একটি বাবা গাছ…

98

‘মলি, এই মলি। কোথায় গেলি হারামজাদি?’
রান্নাঘর থেকে মা ডাকছেন। দক্ষিণের এই ঘর থেকে সেই ডাক ¯পষ্ট শোনা যায়। কিন্তু সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার ইচ্ছেটাকে কোনোমতেও জাগাতে পারছি না। মাঝেমধ্যে এসব ভ্যানতাড়া গোছের ডাককে অগ্রাহ্য করতে হয়। না হলে জীবনটা একেবারে তেজপাতা। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন মা ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি টের পাইনি। একেবারে যে দেখতে পাইনি তা নয়। জানালার বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম, একটা আবছা ছায়া…তারপরেই হুংকার:
‘কী রে সেই কখন থেকে ডাকছি। আমার কথা কি কানে যায় না?’
‘মা আমি শুনতে পাইনি।’
আমার উত্তর শুনে মা কথার খেই হারিয়ে ফেললেন। অতিরিক্ত রাগে তার এমন অবস্থা হয়। তিনি রাগে গজগজ করতে করতে আবার রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। আমি পুনরায় নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে ডুবে গেলাম বাইরের মনোরম দৃশ্যে। সকালের এক চিলতে রোদ বড় বড় বৃক্ষগুলোকে ডিঙিয়ে উঠোনে খেলা করছে। এই বাগানের একেবারে শেষ সীমায় একটি বিশাল আম গাছ আছে। বাবা নিজ হাতে গাছটি রোপণ করেছিলেন বলে আমি একে বাবা গাছ বলে ডাকি। যখন খুব মন খারাপ হয় তখন বাবা গাছের সঙ্গে সুখ-দুঃখের আলাপ করি। সেসব কথায় তিনি বরাবর চুপ থাকেন। আসলে আমার দুঃখের কথা শুনে তার এত কষ্ট হয় যে শব্দমালা হারিয়ে যায়। সেই বোবা বাবার সঙ্গটা দিনদিন খুব প্রিয় হয়ে উঠছে।
আমাদের সংসারে চারটি মানুষ। আমি, কলি, স্বপ্না আর মা। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি, মা নিজ হাতে শতছিন্ন সংসারটাকে আগলে রেখেছেন। গ্রীষ্মের আগুন ঝরা দিনে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করেছেন। শীতের রাতে শরীরের উষ্ণতা দিয়েছেন। এই করতে করতে মায়ের কালো চুলগুলোতে কখন যেন সাদা কাশফুলের রঙ লেগেছে। সেসব উস্কুখুস্কু চুল একটু সুযোগ পেলে বাতাসে ওড়ে। চুলের এরকম উত্থানপতনে আমার মনের ভেতর এক ধরনের বুনো হাহাকার তৈরি হয়। ইস! আমাদের মানুষ করতে যেয়ে মা অকালে বৃদ্ধ হয়ে গেলেন। এসব ভাবলে নিজেকে খুব দোষি মনে হয়। আর এমন বোধগম্যতা সৃষ্টির পর থেকে মায়ের কটু কথাবার্তাতে তেমন রাগ হয় না। অভিমান যে হয় না তা নয়। কিন্তু সেই অভিমান বেশিক্ষণ টিকে থাকে না। মনে হয়, আজ বাদে কাল স্বপ্নার বিয়ে। তারপর তো এই কালো মেয়েটিই সব। সেসময় কি তিনি অমন রুক্ষতা দেখাতে পারবেন?
আজকাল ছোট বোনটা কেমন জানি পর হয়ে যাচ্ছে। বেশি কথা বলে না। যাও বা বলে সেসব কতাবার্তা খুব দায়সারা গোছের। আমি পরিস্থিতি সামাল দিতে হাতিঘোড়া অনেক কথা বলে যাই। একসময় তাকিয়ে দেখি, স্বপ্না পাশে নেই কিংবা ঘুমিয়ে পড়েছে। এক সাগর গভীর সৌন্দর্য নিয়ে ও ঘুমিয়ে থাকে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি আর ভাবি, যদি ঐ সৌন্দর্যের একফোঁটা অংশীদার হতাম তবে কি আর সবাই এভাবে এড়িয়ে যেতে পারত! কলি আর স্বপ্নার গায়ের রঙে দাদা নাকি মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, আল্লাহ নিজ হাতে বানাইছেন। আসলেও ওরা সুন্দর। ওদের সৌন্দর্য দেখে কেউ প্রশংসা করলে, আমার দুঃখ হয় না। তবে কালো বর্ণের কাছে মনের সৌন্দর্য অবহেলিত হলে কষ্ট হয়। বুকের কোথায় যেন থরথর করে ক¤পন ওঠে। সেই ক¤পন সহজে থামতে চায় না।
বিয়ের পর থেকে কলি বদলে গেছে। এখন আর আগের মত এ বাড়িতে আসে না। আসলে ও আমাকে এড়িয়ে যায়। এই এড়িয়ে যাওয়াকে মাঝে মধ্যে ভ্রম বলে মনে হয়। অথচ একসময় আমাদের খুব ভাব ছিল। একজন আরেকজনকে কোন কথা না বলে থাকতে পারতাম না। এভাবেই বোধহয় মানুষ পাল্টে যায়। আজকাল স্বপ্নাও বদলে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের হাওয়া শুধু রাস্তাঘাট, পোষাক পরিচ্ছদে এসেছে তা নয়। মানুষের চালচলনেও পরিবর্তন সমানভাবে বিদ্যমান। শহর যেন অজগর সাপ, ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছে গ্রামকে। এই দখলদারিত্ব থেকে গ্রামের সবুজ এমনকি আপন মানুষেরাও বাদ যাচ্ছে না। শুধু মা‘ই যা অপরিবর্তিত।
সেই বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখছি, মরিচের মত ঝাঁজ। অথচ কলি কিংবা স্বপ্নার ক্ষেত্রে তেমন নয়। এ নিয়ে মন খারাপ হলে বাবা বলতেন, মায়ের কথাতে মন খারাপ করতে নেই। একদিন বাবা নীরবে চলে গেলেন। কলি তখন সাত কি আট বছরের। আর স্বপ্নার পাঁচ। বাবার শূন্যস্থান একসময় দখল করে নেয় কলি। সেই সুখে তৃপ্ত হতে না হতে মেঝো বোনের প্রস্থান। তখন দৃশ্যপটে আগমন ঘটে স্বপ্নার। স্বপ্নাকে দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ হওয়াতে কলির দেওয়া কোন অপমানকে কষ্টকর মনে হয়নি। এই গত মাস থেকে স্বপ্নার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। তখন থেকে স্বপ্নাও যেন একটু একটু দূরে সরে যাচ্ছে। এতদিনকার সব কষ্ট পরিণত হয়েছে যন্ত্রণায়। আর ওদের সবার ক্ষতস্থান গ্রাস করে নিচ্ছে একটা বাবা গাছ। বিকেলের দিকে ছেলেপক্ষ আসার কথা। সম্ভবত আজকে স্বপ্নার বিয়ে হয়ে যাবে। আমাকে কেউ এসব কথা জানায়নি। তবে সব আয়োজন আমার আন্দাজকেই সমর্থন করছে। বাড়ি ভর্তি অতিথি। রান্নার সুগন্ধ। এরই এক ফাঁকে মামী এলেন। আমাকে কাছে ডাকলেন। অন্যান্যবারের মত বসতে বললেন না।
‘কিছু বলবা মামী?’
‘বাড়িতে মেহমান আসবো। আইজ তুই তোর ঘর থিকা বাইর হইস না। আগের দুই দুইডা বিয়া তর জন্য ভাইঙ্গা গেছে।’
আমি খেয়াল করলাম, আজ মামী আর কোনো রাখঢাক রেখে কথা বলছেন না। সম্ভবত গত দুইবারের ঘটনায় সবার চোখের লাজলজ্জা উঠে গেছে। হয়তো এ কারণেই স্বপ্নাও এড়িয়ে চলে। মামীর কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি কোনো উত্তর দিলাম না। ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলাম। মামীর প্রস্থানের পর পর টের পেলাম, কলি এসেছে। ওর কোলে দুই বছরের মেয়ে। ওদের কথাবার্তার শব্দ রান্নাঘর ছাপিয়ে এ ঘরেও আসছে। রূপার গুটিগুটি পায়ের নূপুরের শব্দ যেন নদীর কলকল ধ্বনি। আমার ছোটবেলায় খুব সখ হতো, নূপুরের। কিন্তু অভাবের সংসার। অনেক সখের মত এই ইচ্ছেতেও রঙ লাগেনি। মামারা পাশে না দাঁড়ালে হয়তো এতদিনে রাস্তায় নামতে হত। আজ বোধহয় সেই দাবিতেই মামী এমনভাবে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করলেন। এখানে মামী কিংবা মায়ের কোন দোষ নেই। আমার রঙটাই তো চ‚ড়ান্ত সর্বনাশ করেছে। জানালার ওপাশে সন্ধ্যা নামছে। ঘন দুর্ভেদ্য সন্ধ্যা। কেউ যেন দোয়াতের কালি উপুড় করে দিয়েছে। উঠোন জুড়ে স্বপ্নার হাসি। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ। রূপার নূপুর। আর একটু সময়। তারপর অনেক কথা হবে বাবা গাছের সাথে। অনেক দিনের অপমান দুঃখ কষ্ট বাবাকে বলতে না পারলে শান্তি নেই। বাবা একটু অপেক্ষা কর। আমি আসছি।