এক অঙ্কের সুদের হার নতুন বছরের প্রথমদিন থেকে কার্যকর হবে তো!

197

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে সুদের হার দ্বি-অঙ্কবিশিষ্ট। শিল্পঋণের ক্ষেত্রেও এই নীতি প্রযোজ্য। যার কারণে দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা বৈশ্বিক বাণিজ্যে সন্তোষজনক মাত্রায় মুনাফা অর্জন করতে পারেন না। এক সময় উচ্চহারে পুঁজির সুদ দিতে গিয়ে নিজেরা খেলাপি হয়ে বসেন। এর পরও চলে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ। সুদের ওপর আবারো সুদ। এভাবে নির্দিষ্ট মাত্রার একটা পুুঁজি উচ্চ সুদের কারণে পরিশোধের সময়সীমা পেরিয়ে যায়। একপর্যায়ে অনেক শিল্প হয়ে যায় রুগ্ন। যে শিল্প মুনাফার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছিল, সে শিল্পের কারখানা এক সময় ঋণের দায়বদ্ধতার কারণে নিলামে উঠে যায়। এমন ভাগ্যাহত শিল্পপতি এ দেশে মেলা খুব কঠিন নয়। বিদেশের ব্যাংকগুলো নিজ দেশের শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে এক অঙ্কের সুদের হার কার্যকর রেখেছে। যার ফলে ওই সব দেশের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য তুলনামূলক অনেক কম। বিশ্ববাজারে ওইসব রফতানিকারক দেশ খুব সহজে স্বল্পমূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারে। পক্ষান্তরে আমাদের দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুদের হার বেশি হওয়ার কারণে পণ্যমূল্য বেড়ে গিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। এর আগেও আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোতে সুদের হার নামিয়ে আনতে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বারবার দাবি জানিয়েছেন। সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও একটা সন্তোষজনক আলোচনা হয়। অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আরো সুনির্দিষ্ট আলোচনা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী বারবার নির্দেশ দেয়ার পরও নানা অজুহাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক অঙ্কের সুদের হার কার্যকর করেনি। দেশে বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ঋণের সুদহার কমানোর জন্য সরকার উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে তা কার্যকর না হওয়া আর্থিক খাতের জন্য সংকট বলা যায়। গত রবিবার অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, আগামী ১ জানুয়ারি থেকে শিল্পখাতে ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট কার্যকর হবে। এর দুদিন পর মঙ্গলবার সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে গঠিত সাত সদস্যের কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির স্বার্থে এই প্রতিশ্রæতির দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চাই আমরা। কারণ এর আগেও বারবার উদ্যোগ নিয়ে তা কার্যকর হয়নি। গত বছর ১ জুলাই থেকে সিঙ্গেল ডিজিট তথা ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা ছিল, কিন্তু এক বছর পার হলেও বেসরকারি ব্যাংকই আদেশটি মানছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে কার্যরত ৫৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে অধিকাংশই এখনো দুই অঙ্কের সুদ নিচ্ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মেয়াদি ঋণে সুদ নিয়েছে ১২ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ। দুটি ব্যাংক ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদে এসএমই ঋণ দিয়েছে। বাড়ি-গাড়ি কেনার ঋণে ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ সুদ নিচ্ছে ব্যাংক। ক্রেডিট কার্ডে অধিকাংশ ব্যাংকের সুদহার রয়েছে ১৮ থেকে ২৭ শতাংশ। সরকারি মালিকানার ব্যাংকগুলো অবশ্য উৎপাদনশীল খাতে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। তবে ঋণ অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা এবং নানা জটিলতার কারণে অনেক সময় উদ্যোক্তারা সরকারি ব্যাংকে যেতে আগ্রহ দেখান না। ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) বলছে, সবার লক্ষ্য ব্যাংকে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামানো। তবে শুধু ঘোষণা দিয়ে আমানতে ৬% আর ঋণের সুদ ৯% বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। অনেক বিষয় আছে। এবিবি আশা করছে এবার দ্রæত বাস্তবায়ন করা যাবে।
ঋণের সুদহার কমানোর জন্য গত বছর ব্যাংকগুলোকে একের পর এক সুবিধা দেয়া হয়। ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ দেয় সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার কমানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বল্প মেয়াদে ধারের ব্যবস্থা ‘রেপো’র সুদহারও কমানো হয়। এসব সুবিধা দেয়ার প্রধান লক্ষ্য ছিল তুলনামূলক কম সুদে ঋণের মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা। সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন না করা গেলে কেবল ব্যবসায়ীরাই ব্যাংকবিমুখ হবেন না, উৎপাদন, বিদেশি বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন ফিরিয়ে আনার বড় চ্যালেঞ্জ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা সরকারের সামনে। শক্ত হাতে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোর ওপর তদারকি ও নজরদারি বাড়াতে হবে।