একটি সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন

83

আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান মুসলমানরাই পেঁচা। আমাদের ঘরে জিয়াফত আমরা ক্ষুধার্ত।’ কেনই বা এমন হলো! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। হবে না কেন? আমরা পালে ফু দিই, যত গাল ফুলে, তত পাল ফুলে না। ন্যায় নীতি আদর্শের আপ্ত বাণী আমরা উচ্চারণ করি কিন্তু জীবনে প্রতিফল ঘটাই না। নসিহতের সাথে খাসিয়তের সংযোগ ঘটাতে না পারলে কোন আদর্শই সমাজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। স্বার্থপরতার পরিচয় দিতে প্রতিযোগিতায় নেমেছি। ধর্ম-কর্মে কোথাও বাদ যাচ্ছে না। নামাজ, রোজা, হজ, যাকাতের উদ্দেশ্য বেহেস্তের লোভ দোজখের ভয়। পীর আউলিয়ার দরবার মাজারে ছেলে সন্তান ধন সম্পদ অর্জন, বৈষয়িক উন্নতিই প্রধান হয়ে পড়েছে আমাদের মাঝে। আল্লাহ ও তাঁর কামিল বান্দার সন্তুষ্টি অর্জন করার মানসিকতা সৃষ্টি করতে পারিনি অথচ এটাই হওয়া উচিৎ। গজনীর বাদশাহ সুলতান মাহমুদের এক কুৎসিত বাঁদি ছিল। বাদশাহ তাকে পছন্দ করতেন বেশি। বাদশার নিকট একযোগে সকল বাঁদি-দাসীর জিজ্ঞাসা, কেন ক্ষুৎসিত বাঁদিকে বেশি পছন্দ? বাদশাহ বললেন, জবাব পাবে দুইদিন পর। বাদশাহ তাঁর ঘরে দুইদিনে সোনা, রূপা, ছান্দি টাকা সংগ্রহ করে রাখলেন এবং সকলকে ডেকে বললেন এখন আমি ঘোষণা করছি এ ঘরের সবকিছুই যে যা স্পর্শ করবে তা তার হয়ে যাবে। সকলেই ইচ্ছা অনুযায়ী সম্পদ স্পর্শ করলেন। ক্ষুৎসি বাঁদি হাত ধরলেন বাদশাহর। বাদশাহ বললেন, তোমার কি সম্পদের প্রয়োজন নেই? বাঁদি বলল, জাহপনা আপনি কোনো দিন মিথ্যা বলেননি, আজও বলছেন না, যে যা স্পর্শ করবে তা তার হলে, আমি বাদশাহ স্পর্শ করেছি ফলে বাদশাহ আমার হবে। বাদশাহ আমার হালে রাজা আমারই। আজ আমাদেরকে ক্ষুৎসিত বাঁদির মত ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিত্যাগ করে বৃহৎ স্বার্থ অর্জনের চিন্তা-চেষ্টা করতে হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলির‘ প্রথম কবিতার পংক্তি:
’আপনারে শুধু ঘিরিয়া ঘিরিয়া
ঘুরে মরি পলে পলে
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।’
আমরা নিজকে শুধু ঘিরে ঘিরে রাখছি, বিকাশ করছি না। মানুষ হলে তার মনষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে। তা না হলে পশু আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য থাকে না। সমাজে যে ভ্যবিচার অন্যায় নির্যাতন চলছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ব্যবিচার যদি শিক্ষিত লোক কর্তৃক হয়ে থাকে তা হৃদয় পীড়া দেয়। হতে হয় মর্মাহত। মেহেরপুর সদর উপজেলার বিএসসি পাস যৌতুকলোভী একবর বাজারে দাম তুলেছে একলক্ষ টাকা। বর ‘মহাশয়’ বিয়ের অনুষ্ঠানেই নগদ প্রদানের দাবি করে বসে। অন্যথায় বিয়ে ভঙ্গের হুংকার। এতে দু’পক্ষের কথা কাটাকাটি। এক পর্যায়ে ঝগড়াঝাটি-হাতাহাতির ফলে বর বিয়ের আসর ত্যাগ করে। বাংলাদেশে এ ধরনের লজ্জাজনক ঘটনা অনেক। সারাদেশে নারী নির্যাতনের প্রধান কারণ যৌতুক। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে যৌতুকের কারণে ১৯৯৭ সাল হতে ২০০৩ সালের মধ্যে নারী নির্যাতন হয়েছে ৫৮২ জন। হত্যা হয়েছে ৬৮৫। এ সংখ্যা প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যৌতুকের কারণে বছরে অসংখ্য নারী এসিডদগ্ধ হয়। দেশের সমগ্র চিত্র এই পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। যৌতুকলোভীদের হাত দিনে দিনে প্রসারিত হচ্ছে। যৌতুকের অপমানে বহু নারী আত্মহত্যা করেছে-করছে। দেশে যৌতুকবিরোধী কঠোর আইন থাকলেও প্রয়োগ কম হওয়ায় সমাজে এই ব্যাধির বিস্তার বিস্তর হচ্ছে। আইনের প্রয়োগ না থাকলে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সৎ না হলে কোন সামাজিক ব্যাধিই উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়।
যৌতুকের মত সকল সামাজিক ব্যাধির মূলোৎপাঠন করতে হলে আলেম সমাজকে সর্বপ্রথম সামাজিক আন্দোলনে এগিয়ে আসতে হবে। মসজিদে মসজিদে জুমাবারের খোৎবায়ে অবিচার-অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। আলেম সমাজ যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘোষণা করেন আজ থেকে কোন বর যৌতুক নিলে সে বিয়ে আমরা পড়াবো না। সকল বিয়ে যৌতুকবিহীন হতে বাধ্য। তাঁরা তো ঐক্যবদ্ধ হবে না। মাহাথির বিন মোহাম্মদের মতো প্রশ্ন করতে চাই, ‘আল্লাহর আইন মানুষের ব্যাখ্যার কারণে কি এতো বিভক্তি? পাকিস্তানের এক সময়কার প্রধান বিচারপতি মুনির বিখ্যাত এগারজন আলেম ডেকে পৃথক পৃথক সকলেরই নিকট একটি প্রশ্ন করেছিলেন। প্রশ্নটি হল ইসলামের সংজ্ঞা কি? প্রশ্ন একটি হলেও এগার আলেম এগার সংজ্ঞা দিয়েছিলেন।
আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘ওয়াতাসিমু বিহাবলিল্লাহে জামিয়া ওয়ালা তাফাররাকু,’ অর্থাৎ তোমরা আল্লাহ রুজ্জুকে আকড়িয়ে ধর পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। ভ,ই, লেনিন বলেছেন, ‘ঐক্যবদ্ধ জনতা এটম বোমার চেয়ে শক্তিশালী।’ কবি হেলাল হাফিজ তাঁর ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের ছোট এক পঙক্তির একটি কবিতা, ‘এটম বুঝ/মানুষ বুঝ না।/মানুষের কি প্রচÐ শক্তি তা বুঝিয়ে দেওয়ার সময় মুসলমানদের এখনই। আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘এটম বোম হচ্ছে নাডর হামকো হামারে নারায়ে তাকবির, যাঁহা যাঁউ ওঁয়াহা ছুউনু হামারে নারায়ে তাকবির।‘ আমরা তো এটম বোমাকে ভয় না পাওয়ার জাতি। আমাদের মাঝে বিভক্তির কারণেই এতো ভয়। ধর্মীয় একদল আরেক দলকে কাফির বলছি। যদি একদল সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে বাকীরা কাফিরই হয় তাহলে বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র হয় কিভাবে?
সম্মুখে দেয়াল আর দেয়াল, বিভক্তির পর বিভক্তির কারণে সারা বিশ্বের মুসলমান সমাজ নির্যাতিত-নিষ্পেষিত নিপীড়িত। বিশ্বের জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ মুসলমান। সকলে একযোগে দাঁড়িয়ে ইসরাঈল ইহুদীদের ওপর প্রশ্রাব করলে ইহুদীরা ভেসে যেত। আমাদের বিচ্ছিন্নতার সুযোগ তো তারা নিবেই। ঐক্যবদ্ধ হতে আমরা অক্ষম। তাদের শুধু গালমন্দ করে গাল নষ্টে লাভ কি?
ডা: মাহাথির মোহাম্মদ মুসলিম বিশ্বে অবিচার বন্ধ না করলে একযোগে তেল অবরোধের আহŸান জানিয়ে ছিলেন। ক্ষমতার অন্ধলোভে কেউ তাঁর আহব্বানে কর্ণপাত করেন নি। সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে বহু যুগ, বহু শতক ক্ষেসারত দিতে হবে। ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তানের নবজাতক শিশুদের মত আরো অনেক মুসলিম রাষ্ট্রের অনাগত শিশুরাও বুলেট বোমার শব্দ শুনে পৃথিবীতে চক্ষু উন্মোচন করবে। যুদ্ধের সাথে বসবাস করে যদি শান্তির সাক্ষাৎ না মিলে তাহলে হিটলারের মত বলবে কি ‘যুদ্ধই শান্তি’।
এখানে আমি ‘কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের’ ‘দুঃখের তুলনা’ কবিতাটির কয়েক চরণ উচ্চারণের লোভ সামলাতে পারছি না।
‘একদা ছিল না জুতো চরণ যুগলে
দহিল হৃদয় মোর সেই ক্ষোভানলে,
ধীরে ধীরে চুপি চুপি দুঃখাকুল মনে
গেলাম ভজনালয়ে ভজন কারণে।
সেথা দেখি একজন পদ নাহি তার,
অমনি জুতোর খেদ ঘুচিল আমার।’
পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন আপন অভাব-ক্ষোভ রহে কতক্ষণ?
বিশ্বের মুসলমানদের চেয়ে বর্তমান খারাপ অবস্থায় কোন জাতি আছে কি, যাদের দেখে আমাদের খেদ ও ক্ষোভ নিবারণ হবে?

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক