একুশের চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ

301

একুশের চেতনাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বাংলা একাডেমি গ্রন্থমেলা একাডেমি-চত্বর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের জেলাশহরেও এখন একুশের বইমেলা আয়োজিত হচ্ছে। সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘বই কেনা’ প্রবন্ধের ‘ড্রয়িংরুম বিহারিণী’ ধনীরা (উভয় অর্থে) বসন্তের ফুলে সজ্জিত হয়ে মেলায় আসছেন। বই কেনার কথায় ‘গরবিনী নাসিকা কুঞ্চিত’ করছেন না, বরং বই কিনে লেখকের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন, সেলফি তুলছেন। কেউ কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে নিজ খরচে বই প্রকাশ করে টিভিতে লাইভ সাক্ষাৎকার দেবার জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রচুর বই প্রকাশিত হচ্ছে। বই কেনাবেচা হচ্ছে। সেমিনার-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে; স্বীয় স্বার্থ হাসিলের অভিপ্রায়ে অহরহ ‘একুশের চেতনা’ নামক শব্দযুগল আউড়ানো হচ্ছে। চারিদিকে চেতনার কী জয়-জয়াকার!
চেতনার কথা বলা হচ্ছে স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে, প্রবন্ধ-রচনায়। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় এবিষয়ে প্রবন্ধগ্রন্থও মিলবে হাত বাড়ালেই। তবে একুশের চেতনা যে-কী সে-কথা মেলে খুব কম লেখায়। সবাই বায়ান্নোর একুশে ফেব্রæয়ারির ঘটনা প্রবাহের বর্ণনা দিচ্ছেন কিংবা সে-ইতিহাস বর্ণনাকেই একুশের চেতনা বলে চালাচ্ছেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একটি বাক্য আছে: ‘ইতে নঅ ঘুমায়, চেতন ফুতিরইয়্যে’ (এ ঘুমায়নি, সজাগ শুয়ে আছে)। আর সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় প্রবাদ আছে: ‘হজাগ মানর ঘুম ভাঙ্গানি যায় না’ (সজাগ মানুষের ঘুম ভাঙানো যায় না)। আমাদের পূর্ব-পুরুষগণ একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই মরণপণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশ অর্জন করেন। অথচ স্বাধীন দেশে আমরা যেন সজাগ শুয়ে আছি, আমাদের জাগানোর সাধ্য কার? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে কী? কী তার বীজমন্ত্র? কোন জাতীয়তাবাদ থেকে তা উৎসারিত? সে জাতীয়তাবাদের স্বরূপ-প্রকৃতিই বা কেমন? তা নিয়ে আমরা ক’জন ভাবি?
ভাষা-আন্দোলন আমাদের যে চৈতন্যের উদয় ঘটায় তা-ই আমদের একুশের চেতনা। আমরা সচেতনভাবে উপলব্ধি করতে পারি ভ্রান্ত দ্বি-জাতিতত্ত্বের নামে ধর্মের দোহাই দিয়ে যে ‘পাক’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো হয়েছিল, তা অবাস্তব। আমাদের চেতনায় জাগ্রত হয় আমার মাতৃভাষা, আমার সংস্কৃতি ‘নাপাক’ হতে পারে না। মৌলবাদীরা উর্দুকে ‘পবিত্র ভাষা’ আর আরবি হরফকে ‘মুসলমানের হরফ’ বলে আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারেনি। কেননা বাঙালি চিরকালই মৌলবাদ বিমুখÑসমন্বিত সংস্কৃতির ধারক। যা কিছু ভালো, তাকে আমরা সাদরে গ্রহণ করে নিজের করে নিই। তাইতো সপ্তদশ শতকে স›দ্বীপের কবি আবদুল হাকিম ঐ বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি বিষোদগার করেন:
যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ।।
একুশের প্রথম কবিতায় চট্টগ্রামের কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী লেখেন:
আমি আজ শোকে বিহ্বল নই
আমি আজ ক্রোধে উন্মত্ত নই
আমি আজ প্রতিজ্ঞায় আবিচল।
সুতরাং, একুশের চেতনা সাময়িক আবেগ-উত্তেজনা নয়, এক চিরস্থায়ী অনুভূতি। এ অনুভূূূতির নাম অসাম্প্রদায়িকতা বা মানবতা। যা ধরা পড়েছে চৌদ্দশতকের কবি চণ্ডীদাসের কবিতায়: শুনহ মানুষ ভাই / সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। তাইতো একুশের গানে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লেখেন:
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশে ফেব্রুয়ারি
প্রভাতফেরিতে এই গান গেয়ে গেয়ে আমরা বিশ্ববাসিকে জানাই: আমরা মানুষ, ভাষায় বাঙালি, আমাদের ধর্ম মানবতা। মানুষের মাতৃভাষা রক্ষায় পালন করি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু জাতীতাবাদের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন: ‘ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন, সকলের সাথে একটা জিনিস রয়েছে, সেটা হলো অনুভূতি। …এই সংগ্রাম হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালি, আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ । শহীদমিনারগুলো সারাবছর কংকর কোকিল হয়ে আমাদের অসাম্প্রদায়িকতার গান শোনাবে ও প্রেরণা জোগাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনের । বাঙালি লেখায়, কথায়, জীবনাচরণে যতকাল একুশের চেতনা বহমান থাকবে ততদিন মৌলবাদ এখানে মাথা তুলতে পারবে না। পথ হারাবে না বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করেই মুক্তবুদ্ধির বিকাশ ঘটাবে বাঙালি জাতি। বিনির্মাণ করবে স্বপ্নের সোনার বাংলা।