একজন ব্যতিক্রমী রাজনীতিকের অশ্রুসজল বিদায়

47

দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে বিদেশ-বিভূঁইয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জননন্দিত রাজনীতিক জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শেষতক দেশের মাটিতে ফিরলেন কফিনবন্দি হয়ে। গতকাল রবিবার সকালে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কান্ডারী ও ব্যতিক্রমী এই রাজনীতিবিদকে অশ্রুসজল চোখে চিরবিদায় জানালেন তার সহকর্মীরা। আদর্শে অবিচল এবং লোভ ও মোহত্যাগী হিসেবে সবশ্রেণি ও মতের মানুষের কাছে সমান গ্রহণযোগ্যতা অর্জনকারী দেশের রাজনীতির এই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে আজীবন স্মরণে রাখবে বাঙালি জাতি। অনুকরণ ও অনুসরণের আলোচনায় চিরকাল ধ্বনিত হবে সৈয়দ আশরাফের নাম।
দেশের ইতিহাসে কেবল নীতি-আদর্শ কিংবা নির্লোভ-ত্যাগী রাজনীতিবিদ হিসেবেই নয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ও চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফ নানাদিক থেকেই ব্যতিক্রমী ছিলেন। একাত্তরের রণাঙ্গনে মুজিব বাহিনীর অকুতোভয় এই যোদ্ধার কঠিন ও বিরুদ্ধ পরিবেশে দেশত্যাগ থেকে শুরু করে বিদেশের মাটিতে নির্বাসিত জীবনযাপন, সেখানেই ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া, দেশে রাজনীতির ‘দুঃসময়’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বহুল আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনে আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত কান্ডারীর দায়িত্ব পালনের মত দুর্লভ ও বিরল অভিজ্ঞতা খুবই কম রাজনীতিকের ভাগ্যেই জোটে বৈকি! আবার দেশে নির্বাচিত কোনো সরকারের মন্ত্রিসভায় জনপ্রশাসন মন্ত্রী হিসেবে সৈয়দ আশরাফের নিয়োগও ছিল ব্যতিক্রম। এলজিআরডি মন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকটা হঠাৎ করেই তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। তার আগে প্রতিটি সরকারের মন্ত্রিসভা গঠন ও দপ্তর বণ্টন শেষে রাষ্ট্রের অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বরাবরই প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতেই রেখেছেন।
এর আগে ৬৭ বছর বয়সী সৈয়দ আশরাফ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেখানে থেকেই সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে এমপি নির্বাচত হওয়া সৈয়দ আশরাফ শপথ নেওয়ার জন্য সময় চেয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই সংসদ ভবনের প্রাঙ্গণে তিনি এলেন, কফিনবন্দি হয়ে।
কয়েক মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যু হয় তার। শনিবার সন্ধ্যায় সৈয়দ আশরাফের মরদেহ দেশে নিয়ে আনার পর গতকাল রোববার সকাল ১০টার দিকে নেওয়া হয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়। সেখানে জাতীয় ও দলীয় পতাকায় মোড়া কফিনে ফুল দিয়ে এই আওয়ামী লীগ নেতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের হাজারো নেতাকর্মী আশরাফের জানাজায় অংশ নিয়ে স্মরণ করেন তাদের ‘দুঃসময়ের কান্ডারীকে’। সততা, নির্লোভ মানসিকতা আর রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া আশরাফ শেষযাত্রায় শ্রদ্ধা পেয়েছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছ থেকেও।
শেষ বিদায়ের আগে একাত্তরের রণাঙ্গনে মুজিব বাহিনীর এই যোদ্ধার প্রতি ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয় রাষ্ট্রীয় সম্মান।
সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জানাজার পর হেলিকপ্টারে করে সৈয়দ আশরাফের মরদেহ নেওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। সেখানে পুরাতন স্টেডিয়াম মাঠে বেলা ১২টায় তার জানাজা সম্পন্ন হয়।
এরপর দুপুর ২টায় ময়মনসিংহের আঞ্জুমান ঈদগাঁ মাঠে আরেক দফা জানাজার পর আশরাফের মরদেহ ঢাকায় এনে আসরের নামাজের পর বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফকে।
জানাজায় মানুষের ঢল
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীতে থাকা সৈয়দ আশরাফকে কিশোরগঞ্জের মানুষ তাদের জনপ্রতিনিধি করে সংসদে পাঠিয়েছে পাঁচবার। তার জানাজায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ছিলো পরিপূর্ণ।
সংসদ প্লাজায় এমপি বা সাবেক এমপিদের জানাজায় সাধারণ যত মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়, সৈয়দ আশরাফের জানাজায় উপস্থিতি ছিল কয়েক গুণ বেশি।
দক্ষিণ প্লাজার ওপরের চত্বর পূর্ণ হয়ে সিঁড়ি এবং সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে জানাজায় অংশ নেন কয়েক হাজার মানুষ। মানুষের এই ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।
সকাল সাড়ের ১০টার কিছু আগে সৈয়দ আশরাফের কফিন সংসদ চত্বরে আনার পর একাত্তরের এই মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এ সময় বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর।
পরে আশরাফের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
পরে জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে দলের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী আশরাফের প্রতি শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
সংসদ সচিবালয় জামে মসজিদের ইমাম আবু রায়হানের পরিচালনায় জানাজা ও মোনাজাত শেষে সৈয়দ আশরাফের মরদেহে শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
জানাজার আগে সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন আশরাফের ছোট ভাই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের মধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম উপস্থিত ছিলেন জানাজায়।
এসেছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সংসদ সদস্য আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, ইলিয়াস মোল্লাহ, আসলামুল হক ও সাদেক খান।
মন্ত্রিসভার সদস্য ও সংসদ সদস্য ছাড়াও প্রদানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, বেসামরিক-সামরিক কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেন সৈয়দ আশরাফের জানাজায়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা নিহত হওয়ার পর বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে আশরাফ। লন্ডনে নির্বাসিত জীবনে প্রবাসে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন তিনি।
দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আশরাফ। এরপর ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে পুনঃনির্বাচিত হন।
গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে তিনি নির্বাচিত হন হাসপাতালে থেকেই। বৃহস্পতিবার নতুন সংসদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানে আসতে না পারায় সময় চেয়ে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছিলেন আশরাফ। সেদিন রাতেই ব্যাংকক থেকে তার মৃত্যু সংবাদ আসে।