একটাই পথ সতর্কতা

42

মীর আব্দুল আলীম

আমারা সতর্ক নই বললেই চলে। হাটবাজার পুরোদমে জমছে। গার্মেন্টস, কলকারখানাও জমজমাট। শ্রমিকদের বেতন-ভাতার আন্দোলনও চলছে। মসজিদে, মন্দিরে মানুষ। জনসমাগম সবখানেই হচ্ছে। আগের চেয়ে বাজারে এখন বেশি মানুষ। মানুষের হুশ নেই। টাটকা তরিতরকারী, মাছ, মাংস কিনতে মানুষ বাজারে ছুটছেতো ছুটছেই।
চায়ের দোকানের আড্ডাও বেশ জমছে। লোকজড়ো করে দান-খয়রাত ফটোসেশন কোনটাই বন্ধ নেই। অন্ধ মানুষ, বন্ধ বিবেক। পত্রপত্রিকায় দেখছি কর্মহীন মানুষ কোথাও কোথাও খোলা মাঠে জুয়ার আড্ডায়ও মাতছে। মোটকথায় মানুষ যেন আগের চেয়ে বেশ সচল। হাস্যকর লকডাউন আর কোয়ারেন্টাইন চলছে। লকডাউনে মানুষ এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাচ্ছে। পঙ্গপালেরর মতো ট্রাক আর কাভার্ডভ্যানে মানুষ ঢাকায় আসছে। আমরা কতইনা অসভ্য। অসচেতন আর কাকে বলে? যেদেশে জেল জরিমানা দিয়ে মানুষ বশ করা যায়না, সেখানে স্বেচ্ছায় বাসগৃহের কোয়ারেন্টিনের কথা শুনি। করোনাভাইরাস নেগেটিভ আর পজেটিভের দৌড়ঝাঁপ মুখের কথায় বন্ধ করা অন্তত এদেশে অসম্ভব।
ঢাকা শহরেতো ক’দিন ফাঁকা ছিলো। যানজট ছিলো না। এখন কোথাও কোথাও আবার ট্রাফিক জ্যাম শুরু হয়েছে। হোটেল রেস্তোরাগুলো রমজানকে ঘিরে খুলেছে। শুনছি সুপার মার্কেট গুলোও নাকি খোলার পাঁয়তারা হচ্ছে। দু’একের মধ্যে খুলে যাবে হয়তো। সারা বিশ্ব যেখানে সতর্ক সেখানে আমাদের দেশে সবকিছু অনেকটা স্বাভাবিক। পরে হয়তো বুঝতে পারব কতটা ক্ষতি হলো আমাদের। আল্লাহ মাফ করুক। একটা কথা মনে রাখতে হবে সার্স, ডেঙ্গু বা ইবোলার মতো নানা ধরনের প্রাণঘাতী ভাইরাসের খবর মাঝে মাঝেই সংবাদ মাধ্যমে আসে। এমন মহাবিপদ থেকে আল্লাহ আমাদের উদ্ধারও করেন। ইসলাম ধর্মে এসব রোগ-বালাইয়ের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। আল-কোরআনে মহামারী হলে যেযার স্থানে থাকার কথা বলা আছে। অন্য ধর্মেও রোগের ক্ষেত্রে সতর্ক করা আছে। প্রয়োজন না হলে ক’দিন নিজের জন্য; পরিবারের জন্য; অন্যের জন্য ঘর থেকে বাহিরে না যাওয়াই ভালো। প্রয়োজন থাকলে কি আর করা। আল্লাহ ভরসা। মনে রাখবেন এ সমস্যা কিন্তু অনেক দিন ধরেই থাকবে না। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেনই। কিছুদিন যারা সতর্ক থাকতে পারবেন, সবকিছু ঠিকঠাক মেনে চলবেন তারা হয়তো এ বিপদ থেকে অনেকটা মুক্ত থাকতে পারবেন। তবে আমরা বেশিই অসাবধান মনে হয়। কোন কিছুকেই গুরুত্ব দিতে চাইনা কখনো। কোন কিছু মানতে চাইনা। এ অবস্থায় আল্লাহ কি আমাদের রক্ষা করবেন? আগুনে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচতে চাইলে কি হবে?
বিশ^জুড়েই এখন করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। করোনার ছোবল বাংলাদেশেও। যখন লিখছি তখন পর্যন্ত এদেশে করোনাভাইরাস মোট আক্রান্ত ৬,৪৬২ জন, মারা গেছেন ১৫৫ এবং এ পর্যন্ত সুস্থ্য হয়েছেন ১৩৯ জন। এটা সরকারি হিসাব। সরকারি হিসাবের বাহিরেও করোনা উপসর্গ নিয়ে অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত এবং মারা গেছেন। গত ২৮ এপ্রিল একটি উদাহরনই যথেষ্ট হবে মনে করি নারায়ণগঞ্জে ১৬০ জনের করোনা টেষ্ট করা হয়েছে এর মধ্যে ১৫০ জন নাকি আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তের ভয়াবহতা নিশ্চয় বুঝতে বাকি নেই পাঠক। পরীক্ষা করলে আক্রান্তের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে।
করোনায় করুণা করছে না কাউকে। সবচেয়ে ধনি দেশগুলো করোনায় কুপকাত। উন্নত প্রযুক্তি, গবেষণা, কোনটাই কাজে আসছে না। মানুষ মরছে প্রতিদিন। আমাদের আরও প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা কতটা প্রস্তুত? আর কতটা শতর্ক? শতর্কতা খুবই কম। মানুষ কথা শুনতেই চায় না। সরকারের নিয়মের তোয়াক্কা করে না। রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রীক প্রস্তুতি থাকলেও জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ে প্রস্তুতি খুব কম। আমাদের জনবল খুব কম। সরঞ্জামও কম। করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে তাতে সামাল দেয়া কঠিনই হবে। এখনই তা হচ্ছে। সতর্কতার অভাবে করোনাভাইরাসে সারাদেশে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে প্রায় দুই শতাধিক ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন।
দিনদিন বাড়ছে করোনাভাইরাসে চিকিৎসক আক্রান্তের সংখ্যা। দেশে চিকিৎসক মারা যাবার ঘটনাও ঘটছে। অরক্ষিত অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন হলো এভাবে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হলে রোগীদের কি হবে? হয়তো সামনে সুসংবাদ নেই। ভয়াবহ দিন আসছে। আক্রান্ত এবং মৃত্যুও মিছিলে অসংখ্য মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এসময় সৃষ্টিকর্তার পর চিকিৎসকদেরই দরকার। তাই আগে চিকিৎসকদের বাঁচান। চিকিৎসক বেঁচে থাকলে রোগীদের বাঁচানো যাবে।
মানসম্মত এবং সময় মতো সুরক্ষা পোশাক (পিপিই) পায়নি আমাদের চিকিৎসকরা। শুরুতেই এ বিষয় নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসকদের যে পিপিই দেয়া হচ্ছে তা মানসম্মত নয়। চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে; চিকিৎসক, নার্স অসুস্থ হয়ে পরলে করোনাভাইরাস চিকিৎসাসহ সাধারণ চিকিৎসায় সংকট তৈরি হবে। চিকিৎসক বাঁচলেইতো রোগীদের বাঁচানো যাবে। আগে চিকিৎসকদের পূর্ণ সুরক্ষা দরকার। তাঁরা সুস্থ থাকলে, তাঁদের মনোবল ঠিকঠাক থাকলে রোগীদের পূর্ণ চিকিৎসা মিলবে, তা নাহলে নয়। করোনাভাইরাসের রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে দিনদিন যেভাবে যদি চিকিৎসকরাই আক্রান্ত হয়ে পড়েন তাতে চিকিৎসকসমাজে আতংক তৈরি হয় বৈকি! ইতোমধ্যে হয়েছেও তা। সেকারনে চিকিৎসকদের সাথে জনগণ এবং সরকারে ভুলবুঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ না করায় এবং মন্ত্রণালয়ের নানা গাফিলতির কারণে চিকিৎসাসেবায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। তারা মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেক বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে এখন হতাশা বিরাজ করছে। শুধু তাই না সুরক্ষা পোশাক না দিয়ে উল্টো হুমকি দেয়ার কারণে অনেকের মনবল ভেঙে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখন গতি দিয়েও তা চাঙ্গা হচ্ছে না। বিষয়টি যথেষ্ট ভাবনার বটে! এই দুঃসময়ে সৃষ্টিকর্তার পরে চিকিৎসকরাই কিন্তু আমাদের ভরসা। তাঁদের চটিয়ে দিলে; জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলে, সর্বোপরি তাঁদের সুরক্ষা না দিলে কাজে মন বসবে কি করে? আমাদের জনগণও বড় অসচেতন। করোনা ছড়িয়ে পরতে শুরু করেছে। হয়তো সর্বনাশ হতে বাকি থাকবে না।
করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের যুদ্ধে নামতে হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। ঘুরতে না যাওয়ার, বেশি মানুষ এক জায়গায় না হওয়ার, চায়ের দোকান, বেশি বেশি বাজার করা, আড্ডাবাজি বন্ধ করতে হবে। করোনা নামক শত্রæ এদেশে ঢুকে পরেছে। সবাই সতর্কতার যুদ্ধে ঝাপিয়ে না পরলে আমরা হয়তো এ যুদ্ধে হেরে যাব। আসুন সবাই সতর্ক হই। যেহেতু করোনার ঔষধ এখনো আবিষ্কার হয়নি সেজন্য সতর্কতার বিকল্প নাই। এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। যুদ্ধ জয়ের জন্য আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হলে চলবে না। দিশেহারা হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। করোনা পজেটিভ কিংবা উপসর্গ হলেই ভয়ে কুকড়ে মুকড়ে যাবেন না। করোনা পজেটিভ মানেই মৃত্যু নয়। আপনি নিয়মকানুন মেনে চললে ঠিকই সেরে উঠবেন। অসংখ্য আক্রান্তের মধ্যে ২/১ জন মরছে আমাদের দেশে। খেয়াল রাখতে হবে এ ২/১ জনের মধ্যে আপনি যেন তা না হন। নিয়ম মানুন করোনা ভাইরাসকে দূরে ঠেলে দিন। সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করার পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিকভাবে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সর্বদা বজায় রাখতে হবে। নিজে সতর্ক থাকতে হবে অপরকে সতর্ক করতে হবে। মনে রাখবেন ভাইরাস থেকে রক্ষার একটাই পথ সতর্কতা। সব ভয়কেই দূরে সরিয়ে নির্ভয়ে, নিরাপদে থেকে নিজেরা যেমন নিজেদের রক্ষা করবো; সেসঙ্গে বাংলাদেশর অর্থরনীতির পঙ্গু হতে দেবনা আমরা।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক