এঘর ওঘর মাকে খুঁজে চলছে ৪ বছরের মাওয়া

100

‘কাল সকালে আমায় বাড়ি নিয়ে যাস। বাসায় পৌঁছেই ফোন করিস, আমি টেনশনে থাকবো। বাবার সাথে শেষ কথা ছিল এটাই। বাড়ি নিয়ে যেতে বাবার আবদার ঠিকই পূরণ হয়েছে, তবে সেটা নিথর-রক্তাক্ত দেহে’- কথা বন্ধ হয়ে আসে পিয়াল দত্তের। তিনি বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ডের শিকার আনসার ভিডিপির প্লাটুন কমান্ডার মিহির কান্তি দত্তের বড় সন্তান।
পিয়াল স্নাতক পরীক্ষা দিয়েছেন। অপেক্ষায় আছেন ফলাফলের। বাবার সাথে অন্তপ্রাণ ছিলেন। মিহির নিজেই তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সাজেকের নির্বাচনী ডিউটিতে। ছিলেন একসাথে কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। ফটোগ্রাফিতে ছেলের হাত ভালো দেখে ভোট শেষ হওয়ার মাত্র ১০ মিনিট আগে ছবি তুলে দেওয়ার বায়না ধরেছিলেন মিহির। বলেছিলেন, ‘দেখিস অস্ত্রের নিচের অংশে ‘তুলা ৫৬’ লেখাটা যেন বাদ না পড়ে’। কিন্তু সেই ছবিটাই যে শেষ ছবি হয়ে ওঠবে তা জানা ছিলোনা পিয়ালের।
বলেন, ‘আর কোনোদিন ছবি তুলতে পারব না বাবার, সারা জীবন এই আফসোস নিয়েই কাটাতে হবে। আমার বাপি আর কোনোদিন ছবি তুলে দেয়ার আবদার করবেনা’- গলা ধরে আসে পিয়ালের। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা তার মা সেবু দত্ত (৪০) ততোক্ষণে কান্না শুরু করে দিয়েছেন। ডিউটি শেষ করে উপজেলা সদরে ফেরার পথে বাঘাইহাটে জীপ গাড়ি থেকে নেমে ব্যক্তিগত মোটরসাইকেলে বাসায় ফেরেন বলে বেঁচে যান পিয়াল।
মিহির কান্তি দত্ত বাঘাইছড়ির বঙ্গলতলী ইউনিয়নের করেঙ্গাতলী বাজারের বাসিন্দা। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী সেবু দত্ত আর দুই ছেলে পিয়াল ও অভিষেক দত্তকে নিয়েই ছিল তার সংসার। গতকাল (শনিবার) দুপুরে রাঙামাটি শহরে কথা হয় বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ডে নিহত ৪ আনসার ভিডিপি সদস্যের স্বজনদের সাথে। সেদিনের ঘটনা আর হারানো স্বজনদের ফেলে যাওয়া স্মৃতি হাতড়ে ফিরছেন তারা। তার কিছুটা জানিয়েছেন এই প্রতিবেদককে।
স্বজন হারানো স্বল্প আয়ের এই মানুষগুলোর বিয়োগান্ত এ আখ্যান বয়ে নিয়ে চলবেন সারাজীবন। ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাওয়ার সাথে সেনাক্যাম্প স্থাপন ও পরিবারগুলোর দায়িত্ব নিতেও সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তারা।
মাকে খুঁজে ফিরছে ছোট্ট মাওয়া :
পশ্চিম লাইল্যাঘোনা এলাকার বাসিন্দা বিলকিস আক্তার আনসার ভিডিপির ইউনিয়ন দলনেত্রী। বছর চারেক আগে স্বামী মারা গেছেন। দুই কন্যা সন্তান নিয়েই চলছিল তার পরিপাটি সংসার। বড় মেয়ে জান্নাতুল নুর (১৭) এবার এসএসপি পরীক্ষা দিয়েছেন। অপেক্ষায় আছেন ফলাফলের। ছোট মেয়ে জান্নাতুল মাওয়ার বয়স ৪ বছর। এখন তাদের ঠাঁই হয়েছে নানুর বাসায়। ছোট বোনের আগামি দিনগুলো নিয়ে ভাবনায় পড়েছেন জান্নাত। বলেন, ‘আমার মা সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের হামলায় মারা গেছে। এখন আমাদের সংসার কিভাবে চলবে জানি না। সরকার কোনো ব্যবস্থা করে দিলে বোনকে নিয়ে ভালোভাবে চলতে পারবো’। জান্নাত জানান, মাওয়া এ ঘর ও ঘরে শুধু মাকে খুঁজে চলছে। নানান সান্ত¡না দিয়েও মাঝে মাঝে তার জেদ থামানো যায় না। আমার ছোট বোনটাকে দেখে রাখতে বলেছিল মা। কিন্তু এর মানে যে এটা হবে বুঝতে পারিনি’। বলেন, ‘মাওয়াকে নানুর কাছে রেখে মা সাজেকে আর আমি চট্টগ্রামে আত্মীয়ের বিয়েতে যেতে একসাথেই ঘর থেকে বের হয়েছিলাম। ঘটনার দিন আমি চট্টগ্রামেই ছিলাম। সহ্য করতে পারবোনা ভেবে আমার স্বজনেরা আমাকে খবরটি জানায়নি। মায়ের মৃত্যুর পরদিন রাত সাড়ে ৯ টায় মায়ের ফোনে কল দিয়ে জানতে পারি মায়ের মৃত্যুর খবর।
ভয়ের কথা জানিয়েছিলেন জাহানারা :
কাচালং বাজারের দিনমজুর তসলিম আহম্মদ (৫৫) নিহত জাহানারা বেগমের স্বামী। দিন মজুরি করে সংসার চলে। তাই সন্তানদের পড়াশোনা এগোয়নি। তবে স্ত্রী সংসারের হাল ধরায় ছোট ছেলে মোশারফ (১৫) পড়ছে নবম শ্রেণিতে। বড় ছেলে রুবেল (২৩), আর দুই মেয়ে তাসলিমা (১৯) ও রোজিনা আক্তারের (১৭) বিয়ে দেওয়ার শখ পূরণ হলো না জাহানারার। সন্তানের লেখাপড়া ও চাকরির দায়িত্ব নিতে সরকারের কাছে মিনতি জানান জাহানারার স্বামী দিনমজুর তসলিম।
তিনি বলেন, আগের দিন রাত ১০ টার দিকে ফোনে সর্বশেষ কথা বলেছিলাম জাহানারার সাথে। সে বলেছিল, ‘আমাদের ভয় লাগতেছে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি নাই। শুধু পুলিশ আর আমরা ভিডিপির সদস্যরা আছি’। সকাল নয়টায় আবারো কথা হলে জাহানারা বলে, এখানে ভোট হচ্ছে না; আমরা বসে আছি। এটাই ছিল শেষ কথা। ভয়ের কথাটাই এখনো তসলিমের কানে বাজছে।

তিনি বলেন, ‘তারপর দুপুর থেকে তার (জাহানারার) ফোন বন্ধ পাই। বাঘাইহাটে গোলাগুলি হয়েছে, আহতদের হাসপাতালে আনা হচ্ছে শুনেই সেখানে গিয়ে শুনি আমার স্ত্রী মারা গেছে। মাথা ও কোমর ভেদ করে গুলি বেরিয়ে গেছে। রক্ত আর রক্ত। পাহাড়িরা যদি আন্দোলন করে সরকারের সাথে করুক। সাধারণ মানুষের তো কোনো কিছু করার নাই। তাদের মারলো কেন? আক্ষেপ করেন তসলিম।
সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া হলো না আল-আমিনের :
কাচালং বাজারের দিনমজুর মো. সেলিম উদ্দিন (৪০) বলেন, আমার স্ত্রী ও ছেলে আল-আমিন ভিডিপিতে চাকুরি নিয়ে সংসারের হাল ধরেছিল। কমার্স থেকে এবার এসএসসি দিয়েছে সে। ছেলে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবে- এই আশায় অনেক কষ্ট করে পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি। ছোট ছেলে রুহুল আমিন নবম শ্রেণিতে আর মেয়ে সেলিনা আক্তার ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ছে। এখন সে নাই। তার জায়গায় আমার ছোট ছেলেকে যেন সেনাবাহিনীতে চাকুরির সুযোগ দেন সরকার।
সেলিম উদ্দিন জানান, সেনাবাহিনীতে চাকুরি করার খুব শখ ছিল আল-আমিনের। তার দিনমানের গল্পেও অযাচিতভাবে সেনাবাহিনী প্রসঙ্গ চলে আসতো। নিজেকে প্রস্তুত করতে নিজে নিজেই নানান কসরত করতো। মায়ের কাছে আবদার করেছিল যেন আনসার ভিডিপি প্রশিক্ষণে তাকেও পাঠানো হয়। বলেছিল সাজেকে ডিউটিতে (নির্বাচনী) গেলে আমার একটা অভিজ্ঞতা হবে। উৎসাহ দেখে নিজের মোবাইলটাই তাকে দিয়েছিলাম যোগাযোগ রাখার জন্য। হাসপাতালে গিয়ে দেখি পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক দিয়ে এফোর ওফোর করে একটি গুলি বেরিয়ে গেছে। সে জীপের ছাদে ছিলো।
আল-আমিনের শেষ কথার প্রসঙ্গ ধরে সেলিম বলেন, ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার ছোট বোন সেলিনা বায়না ধরেছিলো ‘ভাইয়া আমি তোমার সাথে যাবো’। হেসে আল-আমিন বলেছে, ‘বোন তুমি যাইয়ো না। আমি সাজেক যাচ্ছি, তুমি ওই দোকানে যা আছে খাও। ভাইয়া এসে পয়সা দিবো। আরেক বার তোমাকে নিয়ে যাবো’। ভাই না ফেরা দেশে, তবুও সেলিনা আছে তার ভাইয়ের প্রতীক্ষায়।
মিহিরের অস্ত্র উদ্ধার :
হত্যাকান্ডের চারদিন পর গত শুক্রবার সকালে নিহত আনসারের প্লাটুন কমান্ডার মিহির কান্তি দত্তের খোয়া যাওয়া ৩০৩ রাইফেলটি পাওয়া গেছে। বাঘাইছড়ি উপজেলা আনসার কর্মকর্তা আবুল বাশার জানান, শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে সড়কের পাশ থেকে খোয়া যাওয়া রাইফেলটি উদ্ধার হয়।
এদিকে শুক্রবার দুপুরে হত্যাকান্ডে ঘটনাস্থল বাঘাইছড়ি পরিদর্শন করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ ও নিরীক্ষা) আল মাহমুদ ফাইজুল কবির। তিনি স্থানীয় প্রশাসন ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রত্যক্ষদর্শী ও বাঘাইছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন আহতদের সঙ্গে কথা বলেন।
নিহতদের স্বজনদের অর্থ সহায়তা :
এদিকে বাঘাইছড়িতে হত্যাকান্ডে নিহত ৪ আনসার-ভিডিপির স্বজনদের ১ লাখ টাকা করে অর্থ অনুদান দেয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই আরো ৪ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। গত শুক্রবার দুপুরে রাঙামাটি জেলা কমান্ড অফিসে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপ-মহা পরিচালক মো. সামছুল আলম এ অর্থ প্রদান করেন। একই সাথে তিনি নিহতদের পরিবারের সদস্যদের যোগ্যতা অনুসারে চাকুরি ও পড়াশোনা করার দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা দেন। এসময় জেলা কমান্ডার আব্দুল আওয়ালসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।