ঋণখেলাপি’র উল্লাস ব্যাংক বিড়ম্বনার শেষ কোথায়

46

ব্যাংক ঋণখেলাপিদের উল্লাস অব্যাহত রয়েছে, সাথে যোগ হয়েছে ব্যাংক নিয়ে বিড়ম্বনা। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন প্রায় নাজুক অবস্থায়। গ্রাহকরা ব্যাংকের দিকে ছুটে যেতে আতংকগ্রস্ত। অপরদিকে গ্রাহকরা স্বদেশী ব্যাংকের উপর আস্থা রাখতে না পেরে বিদেশি ব্যাংকে গ্রাহক হওয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেছে। ব্যাংক বিড়ম্বনা নিয়ে রাষ্ট্র নীরব কেন এটি আমার মত অনেকের প্রশ্ন? দেশের ব্যাংক গ্রাহকদের যৌক্তিক দাবি হল দ্রæত ব্যাংক বিড়ম্বনা যবনিকাপাত ঘটুক। প্রসঙ্গতঃ সম্প্রতি জাতীয় সংসদে দেশের ৩শ’ শীর্ষ ঋণখেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিকানাসহ তালিকা প্রকাশ করেছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রীর এ উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই এবং প্রশংসার দাবিদার। একই সঙ্গে তাঁকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তালিকা প্রকাশই যথেষ্ট নয়; এ ৩শ’ শীর্ষ ঋণখেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসহ অপরাপর ঋণখেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে কোনো রকম শৈথিল্য প্রদর্শন কাম্য নয়। ইতিপূর্বে অর্থমন্ত্রী ঋণখেলাপি হওয়াকে ‘অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং এক্ষেত্রে তিনি মালয়েশিয়ার উদাহণ দিয়ে বলেছেন, মালয়েশিয়ার যেসব ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, তাদের নামের তালিকা সরকারিভাবে তৈরি করে বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠানো হয় এবং কেউ দেশত্যাগ করতে চাইলে তাকে আটক করা হয়। প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে আমাদের এখানেও এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। সময়োপযোগী যথার্থ এ প্রতিশ্রæতির বাস্তবায়নে অর্থমন্ত্রী কোনো ছাড় দেবেন না বলেই আমাদের বিশ্বাস। উদ্বেগের বিষয় হল, খেলাপি ঋণের বৃত্ত থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছে না দেশের ব্যাংক খাত। খেলাপিঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় বর্তমানে ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। মূলত ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব, সুশাসনের অভাব এবং সরকারি ব্যাংগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা শিথিল হওয়ার কারণেই খেলাপিঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করার কারণে সেখানেও খেলাপির সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বস্তুত খেলাপি ঋণ না কমে বরং দিন দিন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হল, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়া। খেলাপি ঋণ কমাতে গত ফেব্রæয়ারি মাসে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডিরা প্রয়োজনে ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কট করার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের দায় পরিশোধ করবেন না; অথচ বিলাসী জীবনযাপন করবেন, তা যেন না হয়। পরামর্শ সভায় ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কট করার পাশাপাশি তাদের সন্তানদের ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ আটকে দেয়াসহ তারা যাতে গাড়ি ও বাড়ি কিনতে না পারেন, তা কার্যকর করার উপায় নিয়ে ভাবার সময় এসেছে বলে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। দুশ্চিন্তার বিষয় হল, মোট খেলাপি ঋণের ৮৩ দশমিক ১৬ শতাংশই মন্দমানের। খেলাপি ঋণ না কমে বরং দিন দিন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হল, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়া। এছাড়া যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রদেয় নতুন ঋণ খেলাপির পাল্লা ভারি করছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।


ঋণ যাতে কুঋণে পরিণত না হয়, সে ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর সতর্ক থাকা জরুরি। মিথ্যা তথ্য ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেয়ার পর তা খেলাপিতে পরিণত করার প্রবণতা শুরুতেই রোধ করা গেলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে ঝুঁকি এড়ানো সহজ হবে। দুঃখজনক হল, ব্যাংকিং খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়নি, যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংকসহ আরও কিছু ব্যাংকের ঋণ কেলেংকারির ঘটনা। বস্তুত ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার প্রবণতা এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় জবাবদিহিতার পরিবেশ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি খেলাপি ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেবে এবং যারা ঋণ পাবার যোগ্য, যাদের ঋণ দিলে সরকারের রাজস্ব অবকাঠামো গতিশীল হবে এ বিষয়গুলো যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। এছাড়া ঋণখেলাপিদের উল্লাস থামানোর জন্য সরকারি নীতিগতভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে।

লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক