এক নিভৃতচারী শব্দচাষী কবি ময়ুখ চৌধুরী

574

বাংলা কবিতায় সত্তর দশকের সবচে’ উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি ময়ূখ চৌধুরী। যদিও তাঁকে তিরিশের কাব্যধারার উত্তরাধিকারী বলা হয়। প্রচারবিমূখ এই কবি নীরবে-নিভৃতে তৃপ্ত করে যাচ্ছেন বোদ্ধা পাঠকদের। একারণেই ড. মনিরুজ্জামান বলেন- “ কবি মেলায় বা ভিড়ে নিরন্তর অনুপস্থিত থেকে ময়ূখ হয়ে ওঠেছে নির্জন স্বভাবী এবং সেভাবেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন স্বরাট অবয়বে যার গরিমাময় প্রকাশ প্রমাণ করেছে প্রচারই কবিতা নয়, কেননা সে এক অন্বিষ্ট খুর-চঞ্চলা ডাক-হরিণ”। তাঁর কবিতায় ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রেম-প্রকৃতি আর বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে নান্দনিক রসায়ন ব্যাপ্ত রয়েছে। আঙ্গিক এবং কাব্যাদর্শের দিক থেকে তিনি রোমান্টিক এবং সৌন্দর্যবাদী। তাঁর কাছে জীবনই কবিতা, কবিতাই জীবন। জীবনের সমস্ত উপলব্ধি, আনন্দ-বেদনা প্রকাশের শৈল্পিক মাধ্যম। এক সাক্ষাৎকারে কবি বলেন- “ শিক্ষকতা আমার পায়ের তলার মাটি, কবিতা আমার অন্বিষ্ট নীলিমা, নিঃশ্বাসের বায়ুমÐল, একটি জীবিকা অন্যটি জীবন”। স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে চলার অভ্যাস কবির নেই। তাই তো সভা-সমিতির আঙিনায় কিংবা সাহিত্য আড্ডায় খুব একটা দেখা যায় না।
বাংলা কবিতার অন্যতম প্রাণপুরুষ কবি ময়ূখ চৌধুরীর প্রকাশিত কাব্যের সংখ্যা নয় (৯)। তিনি শুধুকবি-ই নন; একজন গবেষক এবং সমালোচকও বটে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়িয়েছেন চার দশক। যেখানে তিনি ড. আনোয়ারুল আজিম নামে পরিচিত। ময়ূখ চৌধুরী তাঁর ছদ্মনাম। কবিতা ছাড়াও লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, নিবন্ধ এবং স্মৃতিকথা। ছাপা লেখার বয়স যখন দুইযুগ পূর্ণ হয় তখনই প্রথম কাব্য ‘কালো বরফের প্রতিবেশী’ (১৯৮৯) প্রকাশিত হয়। এর দশক পর প্রকাশিত হয় ‘অর্ধেক রয়েছি জলে, অর্ধেক জালে’ (১৯৯৯)। এছাড়া ‘তোমার জানালায় আমি জেগে আছি চন্দ্রমল্লিকা’ (২০০০), ‘প্যারিসের নীলরুটি’ (২০০১) প্রকাশিত হয়। ২০০২ সালে ‘আমার আসতে একটু দেরি হতে পারে’ প্রকাশিত হওয়ার পর আসলেই অনেক দেরি করে ফিরেছেন প্রিয়কবি। অনেকটা কৈফিয়ত দেয়ার মত ‘পলাতক পেন্ডুলাম’ নিয়ে কাব্যভ‚বনে হাজির হন ২০১৫ সালে। এরপর ‘ক্যাঙ্গারুর বুকপকেট’ (২০১৬), ‘পিরামিড সংসার’ (২০১৭) আলোর মুখ দেখে। স¤পাদনা করেছেন ‘প্রতীতি’ এবং ‘কবিতা’ নামের দু’টি সাহিত্যকাগজ।
জগতে দলবাজি না করে সত্যের পথে শিরদাঁড়া হয়ে চলতে গেলে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আদিকাল থেকেই এমন ধারা চলে আসছে মানব সমাজে। এতে একজন কবি থেমে যেতে পারে না। দাঁড়িয়ে যেতে পারে না। নতুন পথের নেশায় হেঁটে চলে। কোনো বাঁধাই আটকাতে পারে না। ‘দাড়ালেই পাথর হয়ে যায়’ কবিতায় কবি এমন একটি চিত্রকল্প তৈরি করে বলেন-
দাঁড়ালেই পাথর হয়ে যায়
আমি তাই হাঁটি
অবিরাম পথের নেশায়
পায়ের তলায় আঁকি মানচিত্র রক্তের রেখায়
পদে পদে খানা খন্দ, কাঁটাঝোপ, ক্রোধান্বিত রোধ
তবু
পথের নেশায় পথ খুলে যায়
খুলে যায় জানালার ডানা
সব দরজার সামনে মানুষের দেখা পেয়ে যায়
আমি তাই হাঁটি
দাঁড়ালে পাথর হয়ে যায়।
(দাঁড়ালেই পাথর হয়ে যায়)
চলার পথকে থামাতে যখন খানাখন্দ, কাঁটাঝোপ আর ক্রোধান্বিত রোদ হাজির হয় তখন স্বপ্নবাজ-দৃঢ় প্রত্যয়ী হৃদয়ের ‘খুলে যায় জানালার ডানা’। সামনে পেয়ে যায় সঙ্গী। তেমনি কোনো জাতি যদি দৃঢ় প্রত্যয়ী হয় সে জাতির মুক্তি কেউ ঠেকাতে পারে না। সাম্য-শান্তি-গণতন্ত্র ফিরে আসবেই। কিন্তু ‘দাঁড়ালে পাথর হয়ে’ যাবেন। তাই আমাদের উচিৎ কবির মত দৃঢ়সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। বাংলা ভাষার অনেক কবিই বাঙলা সাহিত্যের নানা অনুষঙ্গ ও ঐতিহ্য তাঁদের কবিতায় ব্যবহার করেছেন। সেদিক দিয়ে অগ্রগণ্য কবি ময়ূখ চৌধুরী। বাংলা সাহিত্য প্রসঙ্গ খুব সচেতনভাবে ওঠে এসেছে কবির কবিতায়। তিনি আধুনিক হয়েও ঐতিহ্যবাদী। কবি কমরুদ্দিন আহমদের ভাষায়- “বাংলা কাব্য ও সাহিত্যের ঐতিহ্য ময়ূখ চৌধুরীর কাছে যতটা গোরবের ততটা আদর্শের। বাঙলা সাহিত্য প্রসঙ্গ যেভাবে ময়ূখ চৌধুরীর কবিতা যতটা সুখকর সাহিত্য সামগ্রি রূপে ¯পষ্ট হয়ে ওঠেছে ততটা অন্য কোনো বাঙালি কবির কবিতায় ধরা পড়েনি। রীতিমত তিনি বাঙলা কাব্যের ঐতিহ্যকে প্রেরণার উৎস মনে করতেন”। প্রাচীনযুগের চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন বৈষ্ণব পদাবলী প্রভৃতি অত্যন্ত গৌরবের সাথে ওঠে এসেছে কবির কবিতায়। তিনি আদিকবি ‘ভুসুকু পা’ কে নিজের কাব্যকলার গুরু ভাবতেও দ্বিধা করেননি। কবির ভাষায়-
হরিণকে যে হরিণ বলি, হরিণ কি তা জানে?
কবি হলেন ভুসুকু পা তাহার পিছন টানে।
ভুসুকু তো কবি হলেন তরঙ্গি পায়ে,
পদ্মানদী ভেসে গেলো চর্যাপদের নায়ে।
ও ভুসুকু ও ভুসুকু ও ভুসুকু পা
কাব্যকলার মন্ত্র আমায় শিখিয়ে দিয়ে যা।
(বাল্মীকি, কালিদাস ও ভুসুকু)
মানুষ যতই আত্মকেন্দ্রিক কিংবা আত্মবাদী হোক না কেন কখনই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। হয়তো কিছুটা আড়াল হয়। তবুও সমাজের আবহাওয়া গায়ে এসে লাগে। অধিক তাপে গরম লাগে কিংবা নি¤œতাপে শীত অনুভ‚ত হয়। পৃথিবীজুড়ে চলমান সভ্যতার সংকট কবিকেও আলোড়িত করে। ক্ষয়িষ্ণু মানব সংকট এবং মানবীয় স¤পর্কের সংকটের দরুন আজকের বিশ্বে যে অরাজকতা তৈরি হয়েছে তা তিনি বিভিন্ন কবিতায় ব্যক্ত করেছেন। সমগ্র অবক্ষয়কে সমালোচনা ও ব্যঙ্গের সুরে কবি বলেন-
বাইরে পড়ে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
চলো, ওগুলো ঢুকিয়ে রাখি ফ্রিজে
যখন দরকার হবে, তখন না হয়…
ওদের খবর নেয় ছত্রাকেরা- গা ঘেঁষে দাঁড়ায়।
ফ্রিজটা খারাপ হলে বিশ্বব্যাংক ঠিক করে দেবে।
(নৈতিক মূল্যবোধ)
পুঁজিবাদী সভ্যতায় চলমান অবক্ষয়ের সাথে > ৪র্থ পৃষ্ঠায় দেখুন
> ৩য় পৃষ্ঠার পর
বিশ্বরাজনীতির স¤পর্ক কবি ‘বিশ্বব্যাংক’ প্রসঙ্গ এনে স্থাপন করেন। প্রেম-ভালোবাসা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ময়ূখ চৌধুরী রোমান্টিক কবি। প্রেমের কবি। সাহিত্যে কামনামিশ্রিত শরীর এবং লালায়িত রূপ চিরকালই স্বীকৃত হয়ে আসছে। প্রেম শরীরসর্বস্ব নয়। মনের মিলনও জরুরি। প্রেম, রমণীর শরীরের শিহরণে কবি কেঁপে ওঠে। প্রেমে পড়েন। বার বার প্রেমে পড়েন। কামাসক্ত হন। তৃষ্ণার্ত হন। অনন্ত কামনা-বাসনার নদীতে নিজেকে ডুবিয়ে পবিত্র হয়েছেন। কবির ভাষায়-
সারা দেহে জ্বালা ধরে জমে ওঠে লালা
তখনই পবিত্র হই
যখন তোমাকে দেখি আজও মধুবালা।
(দি মিথ অব মধুবালা)
তোমার শরীর ছোঁয়া সরীসৃপ জল
সেই কবে শিখিয়েছে চিরায়ত প্রেমের কৌশল
(সিন্ধু সভ্যতা)
প্রকৃতির নিয়মেই পানির সাথে জীবনের স¤পর্ক বাঁধা। বর্ষা বাংলা প্রকৃতি এবং সাহিত্যের খুবই
গুরুত্বপূর্ণ ঋতু। বর্ষাকালে কবির ভাষায় বীর্যতা বাড়ে। মেঘ-বর্ষার সাথে বিরহের অনুষঙ্গ আজ
বিশ্বময়। এটিকে সার্বজনীন করার পেছনে অন্যতম কারিগর কবি কালিদাস। কালিদাস আর
রবীন্দ্রনাথকে বলা হয় বর্ষার কবি। দেশের মাটি-পানি-কাদা বুকে নিয়ে শব্দের চাষ করতে পারা গর্বের বিষয়। এটিই ছিল ময়ূখ চৌধুরীর কাব্যদর্শন। বর্ষার বিরহে কবি বলে ওঠেন-
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে এমন ময়ূখ হতে চায়
তবু কেন বিরহের হাওয়া উদাসীন আমাকে নাচায়
আমি তো চাইনি কোন কিছু সে আমাকে চেয়েছিল দিতে
আলের আগল ভাঙা স্রোত বিপরীত দুই পৃথীবিতে।
আমাদের পায়ের তলায় মরা ঘাস শুধু পথ চলা;
সামনে গন্তব্য কিছু নেই তবু কেন সেজেছো বিমলা?
আষাঢ় শ্রাবণ দুই চোখে বয়ে যায় বেহুলার নদী
ভাসানে প্রেমের লাশ নিয়ে তুমি চলে যেও নিরবধি।
(আষাঢ়স্য প্রথম দিবস)
মৃত্যু এক অনিবার্য সত্য। তাই মৃত্যুচিন্তা থেকেও কবি পালাতে পারেনি। ‘পলাতক পেন্ডুলাম’র একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে এই মৃত্যুচিন্তা। দূরবর্তী বিপদ-সংকেত, গোল্ডফিশের চশমা, কৃষ্ণসুড়ঙ্গ, যাওয়া, থেকে-যাওয়া, পূর্বপ্রস্তুতি, মৃত্যুর জীবনী গ্রন্থ, একটি খাটিয়া নামানোর জন্য ক’জনকে কষ্ট দেবো প্রভৃতি কবিতাগুলো মৃত্যুর বহুরৈখিক চেতনা ও উপলব্ধির প্রতিফলন। কবির কাছে জীবন মৃত্যুর রেখা খুব কাছাকাছি। কবির ভাষায়-
যেদিন প্রথমবার কর্প‚রের শাদা গন্ধ পেলাম
সেদিনই প্রথম মনে হয়েছিল- বেঁচে আছি
যেদিন প্রথমবার মনে হলো, বেঁচে আছি
সেদিন থেকেই বুঝি মরে যাওয়া শুরু।
(মৃত্যুর জীবনীগ্রন্থ)
পৃথিবীতে আয়ু শেষ হলে সবাইকে-ই চলে যেতে হবে অবিনশ্বর জগতের উদ্দেশ্যে। চিরপ্রস্থানের কথা কবির ভাষায়-
যাবতীয় শাদা হিশাবনিকাশ ঝিমিয়ে পড়লে
প্রচÐ ভারি কালো একটা ঘুমকে পড়ানো হবে শাদা জামা।
(একটি খাটিয়া নামানোর জন্য ক‘জনকে কষ্ট দেবো)
নতুন নতুন উপমা এবং চিত্রকল্প তৈরিতে তিনি সিদ্ধহস্ত। লেখায় যদিও কিছুটা জটিলতা লক্ষণীয়
তবুও কাব্যতাত্তি¡ক বিচারে তিনি বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর যোগ্যতার
অমোঘ স্বীকৃতি দেশ-বিদেশে। তবুও তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ তকমা অর্জন করেননি। না প্রাপ্তির এই মরুভ‚মিতে কিঞ্চিৎ পানি দেয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তিনি ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সাহিত্য পুরষ্কার’-এ ভ‚ষিত হন। একই বছর তিনি সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ‘আবদুল করিম খান স্মৃতি পুরষ্কার’ লাভ করেন। কবিতার প্রতি সহৃদয় আলস্য ঝেড়ে ফেলে কবি ময়ূখ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।