একজন অকুতোভয় বীরসেনানী মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন, বীরবিক্রম, পিএসসি

122

অত্যন্ত দুঃখভরা মন নিয়ে একজন অকুতোভয় বীরসেনানী নিয়ে লিখতে বসেসি। যিনি একজন অসম সাহসী, বুদ্ধিমান, মেধাবী, ভাল ও সম্পূর্ণ মানুষ। গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ খ্রি: মঙ্গলবার ৫৯ বছর বয়সে যিনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তিনি হচ্ছেন মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন, বীরবিক্রম, পিএসসি। তার মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে পড়ে দেশবাসীসহ সকলস্তরের মানুষ। বেশি শোকাহত হয়ে পড়ে লোহাগাড়াসহ চট্টগ্রামবাসী। তার মৃত্যুতে দেশ হারিয়েছে একজন অকুতোভয় বীরসেনানী ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন নেতৃস্থানীয় সেনা কর্মকর্তা। তিনি চলে যাওয়ায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল দেশের। তার শূন্যতা পূরণ হবে কিনা জানি না। তবে তার মেধা, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতা জাতির কাছে অনুকরণীয়-স্মরণীয় ও পাথেয় হয়ে থাকবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন ছিলেন মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বীরবিক্রম, পিএসসি। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ও নিরহংকারী মানুষ ছিলেন। যেকোন মানুষকে তিনি ব্যবহার দিয়ে মন জয় করতে পারতেন। ছোট-বড় সকলকে তিনি সমানভাবে দেখেছেন।এতো ক্ষমতাবান ব্যক্তি হয়েও তিনি কাউকে ক্ষমতা দেখান নি। ভালবাসা দেখিয়েছেন। তার বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার ঐতিহাসিক চুনতি গ্রামে। তিনি ১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি চুনতি গ্রামের সিকদার পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোহাম্মদ ইসহাক মিয়া এবং মাতার নাম মেহেরুন্নেছা। স¤্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজার রাজ পরিবারের গৃহশিক্ষক ইব্রাহীম খন্দকার চুনতি গ্রামে এসে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। মেহেরুন্নেছা ইব্রাহীম খন্দকারের বংশধর। মেহেরুন্নেছা মিষ্টভাষিনী ছিলেন। এলাকায় তিনি মহিয়সী ও শ্রদ্ধাশীল মা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অন্যদিকে মোহাম্মদ ইসহাক মিয়া চুনতি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাদের দুই ছেলের মধ্যে মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন ছোট সন্তান। বড় ছেলে আলহাজ্ব মুহাম্মদ ইসমাইল মানিক একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব। তিনি লোহাগাড়ার প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চুনতি হাকিমিয়া কামিল এম.এ মাদ্রাসা ও চুনতি মহিলা কলেজের পরিচালনা কামিটির সভাপতি।
মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসায়। এই প্রতিষ্ঠানে তিনি দাখিল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ১৯৭৫ সালে এসএসসি ও ১৯৭৭ সালে এইচএসসি কৃতিত্বের সাথে পাস করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। দুই বছর পর তিনি বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে কমিশনপ্রাপ্ত হন। সেনাবাহিনীতে তিনি একজন মেধাবী, সাহসী ও নিষ্ঠাবান অফিসার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৯৫-‘৯৬ সালে গোলযোগপূর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক জটিল ও কঠিন সমস্যা তিনি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করেন। বীরত্বপূর্ণ সাহসী কর্মকাÐের জন্য তিনি ‘বীরবিক্রম’ খেতাবে ভূষিত হন। জাতিসংঘ শান্তিমিশনে দায়িত্ব পালনকালে তিনি একজন বিচক্ষণ সেনা কর্মকর্তা হিসেবে প্রশংসিত হন। পরবর্তীতে তাকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। ফলে একজন বিচক্ষণ, মেধাবী ও বিশ্বস্ত সেনা কর্মকর্তা হিসেবে সরকারের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে এসএসএফ‘র মহাপরিচালক পদে নিযুক্ত করা হয়। একই সালের ফ্রেব্রæয়ারি মাসে তাকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। ২০১১ সালের ২১ নভেম্বর তাকে নিয়োগ দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব হিসেবে। অল্পসময়ের মধ্যে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সামরিক সচিব পদে বহাল ছিলেন।
তিনি একজন উদার, উজ্জ্বল, সাদাসিধে ও নিরহংকারী মানুষ ছিলেন। মানুষের সাথে মিশা ও মানুষের সাথে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা তিনি পছন্দ করতেন। আমি (লেখক) লোহাগাড়া আলহাজ্ব মোস্তফিজুর রহমান কলেজে চাকুরি করার সুবাদে বিভিন্ন সময়ে উনার সাথে দেখা করার ও কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সুযোগটি হয়েছিল লোহাগাড়ার সাবেক ইউএনও মোহাম্মদ ফিজনূর রহমানের মাধ্যমে। সামরিক সচিব মহোদয় নিজ গ্রাম চুনতি আসলে তার সাথে দেখা করার জন্য ইউএনও‘র সাথে আমিও যেতাম। আমি যতটুকু দেখেছি সামরিক সচিব মহোদয় একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক বীরপুরুষ ও ভাল মানুষ ছিলেন। এলাকার ও মানুষের উন্নয়ন তিনি চাইতেন। মানুষের মঙ্গল কামনা করতেন। একদিন বিকেলে বেলা তিনি কক্সবাজার হয়ে লোহাগাড়া আসছেন। খবর পেয়ে ইউএনও মোহাম্মদ ফিজনূর রহমান ও আমি (লেখক) চুনতিতে হাজির হলাম। আমাদের সাথে যোগ দিলেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ সদস্য আলহাজ্ব আনোয়ার কামাল ও চুনতি দারোগা পাড়ার এম আজিজুল হক। তিনি যথাসময়ে আসলেন এবং আপন মনে আন্তরিকতার সাথে আমাদেরকে গ্রহণ করলেন। আমরা তার সাথে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করলাম। এলাকার উন্নয়ন নিয়ে কথা বললেন। আমাদের সমাজে এমন বড় মাপের মানুষ বড়ই অভাব। তার মৃত্যু যেন এক মহামানব ও সৃষ্টিশীলের পতন।
তিনি একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। দেশের উন্নয়নে তিনি বহু কাজ করেছেন। এলাকার উন্নয়নে রাখেন বহু ভূমিকা। চুনতির মাওলানা পাড়ায় তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘চুনতি মেহেরুন্নেছা প্রাথমিক বিদ্যালয়’। বিদ্যালয়টির এক অনুষ্ঠানে আমার রচিত ‘আমার মা মেহেরুন্নেছা’ নামের লেখার একটি কপি সামরিক সচিব মহোদয় অশ্রæসিক্ত মনে আন্তরিকতায় গ্রহণ করে আমাদেরকে মূল্যায়ন করলেন। ২০১৫ সালে চুনতি মাওলানা পাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন চুনতি মেহেরুন্নেছা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ২০১৫ সালে তার সহযোগিতায় চুনতি পানত্রিশায় প্রতিষ্ঠিত হয় বীরবিক্রম জয়নুল আবেদীন উচ্চ বিদ্যালয়। ২০১৭ সালে তার প্রচেষ্ঠায় এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নিমিত হয় চুনতি ইসহাক মিয়া সড়ক। এই সড়ক প্রতিষ্ঠার ফলে এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে এবং এলাকার সৌন্দর্য্য বহুগুণে বেড়েছে। এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি লোহাগাড়ায় ১টি মাধ্যমিক বিদালয় ও ১টি কলেজ জাতীয়করণে ভূমিকা রাখেন। তার প্রচেষ্টায় লোহাগাড়ার চুনতি রাবার ড্যাম প্রকল্পসহ দেশে ১০টি রাবার ড্যাম প্রকল্প হয়। ২০১৫ সালে চুনতি রাবার ড্যাম প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়। বর্তমানে এই রাবার ড্যাম প্রকল্পের এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটন। প্রতিদিন সমাগম হয় বহু লোকের। রাবার ড্যামের মাধ্যমে চাষ হচ্ছে শত-শত একর জমি। এই রাবার ড্যাম বদলে দিচ্ছে এলাকার কৃষি ও পর্যটন। দেশের উন্নয়নে তিনি করে গেছেন বহুমাত্রিক কাজ। তিনি প্রচারবিমুখ মানুষ ছিলেন। দেশের সেবা করা ও এলাকার কাজ করাকে তিনি গুরুত্ব দিতেন। এমন একজন দেশপ্রেমিক মানুষ দেশে আর জন্ম হবে কিনা জানি না। কিন্তু দেশের জন্য তার অবদান স্মরণীয়-বরণীয় ও পাথেয় হয়ে থাকবে।
মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন ১৯৮৬ সালে চুনতির ঐতিহ্যবাহী দারোগা পরিবারের বংশধর আসিফা বেগম জিনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আজগর আলী চৌধুরী দারোগা পরিবারের গোড়াপত্তন করেন। আজগর আলী চৌধুরীর বড় ছেলে আজম উল্লাহ চৌধুরী তখনকার সময়ে দারোগা ছিলেন। ঐ সময়ে দারোগাকে অনেকাংশে ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করতে হত। আসিফা বেগম জিনা- আজম উল্লাহ চৌধুরীর ছেলে রফিক আহমদ চৌধুরীর কন্যা। আন্তর্জাতিক নৃত্যশিল্পী ও চিত্রশিল্পী রশিদ আহমদ চৌধুরী প্রকাশ বুলবুল চৌধুরী ছিলেন রফিক আহমদ চৌধুরীর বড় ভাই। মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন দুই কন্যা সন্তানের জনক। তারা হলেন সাইবা রুশলানা আবেদীন ও ফাবিহা বুশরা।
মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বীরবিক্রম, পিএসসি আজ আমাদের মাঝে নেই। সাহসী এই মানুষটি গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ খ্রি: মঙ্গলবার বিকেল ৫ টা ১৩ মিনিটে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর খবরে তার গ্রামের বাড়ি লোহাগাড়া এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। পরের দিন বুধবার সকালে ঢাকার সেনানিবাস কেন্দ্রিয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় মন্ত্রীপরিষদের সদস্য, সচিব,তিন বাহিনীর প্রধানগণ, ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, ক‚টনৈতিকবৃন্দ ও রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও স্পীকারের পক্ষ থেকে তার মরদেহে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বৃহস্পতিবার বিশেষ হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা থেকে তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি লোহাগাড়ার চুনতিতে নিয়ে আসা হয়। বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ১৫ মিনিটে চুনতি সীরত ময়দানে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তাকে এক নজর দেখার জন্য বিভিন্ন ধর্মের লোকজন সীরত মাঠে জড়ো হয়। জানাজায় সংসদ সদস্য প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন, উপজেলা চেয়ারম্যান জিয়াউল হক চৌধুরী বাবুল, উপজেলা নির্বাহী অফিসার তৌছিফ আহমেদ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দসহ হাজার-হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। জানাজার পূর্বে সামরিক সচিবের বড় ভাই আলহাজ্ব মুহাম্মদ ইসমাইল মানিক তার জীবন-বৃত্তান্ত তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। জানাজায় ইমামতি করেন চুনতি হাকিমিয়া কামিল এম.এ. মাদ্রাসার মুহাদ্দিছ আলহাজ্ব হাফেজ মাওলানা শাহ আলম। জানাজা শেষে সামরিক মর্যাদায় তাকে চুনতি জামে মসজিদস্থ পারিবারিক কবরস্থানে তার মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুতে দেশবাসী ও এলাকাবাসীসহ দিশেহারা মানুষগুলো অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। তিনি মানুষকে কতই না ভালবাসতেন। তার শূন্যতা ও ভালবাস্ াকোনদিন পূরণ হবার নয়। তার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত ও ব্যথিত। আজীবন স্মৃতির পাতায় ও খাতায় শ্রদ্ধাভরে ধরে রাখতে চাই শ্রদ্ধাভাজন সাহসী বীরসেনানী মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বীরবিক্রম, পিএসসি মহোদয়কে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক
আলহাজ্ব মোস্তফিজুর রহমান কলেজ, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম