এখন ওষুধেও মরছে না মশা : গবেষণা

76

মশা ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠায় রাজধানীতে দুই সিটি কর্পোরেশন যে ওষুধ ছিটাচ্ছে, তা কোনো কাজে আসছে না। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা মশা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এই পতঙ্গের ওষুধ প্রতিরোধের সক্ষমতার প্রমাণ পেয়েছে।
গত মে মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আইইডিসিআরের একটি সভায় দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। ইউএস সিডিসির অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণায় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা থেকে এডিস এজিপ্টি ও কিউলেক্স মশার ডিম সংগ্রহ করে আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণাগারে বড় করা হয়। খবর বিডিনিউজের
আইসিডিডিআর,বি’র গবেষক ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, এসব মশা বড় করার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøউএইচও) নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষা করে দেখেন তারা। ডবিøউএইচও’র প্রটোকল অনুযায়ী, নির্ধারিত মাত্রার ওষুধ দেওয়ার একটি নির্দিষ্ট সময় পর মশার মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশের কম হলে সেটি ওষুধ প্রতিরোধী হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু আমরা দেখেছি, বেশিরভাগ জায়গার মশার মরার হার শূন্য শতাংশ। আবার দ্বিগুণ মাত্রায় ওষুধ দিলেও শতভাগ মশা মরছে না।
মশার ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠার বিষয়টি স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া অ্যান্ড এডিস ট্রান্সমিটেড ডিজিজেজ’র উপ-কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ডা. এম এম আক্তারুজ্জামানও। তিনি বলেন, কিউলেক্স মশা নিয়ে তারাও একটি গবেষণা করে দেখেছেন, মশার ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। আমরা কিছু জটিলতা দেখেছি। মশা মারতে তিন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করে। এরমধ্যে একটিতে মশার রেজিস্টেন্স তৈরি হয়েছে। বিষয়টি আমরা সিটি কর্পোরেশনকে জানিয়েছি। পূর্ণ বয়স্ক মশা মারতে না পারলেও ওষুধে মশার শুককীট বা লার্ভা দমন হচ্ছে বলে জানান ডা. আক্তারুজ্জামান।
রাজধানীর মশা মারতে দুই সিটি কর্পোরেশন বিদায়ী অর্থ বছরে ৪৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা খরচ করার পরও কমছে না মশা। ফলে বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে শুরু করেছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। গত পহেলা জানুয়ারি থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত এক হাজার ৮৭ জন ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। এরমধ্যে দু’জন মারা গেছেন।
ডেঙ্গুর প্রকোপের জন্য দুই সিটি কর্পোরেশনকেই দায়ী করছে নগরবাসী। তাদের অভিযোগ, নগর কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো মশার ওষুধ ছিটায় না। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানা যায়, তারা পূর্ণ বয়স্ক মশা নিধনে প্রতি এক লিটার কেরোসিনের সঙ্গে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পারমেথ্রিন, শূন্য দশমিক দুই শতাংশ টেট্রামেথ্রিন এবং শূন্য দশমিক এক শতাংশ এস-বায়োঅ্যালাথ্রিন মিশিয়ে ফগার মেশিন দিয়ে ছড়িয়ে দেন।
১০ লিটার পানিতে ৫ মিলিলিটার টেমিফস নামে একটি ওষুধ মিশিয়ে তা মশার লার্ভার প্রজননস্থলে ছিটানো হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) পূর্ণ বয়স্ক মশা মারতে এক লিটার কেরোসিনের সঙ্গে শূন্য দশমিক দুই শতাংশ পারমেথ্রিন, শূন্য দশমিক দুই শতাংশ টেট্রামেথ্রিন এবং শূন্য দশমিক দুই শতাংশ অ্যালেথ্রিন মেশায়।
গত ১০ বছর ধরে মশা নিধনে এই ওষুধ ব্যবহার করে আসছে দুই সিটি কর্পোরেশন। নোকন লিমিটেড থেকে মশার ওষুধ সংগ্রহ করে ডিএনসিসি। আর ডিএসসিসিকে মশা মারার ওষুধ সরবরাহ করে নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড। গবেষণার ফলাফল দেখে পূর্ণ বয়স্ক মশা নিধনের জন্য ওষুধ পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছে আইসিডিডিআর,বি। মশা মারতে পারমেথ্রিনের পরিবর্তে ম্যালাথিয়ন ও ডেল্টামেথ্রিন ব্যবহার করতে বলেছে তারা।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ডা. আক্তারুজ্জামান বলছেন, এখনই ওষুধ পাল্টে ফেলা যাবে না। এজন্য সময় লাগবে।
দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে মশার ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ‘অবগত আছেন’ বলে জানালেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তারপরও ওষুধ না পাল্টানোর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এজন্য অনেকগুলো প্রক্রিয়া শেষ করে আসতে হয়। আমরাও চেষ্টা করছি এখানে কিছু পরিবর্তন আনা যায় কি না। অন্য কিছু ব্যবহার করে যদি বেশি সুফল পাই তাহলে আনতে সমস্যা নেই। তবে আমরা যাই করি না কেন, তার প্রেসক্রিপশন আনতে হবে ডবিøউএইচও থেকে। এখানে স্বাস্থ্য, পরিবেশগত অনেক ব্যাপার থাকে। এজন্য প্রেসক্রিপশনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ কম। কাল (গতকাল বৃহস্পতিবার) আমাদের একটা সেমিনার আছে এ বিষয়ে। সেখানে বিশেষজ্ঞদের মতামত আমরা চাইব। দেখি তারা কি বলেন’।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুনও বলেন, ওষুধ পরিবর্তনের চিন্তা করছেন তারা। তিনি বলেন, ‘আমরা এই ওষুধ কেনার আগে নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষা করি। সেই টেস্টে কিন্তু আমরা ওষুধের কার্যকারিতা কখনোই কম পাই নাই। তারপরও যেহেতু অভিযোগ আছে, অনেকদিন ব্যবহারের কারণে রেজিস্টেন্স ডেভেলপ করেছে। আইসিডিডিআরবি’র কাছে আমরা ডকুমেন্ট চেয়েছি। এটা যদি প্রমাণিত হয় ওষুধে কাজ হচ্ছে না আর বাজারে যদি অল্টারনেটিভ থাকে, তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা নাই।