একজন নাগরিকের কিছু প্রশ্ন ও প্রস্তাব

72

এম. এ. মাসুদ

আমাদের মধ্যে যারা ডাক্তার এবং যারা ডাক্তার ননÑআমরা সবাই ভালোভাবেই জানি যে, গাঁজা, তামাক, পেনসিডিল, ইয়াবা, বিড়ি, সিগারেট, গুল, খৈনী, হেরোইন ইত্যাদি যারা সেবন করে, মৃত্যুর অমোঘ আহŸানকে তারা কেউ এড়াতে পারে না। এসব নেশার জিনিস সেবন করার অর্থ হল নির্দিষ্ট সময়ের আগে মৃত্যুকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো। আমাদের পুলিশ, র‌্যাব, মাদক নিয়ন্ত্রণ দপ্তরÑএসব বিভাগ মাদক নিয়ন্ত্রণ কাজে নিয়োজিত। এতগুলো বিভাগ মাদক নিয়ন্ত্রণ কাজে নিয়োজিত থাকার পরও দেশের মাদকের ব্যবহারের উপর কোন প্রভাব না পড়ার কারণ কি ? সম্প্রতি দেশের জুয়ার ক্যাসিনোর হোতাদের গ্রেফতারের পর তাদের স্থান জেলে না হয়ে হাসপাতালে হয় কেন ?
আমাদের দেশের পরিবেশের দেখভাল করার জন্য রয়েছে পরিবেশ দপ্তর। প্রকৃতির হাতে গড়া পরিবেশের ক্ষতি করার বা প্রকৃতির প্রাকৃতিক অবয়ব নষ্ট করার মত অপকর্মে যারা নিয়োজিত, তারা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধে অপরাধী এবং তারা দেশের আইন অনুযায়ী শাস্তি পেয়ে জেলেই তাদের ঠিকানা হওয়া উচিত। কিন্তু প্রশ্ন, পাহাড়ের পর পাহাড় কেটে, বনভূমি উজাড় করে, সরকারী জমি দখল করে যে সব ভূমি দস্যুরা সমাজে ভাল মানুষ সেজে, আইন কানুনকে কেয়ার না করে বহাল তবিয়তে আমাদের মধ্যে বিচরণ করছে তাদের কেন সাজা হয় না বা তারা কেন জেলে যায় না ?
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় নদী ও খালের জমির দখলের উৎসব চলছে। আর চলছে এসব নদী ও খালের পানিতে বর্জ্য ফেলে নদী-খালের পানির দুষণ বাড়ানোর কাজ। যেসব নদী-খালে এক সময় নৌকা স্টীমার চলত আর পাওয়া যেত প্রচুর মাছÑ তা’ এখন রূপকথার গল্পের মতই। দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মাছ প্রজননের নদী হালদা থেকে বালি উত্তোলন, ইঞ্জিন চালিত নৌযান চলাচল, মা মাছ এবং ডলফিন হত্যা করা কেন এখনো বন্ধ হচ্ছে না ? কর্ণফুলী, হালদা, তুরাগ, বুড়িগঙ্গা আর শীতলক্ষা নদী সমুহের তীরের অবৈধ দখলদার মুক্ত করার কাজ মাঝপথে থেমে গেল কেন? এসব নদীতে বর্জ্য ফেলা এখনো বন্ধ হচ্ছে না কেন ? অতি সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিডিএ কর্তৃক বেআইনীভাবে পাহাড়কাটার অপরাধে পরিবেশ আদালত কর্তৃক সিডিএ-কে যে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা হল, সে টাকা কি আদায় হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তবে এর কারণ কি ? ইট ভাটার ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণ রোধের জন্য আমরা পরিবেশ দপ্তরের অনেক তৎপরতা দেখি। কিন্তু এই তৎপরতার রেজাল্ট কি ? পলিথিন অপচনশীল হওয়ায় এগুলি আমাদের নালা, খাল, নদীর তলদেশ ভরাট করে ফেলছে। পলিথিনের বিকল্প আমাদের নিজস্ব সম্পদ পাটের তৈরী ব্যাগ এবং পাটের অন্যান্য সামগ্রী কি আমরা ব্যবহার করতে পারি না? পাটের তৈরী অনেক দৃষ্টি নন্দন শপিং ব্যাগ, শোপিস সহ অনেক জিনিষ তৈরী করা যায় যা পলিথিনের বিকল্প এবং পরিবেশ বান্ধব।
অথচ পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের সামগ্রী ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয় না কেন ?
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নানা বাহানায় তা আর ফেরত না দেওয়াটা এখন আমাদের ঐতিহ্য। যার পুরোনো ঋণ আছে তার সেই ঋণ আদায় না হওয়া সত্বেও তাকে নূতন ভাবে ঋণ দেওয়ার নিয়মও আমাদের দেশে আছে। ঋণ রিসিডিউল ব্যবস্থার মাধ্যমে, আপনার যতই লোন থাক না কেন, আপনি ঋণ খেলাপী মুক্ত হয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু কেন? ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতার ঋণ আদায়ে ব্যাংকের যে তৎপরতা, বড় ঋণ গ্রহীতার ঋণ আদায়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের তৎপরতা অতি নগন্য। এইসব খেলাপী ঋণ কি কখনো আদায় করা যাবে ?
বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণ উপকূল এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের পশ্চিম উপকূল প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ¡াসে ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রতি বছর এসব উপকূলের বেড়ী বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে মানুষের ঘরবাড়ী প্লাবিত করে। এটি বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছরের নিয়মিত ঘটনা। ঘুর্ণিঝড় জলোচ্ছ¡াসে প্রতি বছর বেড়ী বাঁধ ভাঙ্গে আর প্রতি বছর সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে বেড়ী বাঁধ মেরামত করে। এই কাজে প্রত্যেক বছর সরকারের কোটি কোটি অর্থ ব্যয় করার পেছনে কোন যুক্তি থাকতে পারে না।
টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী বেড়ী বাঁধ নির্মাণ করার মত প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি বছর ভেঙ্গে যাওয়া বেড়ী বাঁধ প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে মেরামত করার কোন সংগত কারণ নেই। প্রতিবছর যেন সরকারকে এই সব বেড়ী বাঁধ নির্মাণে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিতে না হয় এবং জনগণের ভোগান্তি যাতে লাঘব করা যায় সেজন্য একটি স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ নেদারল্যান্ডস একসময় আমাদের মত এ জাতীয় দুর্ভোগের শিকার হত। প্রযুক্তি নির্ভর টেকসই এবং দীর্ঘ স্থায়িত্বশীল বেড়ী বাঁধ নির্মাণে এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে, আমাদের মুমুর্ষ নদী-খালের প্রানপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে এবং আমাদের ভাঙ্গন প্রবণ নদীগুলির স্থায়ী ভাঙ্গন রোধকল্পে আমরা নেদারল্যান্ডসের প্রকৌশল জ্ঞান আমাদের এ সকল সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করতে পারি। এজন্য উভয় দেশের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ আবশ্যক। বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে যাতে দ্রæততম সময়ে এ বিষয়ে একটি পজেটিভ সিদ্ধান্তে আসা যায়। একজন নাগরিক হিসেবে সরকার সমীপে নি¤œলিখিত কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করছি:
১. তামাক চাষীদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করে অনতিবিলম্বে দেশে তামাক চাষ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে;
২. সারা দেশে পলিথিনের ব্যাগ এবং অন্যান্য পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন ও বিপণন কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. পাট মন্ত্রণালয়কে পলিথিনের বিকল্প দৃষ্টি নন্দন শপিং ব্যাগ, শোপিস সহ অন্যান্য সামগ্রী উৎপাদনের জন্য কঠোর নির্দেশনা দিতে হবে।
৪. পরিবেশ মন্ত্রনালয়, ইওডঞঈ, ভূমি মন্ত্রণালয় প্রভৃতি মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে সক্রিয় করে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য একটি সময় সীমা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে।
৫. বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্ত সীল করে দিতে হবে যাতে আমাদের দেশে ইয়াবা ঢুকতে না পারে।
৬. দেশ থেকে পলিথিন নির্মুলে তিন মাস সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে।
৭. আমাদের সরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের কর্মকাÐের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের দুনীর্তি দমন কমিশনকে একটি স্বাধীন, সৎ, দক্ষ ও চৌকস প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য এ প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দসহ লোকবল নিয়োগ দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করা ক্ষমতা দিতে হবে।
লেখক : সমাজকর্মী