উজ্জ্বল পরমায়ুর জন্য চাই অনাবিল প্রাকৃতিক পরিবেশ

221

চাই স্বাস্থ্য উজ্জ্বল পরমায়ু। আর সেই পরমায়ু পেতে হলে চাই নির্মল বায়ু, অনাবিল প্রাকৃতিক পরিবেশ। যে পরিবেশ স্বাস্থ্যকে রাখে সতেজ, চিত্ত করে তোলে আনন্দময়। বিশেষ করে দেহ মনে জাগায় পরম প্রশান্তি। কিন্তু শহুরে মানুষের ভাগ্যে তার কতটুকু জোটে ? নির্মল বায়ুর পরিবর্তে শহুরে লোকেরা প্রতিনিয়ত শ্বাস গ্রহণ করে পচা দুর্গন্ধে ভরা ধোঁয়াবালি মিশ্রিত দূষিত বায়ু। আর তাতেই বেড়ে উঠছে আমাদের আগামী প্রজন্ম। যে প্রজন্ম শুরুতেই খুইয়ে বসছে সজীব সতেজ ফুসফুসের প্রাণশক্তি। যে অফুরান প্রাণচাঞ্চল্য আর অমিত সম্ভাবনা নিয়ে তাদের বেড়ে উঠার কথা বৈরী পরিবেশের কারণে তা হচ্ছে নিয়ত ব্যাহত।
পরিবেশের সঙ্গে প্রত্যেক মানুষের সম্পর্ক অতীব নিবিড়। কেবলমাত্র অনুক‚ল পরিবেশেই প্রাণি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। কিন্ত বড় দুঃখের বিষয় মানবসৃষ্ট কর্মকান্ডের কারণে পৃথিবীর জল, স্থল, বায়ুমন্ডল আজ দূষিত। এ দূষণ শুধু আমাদের দেশের নয়, সমস্ত বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এ পৃথিবীতে প্রথম জীবন সৃষ্টির সময় জল, স্থল, বায়ুমন্ডল কোনটাতেই খাদ ছিল না। ছিল নিখাদ, নির্ভেজাল, দূষণমুক্ত। মানুষ যখনই প্রকৃতিকে জয় করতে চেয়েছে, শুরু করেছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই তখন থেকেই শুরু হয়েছে পরিবেশ দূষণ। পৃথিবীর পরিবেশ আজ হুমকির সম্মুখীন। প্রকৃতি হারিয়ে ফেলেছে তার স্বাভাবিক ভারসাম্য। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঘটছে পরিবেশের দ্রুত অবক্ষয়। এ অবক্ষয়ের ধারায় দক্ষিণ এশিয়ার এ ছোটো দেশটির অবস্থা আরো করুণ ও ভয়াবহ। ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকার বায়ু সুস্থ জীবনের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এই কিছুদিন আগেও মেক্সিকোকে ধরা হতো পৃথিবীর সবচেয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের নগরী হিসেবে। কিন্তু এখন সে মেক্সিকোকে ছাড়িয়ে গেছে ঢাকার বায়ু দূষণের মাত্রা। ঢাকা মহানগরীর রাস্তাঘাট এখন একটি গ্যাস চেম্বারের মতো।
কীভাবে ঘটছে এই বায়ুদূষণ ? ব্যাপারটা সচেতন মানুষের একেবারেই যে জানা নেই তা কিন্তু নয়। বায়ু দূষণের জন্য মানুষের প্রাত্যহিক কর্মকান্ডই কম বেশি দায়ী। মানুষ না জেনে না বুঝে তা করছে তা বলার কোনো কারণ নেই। এই যেমন যেখানে সেখানে থুথু ফেলা, নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে ময়লা ফেলা। এ সব আচরণ একজন মানুষ খুব সহজে পরিহার করতে পারে। তার জন্য প্রয়োজন একটু চিন্তা, একটু সচেতনতা। মানুষ কী অনুভব করে না খোলা ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যেতে তার মতো সবারই গন্ধ লাগে। জানেন না থুথু থেকে রোগজীবাণু ছড়িয়ে বাতাসে মিশে অন্যের শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে আরেকজন অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। আমাদের দেশে গ্রামের তুলনায় শহরে বায়ুবাহিত রোগের প্রকোপ বেশি। এজন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ি পথচারী আর আশপাশের বাসিন্দাদের অসচেতনতা।
আমরা অনেকেই জানি, সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড বায়ু দূষণের প্রধান দুটি উপাদান। এই দুটো উপাদান সাধারণত গাড়ি থেকে এবং কলকারখানা থেকে বিপুল মাত্রায় নির্গত হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি জনবহুল শহরে প্রতিদিন অসংখ্য মোটর যান ছড়িয়ে দেয় কালো ধোঁয়া। এসব যানবাহনের যথাযথ সংরক্ষণ না করা, জ্বালানি তেলে ভেজাল মেশানো, ত্রুটিযুক্ত ইঞ্জিনের ব্যবহার, এ সব কারণে নির্গত হয় ক্ষতিকর ধোঁয়া। দুই স্ট্রোক ইঞ্জিন বিশিষ্ট যানবাহনে জ্বালানি তেলের সাথে মোবিল মিশে অদগ্ধ অবস্থায় যখন বের হয় তখন পরিবেশ মারাত্মকভাবে কলুষিত হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিশেষ বিশেষ জায়গায় যানজট একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার। যানজটসৃষ্ট এলাকাগুলোতে কালো ধোঁয়া প্রায়ই চারপাশকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বিষ। নিশ্বাসের সাথে সে বিষ আমাদের শরীরে ঢুকে আমাদের প্রাণশক্তির স্বাভাবিক প্রবাহকে করে দূষিত। বাংলাদেশে ফুসফুসের রোগীর সংখ্যা বাড়ার জন্য কালো ধোঁয়ার পাশাপাশি অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ অনেকাংশে দায়ী। যেসব ব্যক্তি মুরগি খামারে কাজ করেন বা বিক্রয়কেন্দ্রে কাজ করেন তাদের ফুসফুসের প্রদাহ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এ ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পকারখানা থেকে বিষাক্ত পদার্থ ও ধোঁয়া নির্গমন, খোলা ডাস্টবিন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা প্রভৃতি পরিবেশ বিরোধী মানুষের নানা কর্মকান্ড ও বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ু দূষণে উদ্ভুত অবস্থার প্রথম শিকার হয় কোমলমতি শিশুরাই। তারপর বয়স্ক তথা দীর্ঘদিনে কাশি, শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানীর রোগীরা। শিশুদের শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো খুবই নাজুক ও স্পর্শকাতর। তাছাড়া তাদের ফুসফুস বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিকাশমান থাকে। এ অবস্থায় বেশি ও দ্রুত শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে বেশি দূষিত বায়ু তাদের ফুসফুসের সংস্পর্শে আসে। ফলে শিশুদের শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা বহুলাংশে বেড়ে যায়। নেদারল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা ছয় শতাধিক শিশুর উপর ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন একই মাত্রার বায়ু দূষণে বড়দের তুলনায় শিশুরা ভোগে দ্বিগুণ শ্বাসকষ্টে। তাঁদের মতে, যেসব শহরে পেট্রোলিয়াম জাতীয় জ্বালানি অতিরিক্ত ব্যবহার হয় সেখানকার শিশুদের বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশ অন্য শিশুদের তুলনায় কম ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ হলো, দীর্ঘদিন ধরে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ার আশেপাশে যেসব শিশুরা বেড়ে উঠে তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ও উন্নয়ন চরমভাবে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। একই সময়ে বায়ু দূষণের উপাদানসমূহ বড়দের বেলায় অ্যাজমায় আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় ১৩০ ভাগ। তাছাড়া বায়ু দূষণের ক্ষতিকর উপাদানের সূ²কণাসমূহ আকার আয়তনে অতি ক্ষুদ্র হলেও খুবই সক্রিয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, বায়ুর এসব ক্ষতিকর উপাদানের অণুপরমাণুগুলো রক্তের জমাট বাঁধা ক্ষমতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রক্ত সঞ্চালনের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হলেই হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বায়ুর ভয়াবহ দূষণরোধে সরকার ও জনসাধারণের করণীয় আছে অনেক কিছুই। একা সরকারের পক্ষে জনস্বাস্থ্যের এ ভয়াবহ সমস্যার মোকাবিলা মোটেই সম্ভব নয়। জনসাধারণের মধ্যে যদি দায়িত্ববোধ ও সচেতনতাবোধ ক্রিয়াশীল না হয় তাহলে যে কোনো শুভ উদ্যোগ সুফল বয়ে নাও আনতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন যার যার অবস্থান থেকে সঠিক ও দায়িত্বপূর্ণ আচরণ। একমাত্র সমষ্টিগত উদ্যোগই পারে বায়ু দূষণের মতো ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ থেকে নিজেকে এবং আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে। শহরে যেহেতু যানবাহনের ধোঁয়াই মূলত বায়ু দূষণের জন্য দায়ি। সেজন্য যানবাহন থেকে যাতে কালো ধোঁয়া শতকরা ৬৫ হার্টরিজ স্মোক ইউনিক বা এইচএসইউ এর বেশি নির্গত না হয় এবং নির্গত ধোঁয়ায় যাতে ক্ষতিকর পদার্থ বেশি না থাকে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
এজন্য ক্ষতিকর যানবাহন আমদানি নিষিদ্ধ, ত্রুটিযুক্ত বাস, ট্রাক, কার, জিপ চিহ্নিত করে এগুলোর রোড পারমিট বাতিল, সীসাযুক্ত পেট্রোলের ব্যবহার বন্ধকরণ, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনার না ফেলার জন্য জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা জোরদারকরণ, সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা কর্তৃক নিয়মিত আবর্জনা অপসারণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতি সর্বোপরি পরিবেশ আদালত যথাযথ কার্যকর করার মাঝেই নিহীত আছে আগামী প্রজন্মের জন্য একটা সুস্থ, নিরোগ, নির্মল পৃথিবী। তাই যদি না হয়, তবে আগামী দিনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ অশনি সংকেত।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক