একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত ছাড়লেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক

51

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য দেশের মানুষের কাছে ‘ক্ষমা না চাওয়ায়’ জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, যিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের আইনজীবী দলের নেতৃত্বে ছিলেন। সময়ের দাবিতে সাড়া দিয়ে ‘বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আওতায় ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে’ জামায়াতকে একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থতা নিয়েও পদত্যাগপত্রে হতাশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
রাজ্জাকের বড় ছেলে ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী জানান, শুক্রবার (গতকাল) জামায়াতের আমির মকবুল আহমদকে ওই পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন তার বাবা।
জামায়াতের একজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন, ঢাকায় তাদের আমিরের কাছে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগপত্র আসার কথা তিনিও জানতে পেরেছেন।
আব্দুর রাজ্জাকের ব্যক্তিগত সহকারী কাউসার হামিদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক দু’টি কারণ উল্লেখ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছেন। জামায়াত ৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি এবং একবিংশ শতাব্দির বাস্তবতার আলোকে এবং অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় এনে নিজেদের সংস্কার করতে পারেনি’।
লন্ডনে আইন পড়া রাজ্জাক ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে অ্যাড. হিসেবে এনরোলমেন্ট নেন। ওই সময় থেকেই তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তবে আইনজীবী হিসেবে রাজ্জাকের নাম আলোচনায় আসে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে তাদের প্রধান আইনজীবী হিসেবে আদালতে দাঁড়ান রাজ্জাক।
জ্যেষ্ঠ বদরনেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির ৫ দিন পর ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রাজ্জাক ঢাকা ছাড়েন। ব্রিটিশ নাগরিকত্বধারী এই আইনজীবী সেখান থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। এসেক্সের বারকিং থেকে ঢাকায় পাঠানো ওই পদত্যাগপত্রে রাজ্জাক জামায়াতের আমিরকে ‘পরম শ্রদ্ধেয় মকবুল ভাই’ সম্বোধন করে লিখেছেন, একাত্তরে মুক্তিদ্ধের বিরোধিতা পরবর্তীকালে ‘জামায়াতের সকল সাফল্য ও অর্জন ¤øান করে দিয়েছে’।
রাজ্জাক লিখেছেন, গত প্রায় দুই দশক তিনি জামায়াতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা ও পাকিস্তান সমর্থনের কারণ উল্লেখ করে জাতির কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত। আমি সব সময় বিশ্বাস করেছি এবং এখনও করি যে, ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে নেতিবাচক ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয় বরং তৎপরবর্তী প্রজন্মকে দায়মুক্ত করার জন্য অত্যন্ত জরুরি কর্তব্য। খবর বিডিনিউজের
রাজ্জাকের উপলব্ধি, রাজ্জাকের খেদ :
রাজ্জাক তার পদত্যাগপত্রে লিখেছেন, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের মামলা তিনি ‘সততা ও একাগ্রতার সঙ্গেই’ পরিচালনা করেছেন। আবার আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘একাত্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপলব্ধি ও মুক্তির আকঙ্খার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল বলে মনে করেন তিনি। যে কোনো রাজনৈতিক দল, ইতিহাসের কোনো এক পর্বে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ত্রুটি-বিচ্যুতির শিকার হতে পারে। কিন্তু তাকে ক্রামাগত অস্বীকার করে, সেই সিদ্ধান্ত ও তার ফলাফল মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান বজায় রাখা শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয় বরং আত্মঘাতী রাজনীতি। তা কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।’
রাজ্জাক লিখেছেন, একাত্তরের ভূমিকার জন্য ‘গ্রহণযোগ্য বক্তব্য প্রদানের ব্যর্থতা এবং ক্ষমা না চাওয়ার দায়ভার’ এখন তাদেরও নিতে হচ্ছে, যারা তখন ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িত ছিল না, এমনকি যাদের তখন জন্মও হয়নি। এই ক্রমাগত ব্যর্থতা জামায়াতকে স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসাবে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে। ফলে জামায়াত জনগণ, গণরাজনীতি এবং দেশ বিমুখ দলে পরিণত হয়েছে।
দলীয় ফোরামে কবে কখন কিভাবে তিনি এ বিষয়ে যুক্তি দিয়েছেন, তার একটি তালিকা পদত্যাগপত্রে তুলে ধরেছেন এই আইনজীবী। তিনি লিখেছেন, ‘সবশেষে, ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর জানুয়ারি মাসে জামায়াতের করণীয় সম্পর্কে আমার মতামত চাওয়া হয়। আমি যুদ্ধকালীন জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিই। অন্য কোনো বিকল্প না পেয়ে বলেছিলাম, জামায়াত বিলুপ্ত করে দিন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমার তিন দশকের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে’।
১৯৮৬ সালে জামায়াতে যোগ দেওয়ার পর দলের ভেতর থেকেই সংস্কারের চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জানিয়ে রাজ্জাক লিখেছেন, দলের কাঠামোগত সংস্কার, নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং জামায়াতের উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও কর্মসূচিতে ‘আমূল পরিবর্তন’ আনতে তার তার প্রস্তাবগুলো গত ৩০ বছরে ইতিবাচক সাড়া পায়নি। কয়েকটি দেশে ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে গঠিত মধ্যমপন্থি দলগুলো সফলতা অর্জন করেছে। এই পরিবর্তনের বাতাস যদিও এখনও বাংলাদেশের গায়ে লাগেনি, কিন্তু সময় এসেছে আমাদের পূর্বপুরুষের তৈরি ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণায় কোনো পরিবর্তন আনা যায় কি না, তা নিয়ে নতুন প্রজন্মের গভীরভাবে চিন্তা করার।
পদত্যাগপত্রে রাজ্জাক বলেছেন, অতীতে অনেকবার পদত্যাগের কথা ভাবলেও তিনি নিজেকে বিরত রেখেছেন এই ভেবে যে দলের সংস্কার করা সম্ভব হলে এবং একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত জাতির কাছে ক্ষমা চাইলে তা হবে একটি ‘ঐতিহাসিক অর্জন’। কিন্তু জানুয়ারি মাসে জামায়াতের সর্বশেষ পদক্ষেপ আমাকে হতাশ করেছে। তাই পদত্যাগ করতে বাধ্য হলাম। এখন থেকে আমি নিজস্ব পেশায় আত্মনিয়োগ করতে চাই। সেই সাথে ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি সমৃদ্ধশালী ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব।

রাজ্জাকের জন্য
জামায়াত ‘ব্যথিত
মর্মাহত’
একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে দলের অনমনীয় অবস্থানের কারণে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক পদত্যাগ করায় মনোবেদনা প্রকাশ করেছেন সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক যেখানে আর যেভাবেই থাকুন, তার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর ‘মহব্বতের সম্পর্কই’ থাকবে।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের আইনজীবী দলের নেতৃত্ব দেওয়া রাজ্জাক গতকাল শুক্রবার লন্ডন থেকে দলের আমির মকবুল আহমদের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য জামায়াতে ইসলামী জনগণের কাছে ক্ষমা না চাওয়ায় এবং একবিংশ শতাব্দির বাস্তবতার আলোকে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় এনে দলের সংস্কার করতে ব্যর্থ হওয়ায় তার পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত।
এর প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘তার পদত্যাগে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত। পদত্যাগ করা যে কোনো সদস্যের স্বীকৃত অধিকার। আমরা দোয়া করি তিনি যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন’। খবর বিডিনিউজের
লন্ডনে আইন পড়া রাজ্জাক ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে অ্যাড. হিসেবে এনরোলমেন্ট নেন। ওই সময় থেকেই তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর আইনজীবী হিসেবে রাজ্জাকের নাম আলোচনায় আসে। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে তাদের প্রধান আইনজীবী হিসেবে আদালতে দাঁড়ান রাজ্জাক।
জ্যেষ্ঠ বদরনেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির ৫ দিন পর ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রাজ্জাক ঢাকা ছাড়েন। ব্রিটিশ নাগরিকত্বধারী এই আইনজীবী এখন সেখানেই রয়েছেন। পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছেন, একাত্তরে মুক্তিদ্ধের বিরোধিতা পরবর্তীকালে জামায়াতের সকল ‘সাফল্য ও অর্জন’ ¤øান করে দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এ কারণে গত দুই দশকে বিভিন্ন সময়ে তিনি দলকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, একাত্তরের সেই ভূমিকা এবং পাকিস্তানকে সমর্থন করার কারণ ব্যাখ্যা করে জাতির কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু জামায়াত তাদের অবস্থান থেকে সরেনি।
দলের কাঠামোগত সংস্কার, নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং জামায়াতের উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও কর্মসূচিতে ‘আমূল পরিবর্তন’ আনতে রাজ্জাক যেসব প্রস্তাব গত ৩০ বছরে দিয়েছেন, সেগুলোও ইতিবাচক সাড়া পায়নি বলে পদত্যাগপাত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন।
এসব বিষয়ে কোনো জবাব জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমানের বিবৃবিতে আসেনি। তিনি লিখেছেন, ‘ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকসহ আমরা দীর্ঘদিন একই সাথে এই সংগঠনে কাজ করেছি। তিনি জামায়াতে ইসলামীর একজন সিনিয়র পর্যায়ের দায়িত্বশীল ছিলেন। তার অতীতের সকল অবদান আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। আমরা আশা করি তার সাথে আমাদের মহব্বতের সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে’।