উপকূল এলাকা সংরক্ষণে গভীর মনোযোগ দিতে হবে

55

২৯ এপ্রিল। ধ্বংস আর শোকাবহ দিন। ১৯৯১ সালে এ দিন রাতে চট্টগ্রামসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনেছিল মহাপ্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। এখনও মনে পড়ছে, দিনটি ছিল সম্ভবত সোমবার। সকাল থেকে আকাশে মেঘের আনাগোনার পাশাপাশি ছিল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বাতাস প্রবহমান ছিল হালকাভাবে। দুপুর গড়াতেই বেড়ে ক্রমশঃ বাড়ছিল বাতাসের গতিবেগ। সন্ধ্যা নাগাদ বাতাসের গতি বৃদ্ধি পায় একই সাথে বৃষ্টিও। চলতে থাকে প্রচন্ড ঝড়োবাতাস হাওয়া। আর মধ্যরাতেই ২২০-২২৫ কিলোমিটার বেগে বঙ্গোপসাগর থেকে বেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতায় জলোচ্ছ্বাসে আঁচড়ে পড়ে পুরো উপক‚লীয় এলাকায়। ২০ থেকে ২৫ ফুট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় চট্টগ্রাম কক্সবাজারসহ দেশের সবকটি উপকূলীয় এলাকা। লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা, বন্দর, হালিশহরসহ বিস্তীর্ণ আনোয়ারা ও বাঁশখালী উপক‚লীয় এলাকা। বঙ্গোপসাগর ও শংখনদীর বেড়িবাঁধে বিলীন হয়ে স্রোতের সঙ্গে ভেসে গিয়েছিল পুরো এলাকার সমস্ত বাড়িঘর, গাছপালা, গবাদিপশু। হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুর সলিল সমাধি ঘটেছিল সে রাতের জলোচ্ছ্বাসে এমনকি বাঁশখালী সমগ্র উপক‚লীয় এলাকা মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছিল। সরকারি হিসেব মতে সেই ঘূর্ণিঝড়ে মারা গিয়েছিল প্রায় আর ১ লাখ ২৭ হাজার যা বেসরকারি হিসেবে ২ লাখেরও বেশি। এককথায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছিল। বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখেছিল সেই ধ্বংসলীলা। কেঁদে উঠেছিল বিবেক। সারা পৃথিবীর মানুষ ’৭১এর পর আরো একবার বাঙালি জাতির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আর্ত-মানবতার সেবায় তাদের হাত প্রসারিত করেছিল। সেই অনেক দিন আগের কথা। সময় পেরিয়ে গেছে ২৮টি বছর। এত বছর পর কেমন আছেন সেই দুর্যোগকবলিত উপকূলীয় এলাকার মানুষ? দুর্যোগ মোকাবেলার কী অবস্থা এখন উপক‚লের? স্বজন হারানোর স্মৃতি নিয়ে প্রতি বছরই এই দিন ফিরে আসে উপক‚লবাসীর কাছে।
আজ আবারো এসেছে সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল। যেদিন ‘ফণি’ নামক আরো একটি ঘূর্ণিঝড়ের আগাম বার্তা দেয়া হয়েছে। এমনিতেই আবহাওয়া অধিদপ্তরে পূর্বাভাসে এপ্রিল-মে মাসে একাধিক নিম্নচাপের আশঙ্কার কথা প্রকাশ হয়ে থাকে। এবার একেবারে ’৯১এর গা ঘেঁষে ঘূর্ণিঝড়টি ধেয়ে আসছে। কিন্তু এখনো সম্পূর্ণ অরক্ষিত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপক‚ল। বাংলাদেশের অন্যতম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের বন্দর নগরীর পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী, আনোয়ারা, সীতাকুন্ড, মিরসরাই, সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালীসহ উপক‚লীয় এলাকার লোকজন এখনো রয়েছে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আতঙ্কে। ’৯১ সালে এ ভয়াল রাতে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এসব এলাকায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটলেও এখন পর্যন্ত সেখানে নির্মিত হয়নি স্থায়ী বেড়িবাঁধ। লক্ষ্য করা গেছে, বর্তমান সরকার উপকূলীয় বেড়িবাঁধসহ রিংরোড নির্মাণ, মেরামত, সংস্কারসহ বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে এবং বাস্তবায়নও করেছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে এসব প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় হয়নি। অধিকাংশ প্রকল্পে ঘটেছে নয় ছয় এর ঘটনা। সামান্য বৃষ্টি বা জোয়ারের পানিতেই ভেঙে যায় এসব বাঁধ। জাতীয় রাজস্বের শতকরা ৮০ শতাংশ অর্থ যোগানকারী বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধ হিসেবে পরিচিত বন্দর নগরীর পতেঙ্গা বেড়িবাঁধটি এখনো পর্যন্ত টেকসইভাবে নির্মিত হয়নি। ’৯১ এর মহাপ্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এ বাঁধটি ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছিল নগরীর বিভিন্ন এলাকা, শিল্প কারখানা ও স্থাপনার। অবশ্যই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তাদের মেগা প্রকল্পের অধীনে এবাঁধটিসহ একটি টেকসই রিংরোড নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। আগামী ২০২১ সাল নাগাদ এপ্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। অনুরূপভাবে বাঁশখালী উপক‚লীয় এলাকায় টেকসই স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণে বর্তমান সরকার ২০১৫ সালে প্রায় ২৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার পর এর স্থায়িত্ব নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেগ হয়েছে। কারণ এখানেও বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। জাতির জন্য দুর্ভাগ্যের যে, যে বেড়িবাঁধ মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য সেখানেই যদি এ অবস্থা হয় তবে মানুষ কোতায় গিয়ে নিরাপদ আবাস গড়বে ? আমরা মনে করি, সরকার যে উদ্দেশ্যে এ প্রকল্পগুলো গ্রহণ করেছে তা যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারকে কঠোর নজরদারিও করতে হবে। এক্ষত্রে জবাবদিহিতার বিষয়তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। আমরা আশা করি, সামনে বর্ষা মৌসুম। এরমধ্যেই ঘুর্ণিঝড়ের আবাস দেয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা তা কার্যকর করতে হলে উপকূলীয় এলাকার উন্নযন কার্যক্রমগুলোর প্রতি গভীর মনোযোগ দিবে।