উত্তরে ৯ ডিগ্রিতে নামল তাপমাত্রা

39

বর্ষপঞ্জিকার হিসাবে সময় এখন পৌষের কাছাকাছি। রোদমাখা হেমন্তের বিদায় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে প্রকৃতিতে তাপমাত্রার পারদেরও পতন ঘটছে। গত কয়েকদিন ধরে কমতে থাকা সর্বনি¤œ তাপমাত্রার পারদ চলতি মৌসুমে প্রথমবারের মত ‘সিঙ্গেল ডিজিটে’ এসে ঠেকেছে। হিমালয়ের সবচেয়ে নিকটবর্তী দেশের উত্তরাঞ্চলের জনপদ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় গতকাল শনিবার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এদিকে, জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে মহাসাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি শীতের ভাগ্য নিয়ে ‘ছিনিমিনি খেলছে’ বলে মনে করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মহাসাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে বায়ুমন্ডলে। এতে করে, বৈশ্বিক উষ্ণতা দিনদিন বাড়ছে । গতকাল শনিবার বিবিসি আন্তর্জাতিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ ও সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার বা আইইউসিএন- এর দীর্ঘ গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণের ফলে মহাসাগরের অক্সিজেন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে তাপমাত্রা। এর ফলে মহাসাগরের অনেক প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ছে। কয়েক দশক ধরে মহাসাগরে পুষ্টির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যহারে কমে আসছে বলে জানানো হলেও এবার গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মহাসাগরে অক্সিজেনের সংকটকে আরও গুরুতর করে তুলছে। আইইউসিএনের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন মহাসাগরের ৪৫টি স্থানে অক্সিজেনের স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এই সংকট বিভিন্ন মহাসাগরের প্রায় সাতশ’ স্থানে পাওয়া গেছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকৃতিতে গ্রিনহাউসের প্রভাব বাড়ছে। ফলে তাপ শোষণ করছে মহাসাগর। বিপরীতে এই উষ্ণ পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে। ১৯৬০ থেকে ২০১০ সালের মাঝে মহাসাগরে দ্রবীভূত গ্যাসের পরিমাণ দুই শতাংশ কমেছে। তবে মহাসাগরে গ্যাসের পরিমাণ কমে যাওয়ার এই রেকর্ড বৈশ্বিক গড় নয়। গ্রীষ্মমন্ডলীয় কিছু অঞ্চলে ৪০ শতাংশ পর্যন্তও কমেছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ খোন্দকার আবদুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ‘জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে মহাসাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঘটনা বৈশ্বিক উষ্ণতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার উর্ধ্বমূখী তাপমাত্রা বায়ুমন্ডলের উষ্ণতাকেও বাড়িয়ে দেয়। আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় তাপমাত্রা বেশি থাকলে তা বঙ্গোপসাগরেও প্রভাব ফেলে। সাগরের তাপমাত্রা বেশি হলে তা বায়ুপ্রবাহকে প্রভাবিত করে। এ কারণে শীতের দাপটে যেমন হেরফের হচ্ছে, তেমনি সময় মেনে শীতকালের চেনারূপের দেখা মিলছে না।’
দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ডকৃত গত এক সপ্তাহের পরিসংখ্যানে চলতি ডিসেম্বরের শুরু থেকেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রার নিম্নমুখী প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। সর্বশেষ গতকাল শনিবার তা প্রথমবারের মত নয় ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। এর আগে গত ৫ ও ৬ ডিসেম্বর পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি, ৪ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ১১ দশমিক চার ডিগ্রি, ৩ ডিসেম্বর একই এলাকায় ১১ দশমিক ছয় ডিগ্রি, ২ ডিসেম্বর তেঁতুলিয়ার নিকটবর্তী রাজারহাটে ১২ দশমিক তিন ডিগ্রি এবং পয়লা ডিসেম্বর তেঁতুলিয়ায় ১৩ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। অবশ্য দেশজুড়েই তাপমাত্রার কমবেশি পারদের নিম্নমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে, শনিবার দেশের সর্বোচ্চ ৩০ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকা কুতুবদিয়ায়। চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূল-সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলের দুয়েকটি বাদে সব এলাকাতেই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি বা তার ওপরে রয়েছে। আর সর্বনি¤œ তাপমাত্রার পারদ ১৪ থেকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই উঠানামা করছে। গ্রামীণ জনপদে সন্ধ্যার নামার পর থেকে ভোর পর্যন্ত কুয়াশার সাথে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার শীত অনুভূত হলেও শহরাঞ্চলে শীত এখনও অতিথি হয়ে উঠতে পারেনি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার দৃশ্যপটে বলা হয়েছে, উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ বিহার এবং তৎসংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে, যার একটি বর্ধিতাংশ উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। আর পূর্বাভাসে বলা হয়, আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। শেষরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের কোথাও কোথাও হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে পরবর্তী আটচল্লিশ ঘন্টা বা দুইদিনে আবহাওয়ার অবস্থায় সামান্য পরিবর্তন এবং তার পরবর্তী পাঁচদিনে রাতের তাপমাত্রা কমতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে জানানো হয়, চলতি মাসের মধ্য এবং শেষভাগে দেশে এক বা একাধিক মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। নতুন বছরের জানুয়ারি (পৌষ-মাঘ) মাসে দেশের ওপর দিয়ে দুই থেকে তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি এবং দু’টি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। একইসাথে শেষরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে এবং নদ-নদী অববাহিকায় মাঝারি অথবা ঘন কুয়াশা এবং অন্যত্র হালকা কুয়াশা পড়তে পারে। কম সময়ের জন্য হলেও শীতের কামড় অনুভূত হবে জানুয়ারি মাসেই। এমনিতেই জানুয়ারি দেশের শীতলতম মাস। পূর্ববর্তী ৫০ বছরের ইতিহাসের পাতা পাল্টে দিয়ে বিগত ২০১৮ ও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দেশের তাপমাত্রা রেকর্ড গড়ে চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমেছিল। ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি আবহাওয়া অধিদপ্তর পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন দুই দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে। এর আগে সিলেট বিভাগের শ্রীমঙ্গলে সবচেয়ে কম দুই দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রূয়ারি। চলতি বছরের জানুয়ারিতেও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমেছিল। এই মৌসুমেও সেরকম পরিস্থিতিরই আভাস দিচ্ছে আবহাওয়া অফিস। তবে, এবারের শীত মৌসুমে তুলনামূলকভাবে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহের স্থায়িত্বকালই বেশি হতে পারে। যাতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পারদ তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসের কিছু কম-বেশি হতে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন।
প্রসঙ্গত, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে মাঝারি এবং আট ডিগ্রির চেয়ে বেশি থেকে ১০ ডিগ্রির মধ্যে হলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে থাকে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।