একুশের আলোকে

78

আবদুল হাই

একুশের জন্য বিলম্বে একটা নিবন্ধ লেখা যেন দৃষ্টিকটু মনে হয়। লেখাটা বিলম্ব হওয়ার কারণে একটা অতিপুরনো স্মৃতিকে নতুন করে উপস্থাপনের সুযোগ পেয়েছি। গত সোমবার অর্থাৎ ২ মার্চ, কাজী ওয়াহাব ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ। ৬০’এর দশকে ওয়াহাব ভাই ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক, বর্তমান রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বয়সে আমার অনেক বড়ো, পূর্বদেশ পত্রিকা অফিসে যেতে আচমকা দেখা, অনেকদিন পরে। দাদা আস্সালামু আলাইকুম। আমাকে দেখে প্রথম চিনতে পারেন নি। না পারারই কথা। তাঁকে আমার পরিচয় দিতেই একটা দোকানে আমাকে নিয়ে ঢুকে পড়লেন। এ দোকানে আসলে আমাকে পাবা। অতীতের কিছু স্মৃতি তার স্মরণের জন্য উপস্থাপন করে বললাম, ষাটের দশকে আইয়ুব প্রশাসনে একুশে ফেব্রæয়ারিতে আপনি একটা দীর্ঘ মিছিলসহ মুসলিম হাই স্কুলে ঢুকেছিলেন, খালেদ ভাইও ছিলেন আমাদের রবিউল ভাই ও আপনার সঙ্গে একুশের ওপর বক্তৃতা দিয়েছিলেন। শিক্ষকদের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করে একুশ উপলক্ষে আমাদেরকে নিয়ে এক লম্বা মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আপনার সঙ্গে চট্টগ্রাম গোটা শহর অর্থাৎ আগ্রাবাদ পর্যন্ত ছিলাম। মিছিলে স্লোগান ধরেছিলাম। আপনি বেবী টেক্সিতে মাক্রোফোন আপনার হাতে ছিলেন। দেখি, আজ অবধি তার সম্পূর্ণ তাঁর স্মরণে মজুদ আছে। ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনে কাজী ওয়াহাব এবং আশরাফ খাঁন সাহেবকে সার্বক্ষণিক কাছে পেয়েছিলাম। সত্যিকার ত্যাগী নেতা। বেশ ভালো লেগেছিলো। আন্দাজ করতে পারলাম বয়স বোধয় ৭০ পেরিয়ে গেছে। তবুও নিজের পায়ে ভর করে হাঁটতে পারা এত্ত কম সন্তুষ্টি নয়। আমার একটা কার্ড সবিনয়ে তাঁকে তুলে দিলাম। মনে হয় উনিই আমার পরম প্রাপ্তি। উনিই আমার একুশের প্রথম প্রেরণা। উনার মাধ্যমে প্রথম একুশকে জেনেছি। শহীদদের ছিনেছি। এবারের একুশ নিয়ে নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু কথা।
আমার সন্তানদের সর্বজ্যৈষ্ঠ আরিফ। পাঠ্যাবস্তা থেকে তাঁর স্পিৃতা ছিলো গার্মেন্টসে একজন বড়ো পদবীতে চাকুরী করবে। তার লালিত স্পিৃহা যেন বাস্তবায়িত হয়েছে। ও ঢাকার এক বাইয়িং কাউজে কর্মরত। নিশ্বাস নেবার ফুরসত নেই। সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা-১২টা অবধি ১৪-১৫ ঘণ্টা খাটুনি। মন মনের মধ্যে নেই। মে দিবসে সর্বোচ্চ ৮শ্রম ঘণ্টা পালিত হয়না। চীনে করোনা ভাইরাস, রাশিয়া আপাতত: চীনে অর্ডারপাতি স্থগিত করেছে। তাই বাংলাদেশে পোশাক সামগ্রীর অর্ডার বেড়েছে। ওদের সাপ্তাহিক বন্ধ ২ দিন। অর্থাৎ শনি-রবি, একুশে ফেব্রæয়ারি শুক্রবার হওয়াতে টানা ৩দিনের ছুটি। ছুটিতে ছুটে এসেছে। ওর সান্নিধ্যে মনটা আনন্দে কানায় কানায় ভর্তি। ওকে বললাম, ফ্রেস হয়ে নাও। আজ অমর একুশে। প্রভাতফেরীতে খাওয়ারভুত মাথায় পেয়ে বসেছে। শোকের দিন, তাই কালো পাঞ্জাবি-পায়জামা এবং কালো টুপি পরেছি। সাজগোজে আরিফের বাচবিচার তেমনটা নেই। সকালের পুরো সূর্য্য দৃশ্যমান। বাপছেলে পল্লী পেরিয়ে রাজপথে। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ডান-বাঁয়ে চোখ ঘুরিয়ে দেখি। কেউ নেই। কে নেই ? লাউড ইস্পিকারে একুশের গান নেই। কেন নেই ? কিরে বাবা এমনটা হলো কেন ? এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে হলো কেন ? কি হলো ? একুশের এমন ধস্। একুশের চাঙ্গাভাব কেন হারিয়েছে ? অসম্ভব রকমের অন্তরজ্বালার অনলে দগ্ধ হলাম। মনের ক্ষরিষ্ণু অভিব্যক্তি কার কাছে ব্যক্ত করে মনটার দুঃখের ভারটা হালকা করবে। এ শোকের জন্য কালো পরিধেয় ছিলে টুকরো টুকরো করতে ইচ্ছে জাগ্রত হয়। মনে করলাম এতো আত্মহনের ভিন্ন প্রয়াস তাই সহিষ্ণুতাকে বিকল্প হিসেবে ধারণ করে এগিয়ে চলি। এগিয়ে চলি, সামনে কোতোয়ালী মোড়। আমার আরিফকে বল্লাম জানো বাবা, আমি তখন ষষ্ঠশ্রেনিতে পড়–য়া। তখন শিশুকাল। তারপর কবিতা পড়া এবং কবিতা লেখার ঝোঁক ছিলো। তখন যে কবিতা একুশের স্মরণে লিখেছিলাম এর দু’লাইন আজো স্মৃতিতে সঞ্চিত। ‘বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের শহীদ তোমরা লাও সাড়ে সাত কোটি সালাম, বাংলার জনে জনে স্মরণিত তোমরা, সালাম,বরকত, জব্বার, রফিক, তোমাদের নাম’,
মোটামোটি একুশ ছিলো বাঙালির অনুপ্রেরণা। আবার একুশ ছিলো পাক সরকারের আতঙ্কের হেতু এবং বেতৃষ্ণার বক্রচক্ষু-সাল। তারপর ও প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে অবস্থান করে শক্তি সমর্থ্যরে ওপর ভর করে একুশ বাঙালির অস্তিত্বের পক্ষে আান্দোলনকে শক্তি সাহস যুগিয়েছে। স্বাধীনতা লাভের জন্য সেই আন্দোলন ছিলো নিতান্তই আবশ্যক। একুশ শিক্ষা দিয়েছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রশিক্ষণ। তাই একুশ বাঙালির স্পন্দনের জীবনশক্তি। এবারকার একুশেতো ঢিলেঢালা এতো নির্জীবতা নিয়ে কেন পালি হলো। কোথায় হারিয়ে গেছে জৌলুস। তবে কি ২১এর সঙ্গে আমার দুর্ব্যবহার করছি? আমিতো উপলব্ধি করেছিলাম একুশ চিরন্তন অর্থাৎ শাস্বত। আমার কল্পনা এবং লালিত স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্নের পণ্যমিয়ায় অন্ধকারে রূপান্তরিত। আমার সন্তানকে নিয়ে ফাঁকা রাজপথ চলতে চলতে বিপণী বিতানের বাঁক পর্যন্ত নীত হলাম। না, তারপরও আগেকার মতো মিছিলের সুদীর্ঘতা নেই। নেই আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো হৃদয়বিদায়ক শোকের মাতমরূপে গান। যা বাতাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতো আবেগের অসম্ভব সুর, তাল লয়ে। সে সুর রপ্ত করতে তালিম নিতে হয়নি কারো কাছে তা যেন স্বতস্ফূর্তভাবে সৃজিত। সালাম সালাম হাজার সালাম গানটা যথেষ্ট আবেগ ছিলো। সেই গানটাও শ্রæত হয়নি। সোজা হাঁটতে শাহ আমানত মার্কেট পর্যন্ত উপস্থিত হলাম। ওখানে কংক্রিট আর সিমেন্ট বালির স্তূপ। মিক্চার মেশিনের কানফাটা শব্দ। শহীদ দিবসটা যেন কাজ করার মোক্কম সুযোগ। ওখানে এককালে কবিতা আবৃত্তি হলো। আমার মেয়ে নুসরাত কবিতা আবৃত্তি করে অনেকবার পুরস্কার ও সনদপত্রে পেয়েছিলো। সম্পূর্ণ ফাঁকা। এগিয়ে চলি রাইফেল ক্লাব পর্যন্ত। এবার হালকাপাতলা কিছু লোক সমাগম। পুলিশ বাঁশের ব্যাপিকেট দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা প্রস্থানপথ, এবার মোশাফিরখানার পাশের পথ ধরে বোস ব্রাদার্স পার হয়ে থমকে দাঁড়াই। এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। তিনজন হিজরা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পরণে লালশাড়ি ওতে বটলগ্রিন পাড় ওজানো। নিখুঁতভাবে সাজগোজ করে আছে। হাতে পুষ্পস্তবক। আমি তৃতীয় লিঙ্গের অবহেলিত মানুষগুলোর সান্নিধ্যে এগিয়ে গেলাম। ভদ্র আচরণের মাধ্যমে আলাপ শুরু করলাম। ওরাও আমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে বাক্য বিনিময় করলো। হাল্কা আলাপ চারিতার মধ্যে খুব করে আপন করে নিলাম। আজকের একুশ ওদের উপস্থিতি আমার আবেগে যেন নতুন স্রোত বহমান হলো। মানুষ ওদের ঘৃন্না করে এড়িয়ে চলে কিন্তু আজকে ওদের সান্নিধ্য যেন ভিন্নমাত্রা যুক্ত হলো। এযেন সাধারণ মানুষের স্রোতধারার সঙ্গে একাকার হবার একটা ব্যর্থ প্রয়াস। ওদের বল্লাম, তোমরা দাঁড়াও। ছেলেকে বলি ওদের ক্যামরাবন্দী করো ওরা না করলে ওদের দলের অনেকে অসবার বাকী। ততক্ষণ অপেক্ষা করা সমচীন মনে না করে আবার শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে চলি। মিছিল খুব শান্ত প্রকৃতির, নেই কোন ভিড় বা ধাক্কা ধাক্কি। শহীদ বেদির একপাশে ব্যারিস্টার ইফতেখার সাহেব মাইক হাতে ধারাবিবরণী দিচ্ছেন। বিবেকবর্জিত কেউ কেউ সেন্ডেল পায়ে বেপরোয়া পদক্ষেপে শহীদবেদির দিকে এগিয়ে চলতে দেখি। আওয়ামী লীগের জনকয়েক নেতা মুজিবকোট পরে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। মুসলিমহল প্রাঙ্গণে নির্মাণ কাজ চলছে। কবিতা আবৃত্তিও দৃশ্যমান ছিলো না। প্রস্থান পথের দিকে একবুক জ্বালা ধারণ করে এগিয়ে যাই। সকালের নাস্তা হোটেলে সেরে নিলাম তারপর স্বগৃহে।
এবারকার আমেজহীন একুশের ফেব্রুয়ারি আমার কাছে কেমন জানি পানসেটে মনে হলো। তারপরও হিজরা নামক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোর উপস্থিতি এবং মাতৃভাষার জন্য শ্রদ্ধা জানানো এবারের একুশে যেন এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

লেখক : কলামিস্ট