ করেন।
তিনি অবশ্য ব্রিটিশ মিলিটারি একাউন্স বিভাগে কেরানির চাকরি করেন। কিš‘ ওই সময় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাঁধে কোলকাতায়। তিনি তখন জীবন নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে ১৯৪৯ সালে ঢাকা থেকে এলএলবি পাস ও এডভোকেটশীপ সার্টিফিকেট নিয়ে ১৯৫০ সাল থেকে নিয়মিত ওকালতি আরম্ভ করেন রাউজান আদালতে। রাউজান আদালতের নিকটবর্তী উকিল শ্যামাচরণ মহাশয়ের ভিটে বাড়ি ক্রয় করে তথায় পুরোদমে ওকালতি করতে থাকেন তিনি এবং পর্যায়ক্রমে একজন বিশিষ্ট উকিল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
তিনি একজন নিরহংকার ও বিনয়ী ব্যক্তি হিসেবে সকলের নিকট থেকে শ্রদ্ধা পেতেন এবং তিনি নিজেও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি তাঁর থেকে অধিক জ্ঞানী লোক হতে পেশাগত সহায়তা নিতে লজ্জাবোধ করতেন না। এ কারণে তিনি আবুল কাশেম সাবজর্জ, স্বর্গীয় নলিনী রঞ্জিত ও চট্টগ্রামের সিনিয়র উকিলদের নিকট থেকে আইন শিক্ষা ও পরামর্শ নিতে কোন প্রকার কুন্ঠাবোধ করতেন না।
আশ্চর্য হওয়ার মতো শিক্ষানুরাগের প্রতি তাঁর অতিশয় শ্রদ্ধাবোধ ছিল। তিনি ৭৫ বছর বয়সে গহিরা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ তোফায়েল আহমদ সহ উভয়ে বৃদ্ধ বয়সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ক্লাসে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা যথারীতি নিষ্ঠার সাথে চালাতে থাকেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তোফায়েল সাহেব হঠাৎ ইন্তেকাল করেন এবং এরপর পড়ালেখার সাথী একজন বন্ধুর মৃত্যুতে তিনিও অসু¯’ হয়ে পড়েন। এ-কারণে আর লেখাপড়া এগিয়ে নেয়া ও পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি। বাড়ি এলে লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে করে মাঠে গিয়ে জমিতে হাল চালাতে পছন্দ করতেন। শীতকালে শিকার করতে ও কেরাম বোর্ড খেলা খেলতে ভালোবাসতেন। এছাড়াও সমাজ সেবায়ও তাঁর আগ্রহ ছিল। তিনি মসজিদ পরিচালনা ও ধর্মীয় কাজে অতিশয় উৎসাহী ছিলেন। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত তিনি আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসির অধিনে নিজবাড়ি ইউনিয়নে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন নিষ্ঠা ও সততার সহিত।
তিনি রাউজান কলেজ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এটার জায়গা অধিগ্রহণ, অর্থ সংগ্রহসহ বিভিন্ন দায়িত্ব নিষ্ঠার সহিত পালন করেন। অন্যান্য অনেকের সহিত তিনি তাঁর যোগ্যতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা যথাযথভাবে প্রয়োগ না করলে হয়তো কোনদিন এ শিক্ষায়তন আলোর মুখ দেখতো না।
তিনি একজন পরিপূর্ণ ভদ্রলোক এবং খোদা ভিরু মানুষ ছিলেন। ১৯৮১ ও ১৯৯৭ সালে দু’বার হজ্বব্রত পালন এরপর আদালতের দায়িত্ব থেকে বিরত হন বটে কিন্তু চেম্বারে প্র্যাকটিস করতেন।
ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল, সকাল ৭ টায় এ আলোর পথের অভিসারী সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি এডভোকেট জালাল আহমেদ-এর জীবন প্রদীপ নিভে যায়। পরদিন পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

তথ্যসূত্র : ১. জামাল উদ্দিন আহমেদ এফ সি এ, পিতা-এডভোকেট জালাল আহমেদ, রাউজান, চট্টগ্রাম প্রদত্ত তথ্যের আলোকে।