একজন পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান

119

আওয়ামী লীগে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। বাবু ভাই (আখতারুজ্জামান চৌধুরী), ইসহাক দা (ইসহাক মিয়া), মহিউদ্দিন ভাই-এক একটি মহীরুহের পতন- তাতে আমাদের হৃদয়ে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে, সেই ক্ষত থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত ঝরছে তো ঝরছেই। সেই রক্তক্ষরণ বন্ধ হবার আগেই আর একটি নক্ষত্রের পতন নুরুল আলম চৌধুরী নেই। নুরুল আলম চৌধুরীর পরিচিতি তাঁর মৃত্যু সংবাদের সঙ্গে যা ছাপা হয়েছে পত্র-পত্রিকায়, তিনি তার চেয়েও বড় মানুষ ও নেতা ছিলেন। আমার তো মনে হয় তিনিই ফটিকছড়ির সবচেয়ে বড় নেতা ছিলেন।
ফটিকছড়ি বেশ বড়ো থানা। তন্মধ্যে বেশ খানিকটা পার্বত্য এলাকা, চা বাগানের জন্য আদর্শ প্রকৃতি, যে কারণে চট্টগ্রামের সব চা বাগান ফটিকছড়িতেই গড়ে উঠেছে। পাকিস্তান আমলের সর্বশেষ নির্বাচনেও ফটিকছড়ি ছিলো প্রাদেশিক পরিষদভুক্ত একটি আসন। জাতীয় পরিষদে মিরসরাইকে নিয়ে ফটিকছড়ি ছিলো একটি সংসদীয় আসন (এমএনএ)। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুই ৩০০ আসনের পার্লামেন্ট করে সব প্রাদেশিক পরিষদের সঙ্গে ফটিকছড়িকেও একটি স্বতন্ত্র, সম্পূর্ণ সংসদীয় আসনের মর্যাদা দেন। ১৯৭৩ সালে ৩০০ আসনের পার্লামেন্টের প্রথম নির্বাচনে ফটিকছড়ি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নুরুল আলম চৌধুরী। সত্তরের মনোনয়নে জহুর আহমদ চৌধুরীর হাত থাকলে হয়তো সেবারও তিনিই ফটিকছড়ি থেকে মনোনয়ন পেতেন।
আবদুল বারী চৌধুরী, আদালত খান প্রমুখ প্রবাদ পুরুষ ফটিকছড়িতে জন্মগ্রহণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করলেও রাজনীতির বিকাশের ফটিকছড়ি জন্য খুব উর্বর জনপদ ছিলো না। ব্রিটিশ বিরোধীতে, পাকিস্তান বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম-এই দুই পর্যায়ে ফটিকছড়িতে যে রাজনীতির বিকাশ হয়েছে, তাতে যে ক’জন রাজনীতিকের দেখা পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন কমরেড নগেন দে, কমরেড যশোদা চক্রবর্তী, বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের নেতা চিত্ত বিশ্বাস, মির্জা আবু আহমদ, উকিল আফছার উদ্দিন, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ লোকমান, অ্যাডভোকেট এ কে এম এমদাদুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট অধ্যাপক শফিউল আলম, নুরুল আলম চৌধুরী, মির্জা আবু মনসুর, রফিকুল আনোয়ার প্রমুখ।
আদালত খান, আবু তালেব চৌধুরী, সুন্দরপুরের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান এরাও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিখ্যাত মানুষ। কিন্তু তাঁরা রাজনীতির চেয়েও সমাজ সেবায় অবদানের জন্য বেশি স্মরণীয়। বাদশা আলম, এস এম ফারুক, আফতাবউদ্দিন চৌধুরী স্থানীয় পর্যায়ের তিনজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা, ১৯৫৪ নির্বাচনে ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী আসনে যুক্তফ্রন্ট থেকে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন নেজামে ইসলামের মাওলানা ওবায়দুল আকবর। কিন্তু তিনি ছিলেন হাটহাজারীর মন্দাকিনি গ্রামের বাসিন্দা।
ফটিকছড়ির রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই ইতিবৃত্ত যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে বোধ হয় সেইফলি বলা যায়, নুরুল আলম চৌধুরীই ফটিকছড়ির বেস্ট পলিটিক্যাল লিডার প্রডিউস্ড এভার। তাঁর মতো বর্ণাঢ্য ও আকর্ষক রাজনৈতিক চরিত্রও আর দ্বিতীয়টি চট্টগ্রামে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, ১৯৭৩ ও ১৯৮৬ সালে দু’দফা জাতীয় সংসদের সদস্য এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে তিনি বিভিন্ন সময়ে সরকারি দায়িত্বও পালন করেছেন সফলতার সাথে। তিনি ওমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রূপালী ব্যাংকের পরিচালক ও বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দক্ষতার সাথে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিনেটের সদস্য ছিলেন। সেবারের নির্বাচনে তাঁদের প্যানেলের পক্ষে আমি কাজ করেছিলাম এবং সেই সময় তাঁকে অভিজাত স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের অধিকারী রুচিশীল ও সুরসিক মানুষ হিসেবে পেয়েছিলাম। মৃত্যুর পূর্বেও তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট ফোরামের চেয়ারম্যান ছিলেন।
নুরুল আলম চৌধুরী একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ৬ দফা আন্দোলনে তিনি গৌরবময় ভ‚মিকা পালন করেন। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে তিনি অন্যতম শীর্ষ ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে নিবিড়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি নিজে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ত্রিপুরার লেম্বুছড়া প্রশিক্ষণ শিবিরে তিনি এবং ইদ্রিস আলম স্টেনগান, রাইফেল, বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকের ব্যঙ্কার, হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এসব ব্যাপারে হাতে কলমে পরীক্ষা দেন। যে পরীক্ষায় ইদরিস আলম প্রথম এবং নুরুল আলম চৌধুরী দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। তাঁদের পর্যায়ের আর কোন নেতা এমনি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন কিনা জানি না।
নুরুল আলম চৌধুরী ১৯৪৫ সালের ২১ মে ফটিকছড়ি থানার চাড়ালিয়া হাট ইউনিয়নের গোপালঘাটা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলহাজ মতিউর রহমান চৌধুরী, মাতার নাম ওয়াজ্জন্নেসা। তাঁরা চার ভাই সকলেই উচ্চ শিক্ষিত। ভ্রাতাদের মধ্যে প্রথম আহমদ কবির চৌধুরী ছিলেন প্রসিদ্ধ বীমাবিদ, দ্বিতীয় আহমদ দবীর চৌধুরী ছিলেন নামকরা ডাক্তার, তৃতীয় মাহবুবুল আলম চৌধুরী ছিলেন বিদেশি ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত, চতুর্থ নুরুল আলম চৌধুরী। মাতৃক‚লে নুরুল আলম চৌধুরী আদালত খানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।
নুরুল আলম চৌধুরী ষাটের দশকের একজন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ছিলেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক অবস্থান খুব শক্তিশালী ছিলো না। ছাত্র ইউনিয়ন ছিলো তখন সবচেয়ে সংগঠিত ও শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন। ভালো ছাত্ররাও ছাত্র ইউনিয়ন করতো, এমনকি ছাত্র শক্তিরও তখন বেশ প্রভাব ছিলো। এ অবস্থায় ফেরদৌস কোরেশী, শহীদ মুরিদুল আলম, এম এ মান্নান, আবু ছালেহ প্রমুখ ছাত্রনেতার উদ্যোগে ও নেতৃত্বে চট্টগ্রামে যারা ছাত্রলীগের রাজনীতিকে বিকশিত করে জোয়ার সৃষ্টি করতে সক্ষম হন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- রউফ খালেদ, অধ্যক্ষ শায়েস্তা খান, বখতেয়ার কামাল, কফিল উদ্দিন, অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, লোকমানুল মাহমুদ, গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, আহমুদ, নুরুল আলম চৌধুরী, আশরাফ খান, নুরুন্নবী চৌধুরী, ইদরিস আলম, মোখতার আহমদ, এস এম ইউসুফ, মৌলভী সৈয়দ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, গোলাম রব্বান, অধ্যাপক নাজিমউদ্দিন, সালাহউদ্দিন মাহমুদ, শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ, সুলতান উল কবির চৌধুরী, হাজি কামাল, মোহাম্মদ ইদ্রিস, শেখ মোহাম্মদ আয়ুব বাঙালি, আবদুল মোবারক, মোহাম্মদ ইব্রাহিম, শহীদ আবদুর রব, আবদুল্লাহ হারুন, এম এ হাশেম, অধ্যক্ষ ফজলুল হক, শেখ মোহাম্মদ ইব্রাহিম, কলিমউল্লাহ চৌধুরী, মোছলেম উদ্দিন আহমদ, খালেকুজ্জামান, শফর আলী প্রমুখ এই দলের মধ্যে এই নুরুল আলম চৌধুরী স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন।
তিনি আপসহীন সংগ্রামী নেতা ছিলেন। ছাত্রজীবনেও আপস করেননি, বৃহত্তর জাতীয় রাজনীতি যখন করছেন, তখনো আদর্শের প্রশ্নে অবিচল, অটল ছিলেন। পঁচাত্তরের দুর্যোগেও দলের প্রতি তাঁর আনুগত্যে এতটুকু চিড় ধরেনি। মিজান চৌধুরী আওয়ামী লীগ ভেঙে উপদল করলে তাঁর বন্ধুদের কেউ কেউ যখন তাঁর সঙ্গে ভিড়ে যান নুরুল আলম চৌধুরী তখনো বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে আঁকড়ে ধরে পড়ে ছিলেন। তাঁর সামনে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে কারো পার পাওয়ার জো ছিলো না। প্রতিপক্ষের মুখের ওপর দাঁতভাঙা জবাব দিতে তাঁর জুড়ি ছিলো না। এমনিই আদর্শবান, সৎ, সাহসী মানুষ ছিলেন নুরুল আলম চৌধুরী।
তাঁন ঘনিষ্ঠজনেরা বলতেন, তিনি বন্ধুবৎসল, আড্ডাপ্রিয়, মজলিশি লোক ছিলেন। আড্ডায়, মজলিশে কখনো কখনো গাম্ভীর্যের মুখোশ পড়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতেন। এটা নিছকই পরিহাস করার জন্যই করতেন, পরক্ষণেই হো হো করে হেসে গড়াগড়ি খেতেন।
নুরুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে পূর্বকোণের একটা স্মৃতি আছে, সেটা বলছি। ১৯৮৬ সালের ১০ ফেব্রæয়ারি পূর্বকোণ প্রকাশিত হয়। আর সে বছরই নুরুল আলম চৌধুরী পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। তো পূর্বকোণের ডিএফপির বিজ্ঞাপনের রেট ও ভলিউম নিয়ে একটা সমস্যা হচ্ছিলো। পূর্বকোণের এই সমস্যাটা কিভাবে সমাধান করা যায়, সেটা নিয়ে আমি নুরুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন, দাঁড়ান, আমি সংসদে বলে দেখি। অধিবেশন শুরু হলে তিনি মনোযোগ আকর্ষণী নোটিশ দিয়ে পূর্বকোণের বিষয়টা তুলে ধরলেন। তথ্যমন্ত্রী উত্তর দিতে বাধ্য হলেন এবং পূর্বকোণের সমস্যাটা সমাধান করে দিলেন।
এমনই সহৃদয় ও সহযোগিতাপরায়ণ মানুষ ছিলেন নুরুল আলম চৌধুরী। অনাগত আগামীতে অনেক রাজনীতিবিদ আসবেন, যাবেন, কিন্তু একজন নুরুল আলম চৌধুরীর আর জন্ম হবে না। তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটা সম্মোহন ছিলো, চরিত্রে দুর্নিবার আকর্ষণ ছিলো, তাঁকে দেখে উপেক্ষা করার বা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় ছিলো না। তাঁর একটা ক্যারিশমা ছিলো, এক অনুপম বর্ণময় জীবন যাপন করে গেলেন তিনি।

লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক