এক দিনে কয় ঘণ্টা

106

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

আঠার মাসে বছর কথাটা প্রায় সময় শুনি, কাউকে কাউকে আবার ছত্রিশ মাসেও বছর বলতে শুনি। মনে হয় সুসময় বুঝাতে কথাগুলা বলে থাকে। কিন্তু আমাদের চট্টগ্রাম ওয়াসা নাকি বলেছে তাদের কর্মচারীরা দৈনিক ২৯ ঘণ্টা কাজ করে! মাশাল্লাহ্ একদিনে ২৯ ঘণ্টা কাজ, বড়ই দেশ প্রেমিক কর্মচারী আমাদের ওয়াসার, কাজ ছাড়া কিছু বুঝেনা। এত কাজপাগল তারা কাজের জন্য উগান্ডা পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। জ্ঞানান্বেষণে চীন যাও, তারা বিজ্ঞান্বেষণে উগান্ডা গেছে, মাশাল্লাহ্ কি কাজ পাগল। ভাবছি কাজের জন্যে পাগলামী করেকোন উপরের চেম্বার খালি হয়ে গেল নাকি?নইলে একদিনে ২৯ ঘণ্টা কাজ কেমনে করে? জানি মানুষ সুখে থাকলে ছত্রিশ মাসে বছর গোনে, দুঃখে থাকলে একদিন যায় এক বছর। ওয়াসার কর্মচারীরা কিসে আছে, দৈনিক ২৯ ঘণ্টা কাজ গোনে? এখন আইনেস্টাইনকে নাকি একযুবক প্রশ্ন করল, স্যার আপেক্ষিকতা মানে কি? আইনেস্টাইন সে যুবককে নাকি হেসে উত্তর দেন; ‘ধর তুমি একটি জ্বলন্ত চুলার কাছে বসে আছো, তখন দুমিনিট মনে হবে তোমার দুঘণ্টা। আর যদি তুমি একজন অতি সুন্দরী যুবতীর পাশে বসে থাক, তখন দুঘণ্টা মনে হবে তোমার দু’মিনিট একেই বলে আপেক্ষিকতা।’ যুবক আশ্চর্য হয়ে; ‘স্যার আপেক্ষিকতা তো দেখছি ভীষণ সহজ!’ আইনেস্টাইন হেসে; ‘হ্যাঁ তা অতীব সহজ।’
এখন কাজ কি কোন সুন্দরী মেয়ে নাকি, একদিনে ২৯ ঘণ্টা করে ফেলছেন তারপরও তাঁদের খবর নাই?ছত্রিশ মাসে বছর, তাহলে কয় ঘণ্টায় এক দিন? আচ্ছা থাক সে হিসেবে পরে যাই ওয়াসাকে আগে দেখতে চাই। গেল সোমবার শুনলাম ওয়াসা নাকি আবার ১৯ রাস্তায় কোপানো শুরু করবে। বাহ্ ওয়াসা দেখছি কোপাতে ওস্তাদ। আমাদের ছাত্রসংগঠনের ভাতিজারা কোপানোর স্বভাবটা মনে হয় ওয়াসার কাছে পেয়েছে, মাশাল্লাহ্ হাহাহাহা। তিনমাস আগে দেখলাম ওয়াসা ৪১ জন কর্মকর্তাকে তাদের উগান্ডা পাঠাল। বিষয় উগান্ডা হতে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে তাঁরা জনতাকে পরিশোধিত জল পরিবেশন করবেন। যাতায়াতের জন্য কয়েক কোটি টাকা তো উনাদের পেছনে বরাদ্দ ছিল, তার বাইরে হাত খরচ বাবদ নাকি একেক জনকে দুই লক্ষ টাকা দেয়া হয়েছিল! কিন্তু পরিশোধিত সেই কাঙ্হ্মিত জলের দেখা আমরা এখনো পাইনি। যদ্দুর জানি দুই লক্ষ টাকা দিয়ে একজন লোক মাস খানিক আমেরিকা ঘুরে আসতে পারে। সে জায়গায় আমাদের ওয়াসার অফিসাররা হাতখরচ, মূল খরচ নয় আবার এই পান-বিড়ি-সিগারেট খরচ, পেয়েছেন জনে দুইলক্ষ টাকা। তা’ও কেবল সপ্তা-পনের দিনের জন্য। ঠিক আছে সরকারী মাল দরিয়াতে ঢাল সমস্যা নাই, কিন্তু দুঃখ যে জন্য গেল তার দেখা নাই। এখন এক ভাতিজার কাছে শুনলাম ওয়াসাতে নাকি ওভারটাইমের ভূত ঢুকেছে। সেই ভূত তাড়াতে আবার দুদক থেকে নাকি তিন ওঝা এসেছে। ভাবছি কোন তাদেরকেই আবার ভূতে ধরে ফেলে নাকি?
না এমন উদাহরণ তো অনেক দেখেছি ভূত তাড়াতে এসে নিজেই ভূতের কাছে ধরা খেয়ে যায়। ১/১১’তে দেখেছি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে এসে নিজেরাই তাতে যুক্ত হয়ে গেছে। কালো বিড়াল তাড়াতে গিয়ে কালো বিড়াল ধরাতে লিপ্ত হলোÑ এই সব আরকি। ও- কিছু না রাবিশ সবাই দেখি খবিশ। বলে কিনা দুই কোটি আর চার হাজার কোটির দ্ব›দ্ব, তবে শুনতে তত লাগেনা বেশী মন্দ। আমরা সবাই অন্ধ নাকেও লাগেনা গন্ধ। তাই সবকিছুতে উঠছে মহাছন্দ সবার মধ্যে বইছে মহানন্দ। সে কারণে আমাদের দেশে পর্দার দাম সাড়ে ৩৭ লক্ষ টাকা, ১টি কম্পিউটার মেরামত খরচ বছরে ১৮ লক্ষ টাকা! ১ বান টিন ৭ লক্ষ টাকা, ১টি ডেন্টাল চেয়ারের মূল্য ৫৬ লক্ষ টাকা! হাহাহাহা, লাখের নিচে কথা নাই, আমরা আছি কোটি ভাই। তবে পিঁয়াজই’না দেখছি এখন মহাঝড় তুলেছে। ডাবল সেঞ্চুরী পার করে কোথাও কোথাও নাকি ট্রিপল পর্যন্ত স্পর্শ করেছে, মাশাল্লাহ্। অবশ্য সেই ঝড় এখনো থামেনি পূর্ণ শক্তি নিয়েই চলছে। তাই নিন্দুকগণ কহে, মন গলাতে পাঠাই ছিলাম ৫শ টন ইলিশ, তবু আজও বন্ধ হয়নি দাদাদের নালিশ। আচ্ছা থাক বাদ দিই পিঁয়াজ আর ইলিশ, তা নিয়ে করুক তারা যত পারুক শালিস। সেসব নিয়ে মোদের আর নেইকো কোন নালিশ, কিন্তু ওয়াসার কাণ্ড দেখে নিতে হচ্ছে বালিশ। ওয়াসার কর্মচারীরা নাকি দিনে ২৯ ঘণ্টা কাজ করে! তাহলে ক’ঘণ্টায় একদিন?
আমাদের দেশে দেখলাম এ পর্যন্ত অনেক কিছু সম্ভব হয়েছে। কাঁথা-বালিশ-কম্বলের দাম সহ অনেক কিছুর দামে আকাশ-পাতাল পার্থক্য করা সম্ভব হয়েছে। পুকুর খনন শিখতে নিউজিল্যান্ড-ন্যাদারল্যান্ডস যাওয়া সম্ভব হয়েছে, পানি পরিষ্কার করার জন্য উগান্ডাও যাওয়া সম্ভব হয়েছে। আরো অনেককিছু সম্ভব হয়েছে তা’ও জানি। কিন্তু ১ দিনে ১ জন মানুষের পক্ষে ২৯ ঘণ্টা কাজ করা কেমনে সম্ভব, সেটা ভেবে কূলকিনার কিছু পাচ্ছি না। এখন এক আবাল নতুন শহরে এলো, জীবনে কখনো লিফট দেখেনি। বিশাল এক ভবন দেখে অবাক বিস্ময়ে তার পানে তাকিয়ে আছে। দেখল আশি বছরের এক বুড়ি দাঁত নাই মুখে, কুচকুচে কালো ঢুকল ছোট খালি এক ঘরে। ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল, পাঁচ মিনিট পর দরজা খুলে গেল। ওমাÑ ভিতর হতে বেরিয়ে এল ধব ধবে সাদা এক বিশ্বসুন্দরী ডানাকাটা পরী। মাগো ঘরের ভিতর কি আছে, বুড়ি ঢুকে ছুড়ি কেমনে বের হল? ভেবে সে কুলকিনার কিছু পাচ্ছেনা বুড়ি কেমনে এত সুন্দর নারী হল? তার কাছে বুড়ির ছুড়ি হওয়া যেমন বিস্ময় আমার কাছে দিনে ২৯ ঘণ্টাও তেমনই বিস্ময়। অবশ্য থিওরী অব রিলেটিভিটির যুগে বুড়ি কি করে ছুড়ি হল, সে ব্যাখ্যা যদি দিতেও না পারি, দিন-ঘণ্টার একটি ব্যাখ্যা সম্ভবত দেয়া যেতে পারে। তার আগে দিনে ক’ঘণ্টা, তা নিয়ে আমার নিজস্ব একটি ব্যাখ্যা প্রদান করি।
আমরা জানি দিনে ৮ ঘণ্টা তথা দিনের তিন ভাগের এক ভাগ সময় কাজ করা নিয়ম। সুতরাং আট ঘণ্টা কাজ হলে ১ দিনে হয় ২৪ ঘণ্টা। অতএব ২৯ ঘণ্টা কাজ হলে ১ দিনে হয় ২৯ী৩= ৮৭ ঘণ্টা অর্থাৎ একদিনে ৮৭ ঘণ্টা। আবালের নাবাল হিসাব, মনে কিছু নেবেন না। চলুন এবার রিলেটিভিটির দিকে যাই, তার আগে একটি ঘটনা বলি। আব্দুল কাদের জিলানী, যিনি উপমহাদেশে বড়পীর নামেই সমাদৃত, একদিন ওয়াজ করছিলেন। মেরাজের ঘটনা তিনি বর্ণনা করছিলেন;‘আমাদের নবী (সঃ) মেরাজ গিয়েছিলেন, সেখানে তিনি ২৭ বছর অবস্থান করেছিলেন কিন্তু পৃথিবীতে মনে হয়েছে এক সেকেন্ড মাত্র সময়।’ এক ইহুদী ভানতে তা অবিশ্বাস করল এবং ইনকার করে চলে গিয়ে বাজার নিয়েবাড়ি ফিরল। বড় একটা জীবিত মাছও এনেছে, মাছটি একদম লাফালাফি করছে। বউকে সেসব রাঁধতে বলে সে গেল নদীতে ¯স্নান করতে। পানিতে নেমে এক ডুব দিয়ে উঠে দেখে যে জায়গায় ছিল সে জায়গায় সে নেই। অন্য এক অপরিচিত জায়গায় উঠেছে এবং ভীষণ সুন্দরী এক নারী হয়ে গেছে! এক সওদাগর তাকে দেখে বিয়ে করে নিয়ে গেলেন। সওদাগরের সাথে সে বার বছর সংসার করেছে, ৪/৫ সন্তানের মা হয়েছে। এক দিন সে নদীতে স্নান করতে এসে ডুব দিল। উঠে দেখে বারবছর আগের ঘাটেই সে উঠেছে, কাপড়গুলো সেভাবে রাখা আছে। বড়পীরের (রহঃ) মাহফিল তখনও চলছে, ঘরে গিয়ে দেখে বউ রান্না করেনি, মাছটি তখনও লাফাচ্ছে। সে বউকে জিজ্ঞেস করল তখনো রান্না করেনি কেন? বউ বলল; তুমি এই গেলে এই এলে এত দ্রুত কি রান্না হয়?
ভানতে তখন মেরাজের ঘটনা বিশ্বাস করল ও বড়পীরের কাছে গিয়ে ঈমান আনল। তাহলে দেখা যাচ্ছে কয়েক মুহূর্ত = ১২ বছর কিংবা ২৭ বছর হতে পারে। চলুন এবার আপেক্ষিকতা দেখি। আপেক্ষিকতা স্থান ও কালের ব্যাখ্যা করে, টাইম এন্ড স্পেস। আপনি যদি টাইম মেশিন পান তাহলে সময় আপনার জন্য কোন ব্যাপারই না। আপনি দশ হাজার বছর পূর্বে কিংবা বিশ হাজার বছর ভবিষ্যতে চলে যেতে পারেন। আলোর গতিতে চললে এখন আপনি যে সময় আছেন ১শ বছর পরও সে সময়েই থাকবেন, ঐ ১২ বছর বা ২৭ বছর আরকি। আপনার জন্য সময় আগপিছ হবে না, তাহলে মেরাজ বিশ্বাস হতে আর কষ্ট কি? তারপরও দেখি হারামজাদা কতগুলা আপেক্ষিকতা বিশ্বাস করে, মেরাজ করে না। আপনি আর বন্ধু দুইজন দুই গাড়িতে সমান গতিতে যাচ্ছেন, অতএব যতদূরই যান আপনারা একে অপরের জন্য স্থির, চলমান নয়। আপনি আর বন্ধু এক আলোকবর্ষ ব্যবধানে বসে আছেন, তাহলে আপনি দেখবেন একবছর আগের জিনিষ সে দেখবে একবছর পরের। এমন আরো অনেক বলে শেষ হবে না, তাই আসুন বিগ ব্যাং-এ। বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে গোটা মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে ১ সেকেন্ডকে ১০কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি ভাগ করে ১ভাগ নিলে যত হয় তত সময়ে। এখন সেটি যে কি বলতে পারব না, তবে একটি ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুতেও ২১ দিন সময় লাগে। অথচ গোটা বিশ্ব হয়ে গেল ঐ ক্ষুদ্র সময়ে, যা বলতে পারবেন কিন্তু ভাবলে পাগল হয়ে যাবেন।এটিও তারা বিশ্বাস করে কিন্তু ভানতে যে মেয়ে হয়ে ১২ বছর সংসার করেছে সেটি বিশ্বাস করে না।
অতএব আপেক্ষিকতা মোতাবেক আপনার ১দিন আমার ১০ বছর আবার আমার ১ঘণ্টা আপনার ২০ বছর হতে পারে ফলে ওয়াসাই ঠিক। ওয়াসা চলছে আপেক্ষিকতায়, সুতরাং উপায় নাই, ১দিনে ২৯ ঘণ্টা শুধু নয়, ২৯ বছর হলেও বিশ্বাস করা চাই। আমি বিশ্বাস করি ১ দিনে ২৯ বছর কাজের বিলও করা যায়। তাই আসুন কথা না বাড়াই, চলুন ওয়াসার সঙ্গে যাই।

লেখক : কলামিস্ট