উত্তুরুত্তুন আইস্যে তোতা পাংখা লারি লারি

74

মুশফিক হোসাইন

চাটগাঁইয়াদের কাছে চাটগাঁইয়া বুলি বেশ জনপ্রিয়। এই বুলি প্রবাদ, প্রবচন চট্টগ্রামের আর্থসামাজিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্টের বহিঃপ্রকাশ। ‘উত্তুরুন আইস্যে তোতা পাংখা লারি লারি’ এই শিশু তোষন শ্লোক থেকে এটা প্রমাণিত যে, সমাজে আনন্দময় ও সুখী জীবন ব্যবস্থার সাথে প্রকৃতিতেও প্রচুর জীব-জন্তু ও পাখপাখালি বিচরণ করতো। প্রাচীন ইতিহাস ও ভ্রমণকাহিনী পাঠ করলে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ মিলবে। প্রাচীন কালে তথা হাজার বছর ধরে এ দেশে অনেক পর্যটক এসেছেন। যেমন মা-হুয়ান, হু-হিয়েন, ইবনে বতুতা, পাদরি মেস্টো ফে সেবাস্টিন মানরিক ফ্রানসিস বুখানন প্রমুখ।
সম্প্রতি অসীম কুমার রায় অনুদিত ‘বঙ্গ বৃত্তান্ত’ পাঠের সময় সে কথা মনে পড়ে গেল। সেবাস্টিন মানবিক একজন রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়কের যাজক। তিনি সম্রাট শাহজাহানের (১৫৯২-১৬৬৬ খৃ:) রাজত্ব কালে বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে এদেশের সামাজিক অবস্থা, রীতি-নীতি, শাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। বস্তুত: মানরিকের বিবরণ ছাড়া সেই সময় বাংলাদেশে বিশেষ করে দক্ষিণ বঙ্গের কি অবস্থা ছিল, তা জানবার আর কোন উপায় নেই। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন ‘আমরা সেখানে পৌঁছে দেখলাম যে শহরে প্রচুর খাদ্যসামগ্রী। মুরগী, খাসী (এ দেশের লোক খাসীর মাংস ভেড়ার মাংস থেকে বেশি পছন্দ করে) ইত্যাদি তো আছেই, তা ছাড়া প্রচুর বাছুরের মাংস পাওয়া যায়। পায়রা ও অন্যান্য পাখি, নানা রকমের চাল, ঘি, দুধের তৈরি খাবার আরও প্রচুর দেশিয় মিষ্টি। এদেশে চিনি খুব সুলভ। এইসব গাদা গাদা খাবার ছাড়াও এখানে নানা রকম ফলও পাওয়া যায়। ফলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো আম (বঙ্গ বৃত্তান্ত পৃষ্ঠা- ২১)।
আর একটি উদাহরণ দেয়া যাক: ‘এদেশে সেসময় যে সম্পদ জড়ো হয়েছে, তা একেবারে অবাক করে দেয়। আশ্চর্য লাগে এখানকার লোকদের বিশেষ করে খত্রিদের বাড়িতে যা টাকা আছে, তাই দেখলে! এত টাকা যে গোনা শক্ত; তাই সাধারণত ওজন করে এর পরিমাণ জানা হয়।’ … এখানকার অগুনতি বাজারে যে কত রকমের খাবার আর অন্য জিনিস পাওয়া যায় দেখেও কম আশ্চর্য লাগে না। আবার কখন কখন এত রকমের পোষা আর জংলি পাখি প্রায় বিনামূল্যে বিক্রি হচ্ছে। যেমন চার আনায় বিশটি ঘুঘু বা ষোলটি জংলি পায়রা, অন্য জিনিসও প্রায় একই রকম সস্তা। সম্রাট অন্য মুঘল শাসকেরা এই শহর থেকে যে কর ইত্যাদি পান তা প্রায় অবিশ্বাস্য। একমাত্র পান বা ভারতীয় পাতা থেকেইতাঁরা দিনে চার হাজার টাকা আয় করেন। (পৃষ্ঠা ২৮, বঙ্গ বিত্তান্ত)।
উপরের উদ্ধৃতিগুলো এ কারণে দেয়া হলো ঐ সময়ে বাংলার অর্থনীতি, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ এত উন্নত ছিল যে, তা এখনকার বাস্তবতার সাথে মিলে না। জীবন-যাপন ও বাস্তুতন্ত্র ছিল স্বাস্থ্যকর। জীববৈচিত্র্য ছিল অনুকূল ও বৈচিত্র্যময়। অথচ সেই দেশের প্রধান প্রধান শহর আজ দূষণে ভারাক্রান্ত। তেমনি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। যে দেশে চার আনায় ২০টি ঘুঘু বা ষোলটি জংলি পায়রা পাওয়া যেত সেখানে একটি পোষা পায়রার মূল্য শতাধিক টাকা। অতীতে এ দেশে কী পরিমাণ পাখপাখালি পাওয়া যেত তা কল্পনা করা যায় না। আর সে কারণে এ দেশের প্রবাদ, প্রবচন ও বুলিতে পাখপাখালি স্থান পেয়েছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় “ উত্তরুত্তুন আইসো তোতা পাংখা লারি লারি / বড়ই গাছত বইস্যে তোতা কতনা চতুরালি”। এগুলো হচ্ছে পোয়া ঢুলাইন্যা শ্লোক। মা বা গৃহের মুরব্বীরা দোলনায় শিশুকে রেখে দোলাতে দোলাতে এ শ্লোকে সুর তুলতেন। অথচ উত্তুরের তোতারা এখন পাহাড়ি জনপথ থেকে তেমন আর আসে না গ্রামের ছায়ায়। শহর গ্রাম এখন আর ছায়া শীতল নেই। সেই সবুজ শীতল গ্রাম হয়ত পাওয়া যাবে আগামীতে ক্যালেন্ডারের ছবিতে।
এতো কাহিনী অবতারনার মূল উদ্দেশ্য হলো, সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায় পরিবেশ দূষণের কারণে বিশ্বের অন্যতম ক্ষতিগ্রন্ত দেশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। শুধু শহরাঞ্চলে দূষণের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশের ৫৪ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। মানুষের জীবনে এই ক্ষতিকর হিসাব ভয়াবহ। দূষণের কারণে ২০১৫ সালে সারাবিশ্বে মারা গেছে প্রায় আশি হাজার মানুষ, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দশগুণ।
বিশ্বব্যাংক ২০১৮ সালে বাংলাদেশকে নিয়ে একটি পরিবেশ সমীক্ষায় এ চিত্র উঠে এসেছে। “এনহেনসিং অপরচুনি টিস ফর ক্লিন অ্যান্ড রেসিডেনসিয়াল গ্রোথ ইন আরবান বাংলাদেশ” শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে এ সকর তথ্য দেয়া হয়েছে। উল্লেখ যোগ্য যে, ২০০৬ সালের পর বিশ্বব্যাংক এই পরিবেশ সমীক্ষাটি করে। তবে এবারের প্রধান বিষয় ছিল শহর এলাকার দূষণ নিয়ে। মূলত শহরের বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তুকনা পি এম ২.৫ এর পরিমাণ, ঘরের ভেতরের বায়ুতে দূষণের মাত্রা, পানি দূষণ, স্যানিটেশন ও কর্মক্ষেত্রে দূষণের সূচকের পরিমাপ করা। বিশ্ব ব্যাংকের একদল গবেষক এই সমীক্ষাটি করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিগরি দুর্বলতা ও সম্পদের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে দূষণ রোধ করা এবং দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবেদনে মূলতঃ পরিবেশের আর্থিক ক্ষতি, শহরে পরিবেশ দূষণের ধরণা ও পরিবেশ সুরক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে (সূত্র : প্রথম আলো ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮)।
প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বিশ্বের (২০১৬ সালে) মোট মৃত্যুর ১৬ শতাংশের কারণ পরিবেশ দূষণ ও বিপর্যয়। বাংলাদেশে এই হার ২৮ শতাংশ যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের ১০ লাখ মানুষ সিসা দূষণের ঝুঁকিতে বসবাস করে। যাদের বেশির ভাগই শিশু। এই দূষণের কারণে শিশুদের মেধা ও বুদ্ধিমত্তার ক্ষতি হচ্ছে। গর্ভাবস্থায় শিশুর মৃত্যুহার বাড়ছে। এসব শিশুর বেশিরভাগ দরিদ্র ও তারা বস্তি এলাকায় বসবাস করে। সূত্র বলছে, এলাকায় ফেলে দেওয়া পরিত্যক্ত ব্যাটারীসহ শিল্পবর্জ্যরে কারণে এই দূষণ ঘটছে। দূষণ যে শুধু বস্তি এলাকায় হচ্ছে তা নয়। সিসা দূষণ অভিজাত এলাকায় ও আছে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। অভিজাত এলাকার এক শিশু শ্বাসকষ্টে ভোগে প্রায়শ। কোন কারণে শিশুটি প্রত্যন্ত গ্রামে বেশি কিছু দিন বসবাস করে। দেখা গেল শিশু যে কয় মাস গ্রামে বাস করেছিল, তখন তার শ্বাসকষ্ট দেখা যায়নি। এ তথ্য এটাই প্রমাণ করে যে, শহরের বসবাসকৃত প্রায় সকল শিশুর শ্বাসজনিত কম সিসা থেকে উদ্ভুত। যা গ্রামাঞ্চলে নেই বললেই চলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের শহরগুলোতে পরিবেশ দূষণের জন্য বাংলাদেশকে উচ্চমূল্য দিতে হচ্ছে। সবুজ প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশে সঠিক নীতি ও আইন প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। আর শিশুগুলিকে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবও কমাতে হবে।
সাম্প্রতিক করোনা কালে মানুষ যখন ঘরে বন্দি জীবন যাপন করছিলো, তখন প্রকৃতি নিজে থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেরামত হতে দেখা যায়। গ্রামেতো অবশ্যই শহরাঞ্চলে যেটুকু সবুজ গাছপালা ছিল তার চেহারা বদলে যায়। সবুজে ফুলে ফলে রাঙ্গাতে দেখা যায়। বন্যপ্রাণীগুলো নির্বিঘেœ চলাচল করে। আকাশ আরো নীল হয়ে উঠে। প্রকৃতিতে নির্মলতা প্রকাশ পায়। বাতাসে ভেসে বেড়ায় মিষ্টি আমেজ। ঘরের আসবাবপত্রে ধুলো জমার হার অনেকায়ংশেই কমে আসে।
এ করোনা কালে এটা প্রমাণিত হলো যে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে কোন কাজ করলে প্রকৃতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার প্রতিশোধ গ্রহণ করে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ তা অনুধাবন না করলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। জীববৈচিত্রের শৃঙ্খলে কোন শূন্যতা সৃষ্টি করা যাবে না। যে ভাইরাস পশুপাখির দেহে থাকার কথা, শূন্যতার সুযোগে সে মানবদেহে আশ্রয় নিয়ে ক্ষাতি করছে। সারা বিশ্বে প্রায় ১০ লাখ মানুষ করোনায় মারা গেছে। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় দুই কোটির উপর। রোগটি এখনও বহাল তবিয়তে আছে। কার্যকরী ঔষধ বা ভ্যাকসিন লাভ হয়ত সুদূর পরাহত। নিশ্চিত কোন ব্যবস্থার দেয়া নেই। আমাদের ভাবতে হবে এ বিশ্বচরাচর শুধু মানুষের একার নয়। সৃষ্টির সকলের ভাগ আছে। মহান আল্লাহ সকলের জন্য সৃষ্টি করেছেন ভূমন্ডল। প্রকৃতিকে নিজ গতিতে চলতে সাহায্য করুন।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)