উত্তপ্ত মধ্য প্রাচ্য, বাংলাদেশ সহ অনেক দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঝুঁকিপূর্ণ করবে

145

আমেরিকার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং তাঁর পর-রাষ্ট্র সেক্রেটারীর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ফ্রান্স, জার্মানী, গ্রেট ব্রিটেন, রাশিয়া এবং চীনের অশেষ আন্তরিকতার ফলে ২০১৫ সালে ইরানের সাথে উপরোক্ত দেশগুলির যে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাতে সমস্ত মধ্য প্রাচ্যে শান্তির সু-বাতাস বইতে শুরু হয়েছিল। ইরানের উপর পশ্চিমা দেশগুলি যে সব অর্থনৈতিক বিধি-নিষেধ আরোপ করেছিল তা ক্রমশ প্রত্যাহার করা হচ্ছিল। তেলের দামে স্থিতিশীলতা, হরমুজ প্রণালী এবং ওমান উপসাগরে শান্তি এবং নিরাপত্তা ফিরে আসা শুরু হয়েছিল। এশিয়া এবং আফ্রিকানদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের চাকরীর বাজার আবার উন্মুক্ত হতে শুরু হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সবাই বুক ভরা আশা ও আকাঙ্খা নিয়ে সুদিনের অপেক্ষায় ছিল। বাংলাদেশের জন্যও একটি শান্ত ও সমৃদ্ধশালী মধ্য প্রাচ্য অতীব প্রয়োজন। কারণ বাংলাদেশর স্বাধীনতার শুরু থেকে বিরাট শ্রম-শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে চাকরী এবং ব্যবসা বাণিজ্য করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করেছে। আজকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে পর্যায়ে পৌছেছে তাতে মধ্য প্রাচ্যের রিবাট অবদান রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৈৗম দেশ হওয়ার অনেক আগে থেকেই মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের বিরাট সংখ্যক মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে তার ধারাবাহিকতা এখনও চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিলারী ক্লিনটনকে নির্বাচনে হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রেকে ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত আণবিক চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে বের করে নিয়ে এলেন। এরপর থেকে হরমুজ প্রণালীতে বাণিজ্যিক জাহাজের উপর অহ-রহ আক্রমণ শুরু হলো। যুক্তরাষ্ট্র কোন যৌক্তিক প্রমাণ ছাড়া এসব আক্রমণের জন্য ইরানকে দোষারোপ করতে শুরু করেন। ইরানের তেলের ট্যাংকার আক্রমণ করা হলো। হোথি বিদ্রোহীরা সৌদি আরবের আরামকো আক্রমণ করল, এই আক্রমণের জন্যও ইরানকে দায়ী করা হলো। প্রতিশোধের স্বরূপ ইরানের জেনারেল কাসেম সোলেমানিকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ইরাকে হত্যা করা হলো। এর আগে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসও আক্রমণ হয়েছিল।
ইরান সোলেমানিকে হত্যার প্রতিশোধস্বরূপ ইরাকের অভ্যন্তরে মার্কিন সেনা ক্যাম্পও আক্রমণ করল। ইরানের আকাশে উড়ন্ত অবস্থায়, ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান ইরানের সেনা বাহিনীরগুলিতে ভূপাতিত হলো এবং ১৭৬ জন যাত্রী প্রাণ হারালো। শেষ পর্যন্ত ইরান নিজেরাই ঘোষণার মাধ্যমে স্বাক্ষরিত আণবিক চুক্তি থেকে বের হয়ে গেলো। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে আবার ভয়াবহ আগুন জ্বলতে আরম্ভ হলো। মধ্যপ্রাচ্যে যে শান্তি কায়েম হওয়ার আশা দেখা দিয়েছিল তা নিমিষে সমাপ্ত হয়ে গেলো। ইরানের সাথে বৃহৎ-শক্তি গুলির আণবিক নিরস্ত্রীকরণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর বাংলাদেশসহ যে সব দেশের শ্রম রপ্তানীর একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তা এক নিমিষে উড়ে গেল। এখন প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক মধ্য প্রাচ্য থেকে ফেরত চলে আসছে। তেলের মূল্য বৃদ্ধি, হরমুজ প্রণালী এবং ওমান উপসাগর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যে রক্তপাত বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ঐ এলাকায় চাকরীর বাজারেও ধস্্ নেমেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশকে উল্লেযোগ্য পরিমাণ জ্বালানি তৈল মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলি থেকে আমদানী করতে হয়। বাংলাদেশে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন হিসাবমতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বাৎসরিক ৭লক্ষ টনের মতো অশোধিত তেল শুধু সাউদী আরবের আরামকো থেকে আমদানী করে। বাংলাদেশের প্রায় ১৩ লক্ষ টনের মতো অশোধিত তেলের প্রয়োজন হয়। কাজেই তেলের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে দাাঁড়াবে। এই সমস্যার শিকার অন্যান্য তেল আমদানীকারক দেশেও হবে। কাজেই এই পরিস্থিতির কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতি একটি মারাত্মক আকারের এবং ভয়াবহ সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে।
ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা শিবিরে ইরানের আক্রমণের পর তেলের দাম প্রতি ব্যারল ৭১.৫ ডলারে উঠে যায়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর ইহাই সবোর্চ্চ দাম ছিল। ২০১৯ সালের সেপ্টম্বর মাসে সাউদী আরবের আরামকো আক্রমণের পর তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। তখন বাংলাদেশে বিশোধিত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের দাম ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। যখন এনার্জির দাম বেড়ে যায় তখন অর্থনীতির প্রতি ক্ষেত্রে দাম বাড়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
বর্তমানে প্রায় ৬০ লক্ষের মতো বাংলাদেশী শ্রমজীবি মধ্যপ্রাচ্যে চাকুরীরত আছে, এদের মধ্যে অনেকেই ইরানে চাকরীরত রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। এক হিসাবে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের শ্রমজীবীরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে রেমিটেন্স পাঠিয়েছে তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বিরাট অবদান রেখেছে। হিসাবমতে এই বৈদেশিক মুদ্রা জিডিপিতে ১২ শতাংশ অবদান রেখেছে। এক হিসাবে দেখা যায় ২০১৮ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশের কর্মজীবীরা ১৮ বিলিয়ন ডলারের মতো বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন এবং ইহা বিদেশ থেকে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার ৬০ শতাংশ। কাজেই মধ্যপ্রাচ্যে যে কোন অশান্ত পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আমাদের অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের অর্থনীতি যে চ্যালেঞ্জ এর সম্মুখীন হবে তা মোকাবিলা করা আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
অতীব দুঃখের বিষয় বিভিন্ন সরকারের অন্যায় পৃষ্ট পোষকতায় আমাদের দেশে একটা শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে যাহা অহ-রহ বিভিন্ন উপায়ে অবৈধভাবে দেশ থেকে টাকা পাচার করে বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, এইগুলি আবার নিজেদের উপার্জিত আয় নহে। ব্যাংক থেকে বিভিন্ন কৌশলে টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। যে কোন শক্তিশালী সরকার হউক না কেন এই টাকা বিদেশে থেকে ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এই পরিস্তিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে যদি আমাদের লোকগুলি বেকার হয়ে ফিরে আসে তাহলে আমাদের অর্থনীতি যে অবস্থার সৃষ্টি হবে তা মোকাবিলা করা আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমাদের রপ্তানী বাণিজ্যও নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যে যে সব রপ্তানী সরাসরি করে, যদি সেখানে সর্বাত্মক য্দ্ধু শুরু হয় তাহলে সে রপ্তানী বন্ধ হযে যাবে। বাংলাদেশ রপ্তানী ব্যুারোর হিসাব মতে বাংলাদেশ প্রায় ৩৭৩ মিলিয়ন ডলার মূল্যোর বিভিন্ন পণ্য ইরান, ইরাক, সৌউদী আরব, কাতার, এবং ইউ.এ.ই. তে ২০১৯ সালের জুলাই ও ডিসেম্বরের মধ্যে রপ্তানী করেছে। যা হলো বাংলাদেশের বাৎসরিক রপ্তানীর মাত্র ২ শতাংশ। কাজেই এই হিসাব থেকে বুঝতে পারা যায় যদি বড় আকারের মধ্যপ্রাচ্যে কোন যুদ্ধ হয় তাহলে আমাদের রপ্তানী বাণিজ্যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে।
ইহা ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক আকারে যুদ্ধ শুরু হলে হরমুজ প্রণালী এবং ওমান উপসাগর দিয়ে দিয়ে যে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করবে সে পণ্যের ইনসুরেন্স চার্জ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের গার্মেন্টস পণ্যের বিরাট ক্রেতা। প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্টেস পণ্য যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আমদানী করে। জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি এবং অন্যান্য কারণে আমাদের এই বিশাল রপ্তানী বাণিজ্য সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
যাই হউক, সৌভাগ্যবশতঃ যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস মধ্য প্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে ভীষণ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং বর্তমানে সিনেট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুদ্ধ যোষণা করার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সীমিত করার ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছেন। বিশেষ করে ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসন কোন যুদ্ধের উদ্যোগ নিতে না পারে, সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। এই সব চাপের ফলে ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলকে দেওয়া চিঠিতে লিখেছেন ইরানের বিরুদ্ধে কোন সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের যুক্তরাষ্ট্রের কোন ইচ্ছা নেই। ইতিমধ্যে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ঘোষণা করেছেন যে ইরানের যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছাই নেই।
অবশ্য এতে বিশ্বে যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নাই। কারণ যুদ্ধের কারন অন্য জায়গায় নিহিত। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পররাষ্ট্র সেক্রেটারী এবং আমেরিকাও চীনের মধ্যে প্রথম সেতুবন্ধনকারী, তদানীন্তন বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ড: হেনরী কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বিশ্বে অশান্তি সৃষ্টির কারণ অন্য জায়গায় নিহিত। তার ভাষায়, ‘A world in which a few nations constitute islands af wealth in a sea of despair is fundamentally insecure and morally intolerable’ অর্থাৎ “বিশ্বে যদি গুটিকতক জাতি হতাশার সমুদ্রে সম্পদের অল্প-সংখ্যক দ্বীপ গড়ে তোলে তা মৌলিকভাবে নিরাপত্তাহীন এবং নৈতিকভাবে অসহনীয় হবে।

লেখক : কলামিস্ট