‘এখানে ভাড়ায় মানুষ পাওয়া যায়’

215

এবারের বইমেলায় (২০১৯) প্রকাশিত কথাসাহিত্যিক মুহাম্মদ মহিউদ্দিনের বই ‘এখানে ভাড়ায় মানুষ পাওয়া যায়’ প্রচলিত জীবনের বাস্তব চিত্র। বইটিতে ২০টি গল্প স্থান পেয়েছে। প্রথম গল্প নেকলেস। গল্পের শিরোনাম দেখে ফরাশি লেখক মোপাসার লেখা গল্প ‘দি নেকলেস’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। এখানে গল্পকার বাংলাদেশের পটভ‚মিতেই গল্পটি লিখেছেন। ভালোবাসার চেয়ে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন বড়। এটাই তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন। পরের গল্প ‘বিজ্ঞাপন প্রতিনিধি’ বিজ্ঞাপন থাকতেই হবে সংবাদপত্রে আর বিজ্ঞাপনের জন্য প্রতিনিধি চাই। তেমন একজন প্রতিনিধির উত্থান-পতনের গল্পই লিখেছেন গল্পকার। ‘পরদেশি’ গল্পে রোহিঙ্গারা স্বজন ও দেশ হারিয়ে উঠে বসেছে নৌকায়। তাদের যাত্রা অনিশ্চিত। মানুষ মানুষকে কত কষ্ট দিতে পারে তারই নজির মর্মান্তিকভাবে লক্ষিত হয়। একই নৌকায় চলে জন্ম মৃত্যুর খেলা। আবার নামে একদিকে ক্ষুধা, তৃষ্ণা অন্যদিকে মানসম্ভ্রমের ভয়। ‘মায়ের কাছে ফেরা’-গল্পে আশ্রমগুলোতে সেবার নামে যে কষ্ট দেয়া হয় তারই পরিচয় বিধৃত। ‘আফগান হাউন্ড’ বিদেশি কুকুরের মৃতদেহ নিয়ে এক রহস্যঘন কাহিনি। ‘মেরুদন্ডহীন’ প্রধান শিক্ষক পরিমল কান্তিকে জনপ্রতিনিধি খবির উদ্দিন আহমেদ মিথ্যে ঘটনা সাজিয়ে শাস্তি দিলেন। কিন্তু আল্লাহ তার বিচার করলেন। বজ্রপাতে তার মৃত্যু ঘটালেন। বিধাতা সব কিছুর বিচারক মহিউদ্দিন তাই দেখাতে চেয়েছেন। ‘বাবা’ গল্পে হাতেম আলী এই বাবা। আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন। ছেলে বউয়ের কথায় ঘর ছেড়ে ছিলেন। দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে ভিক্ষে বৃত্তি বেছে নেন। ঘটনাক্রমে আবার তার দেখা হয় ছেলে ও ছেলে বউয়ের সাথে। আর যখনই বুঝতে পারেন তারই আত্মজ তখনই ফিরে আসেন। মিথ্যে স্নেহে তিনি আপ্লুত হননি। গল্পকার চিত্রিত করেছেন এক চমৎকার বাবা। ‘শিকড়’ খুব মর্মস্পর্শী গল্প। পুলিশ কমিশনার জাহিদ মাহমুদ সাহেবের বাসায় চলে আসে নাটকীয়ভাবে। গল্পের শেষে বোঝা যায় মাহমুদ সাহেবের প্রথম প্রেম মমতা ও তার অবৈধ সন্তান এই জাহিদ। সে এসেছিল যাচাই করতে মাহমুদ সাহেব সত্যি তার বাবা কিনা। এর পরের গল্প ‘মেয়েটির কোনো দোষ ছিলো না’ একাত্তরের ঘাতক দালালের নিষ্ঠুর ঘৃণিত চরিত্র মৌলানা সোবহান খান। যার থেকে তার নিষ্পাপ মেয়ে মারিয়া রেহাই পায়নি। শত বছর ধরে এটি জিইয়ে থাকবে। ‘সিঁদুর রেখা’ গল্পে দীপিকা আর সুমিতের প্রেম থাকলেও সামাজিক বিয়ে হয়নি। তবে সুমিত সিঁদুর পরিয়েছিল দীপিকাকে। পরে সামাজিক বিয়ে হয় অমলেশের সাথে। সে ছিল শারীরিকভাবে অক্ষম। সুমিতের জন্য
পরদীপিকার প্রেম জিইয়ে থাকে আত্মার ভেতরে। অমলেশের পিতৃত্বের অক্ষমতা পূরণ করে দেয় সুমিত। ‘মায়া’ গল্পে মিলি কর কমিশন অফিসে নিম্নমান সহকারি হিসেবে চাকরি করে। রওনক মিলিকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। তার ইচ্ছে চরিতার্থ করে। অবৈধ জীবনকে বৈধ করার লক্ষে ওদের বিয়ে দেয় সমাজ কিন্তু মেনে নিতে পারে না মিলি। আত্মহত্যা করতে চায় মিলি মেয়েসহ কিন্তু পারে না। ‘খন্ডিত’ গল্পে সমাজের কঠিন বাস্তবতা উঠে এসেছে গল্পকার মহিউদ্দিনের কলমে। ভেঙে গেছে ছয়টি বিয়ে সাবরিনার সত্য উক্তিতে। সপ্তমটি দিয়ে গল্পের সমাপ্তি। এর মধ্যে গল্পকার নিপুণভাবে শেক্সপীয়ারের ‘টুবি অর নট টুবি দ্যাটস ইস দ্য কোশ্চেন’-এর ভেতরে খুঁজছেন সমাধান। সমাজের নিকৃষ্টতম অপরাধের বিরুদ্ধে মুহাম্মদ মহিউদ্দিনের সোচ্চার প্রতিবাদ এ গল্পটি। ‘বৃষ্টিতে উষ্ণতায়’ প্রেমের গল্প। মিলির মেয়ে আছে জেনেও মিলিকে ভালোবাসতো কবির কিন্তু বিশ্বাসটা ভেঙে গেল যখন দেখল মিলির বিছানায় অন্য কেউ। ‘ছোয়া’ ইংরেজি প্রভাষকের জীবনে আচমকা পাতা এলো। আবার কিছু না বোঝার আগেই চলে গেল। ‘পরিচয় ফেসবুকে’ দেখিয়েছেন এ প্রজন্মের অবুঝ প্রেম। ‘বিশ্বাস’ সমাজে কিছু লোক আছে তারা পারে না অন্যের সুখ সহ্য করতে। জামান তেমনি ধরণের লোক। দিয়া সৈকতকে দিতে চায় যন্ত্রণা। কিন্তু ওদের দুজনার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। ‘একটি আত্মহত্যার গল্প’ রায়হান তার স্ত্রী বৃষ্টির আত্মহত্যার মিথ্যে গল্প সাজিয়ে বৃষ্টি ও মাহমুদ পাটোয়ারীর প্রেমের সত্যতা যাচাই করতে চেয়েছিল যখন বুঝল দুজনে দুজনকে ভালোবাসে ওদের প্রেমের স্বীকৃতি দিয়ে রায়হান চলে গেল। ‘পুজোর জামা’ শিখা তার ছেলে নয়নের জন্য পুজোর জামা কিনেছিল কিন্তু দুর্ভাগ্য ছেলেটি পানিতে ডুবে মারা যায়। জামাটি পরা হয় না। ‘একজন বুদ্ধিজীবীর গল্প’ মানুষের নৈতিকতার দ্বৈত আচরণই ফুটে উঠেছে। শেষ গল্প ‘এখানে ভাড়ায় মানুষ পাওয়া যায়’ গল্পটি অন্যরকম গল্প। মানুষ সব সময় ভাড়া খাটে। তবে প্রেসক্লাব এলাকায় মানুষ ভাড়াটা অন্যরকম। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা প্রতিবাদ মিছিলে মানুষের প্রয়োজন হয় তখনই কলিম মিঞা ভাড়ায় মানুষ দেয়। মানুষ ভাড়ার টাকা গুণলেও এটা পরের উপকার। নিজের উপর রাগ হল তার মেম্বার ছালামত তার বউয়ের সম্ভ্রম নষ্ট করে। বউ আত্মহত্যা করে। এ ব্যাপারে কেউ তাকে সাহায্য করে না আর তাই সে নিজেও আত্মহত্যা করে সরকারকে দোষারূপ করে। অনেক কষ্ট নিয়ে সে চলে যায়। গল্পকার মহিউদ্দিনের গল্পের হাত ভালো। দৃষ্টিশক্তি প্রখর। সমাজ সাগরের তলদেশে হানা দিয়ে গল্পের মনিমুক্তা সংগ্রহ করেছেন। তবে গল্পে আর একটু রসবোধের প্রয়োজন আছে। প্রতিটি গল্পে বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায়। কামনা করি তার লেখা আমাদের গল্পসাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করুক।