ঈদ-আনন্দ

3

মো. দিদারুল আলম

এক মাস সিয়াম সাধনার শেষে হিজরী বর্ষের দশম মাস শাওয়ালের এক তারিখ ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হয়। ঈদ মানে আনন্দ আর খুশি। ঈদ মানে কোলাকুলি, করমর্দন। বিশেষ করে কোমলমতি শিশুদের উচ্ছ¡াস আর উল্লাসের আনন্দদিন। এছাড়া স্বজন আর বন্ধুদের মিলনমেলা, হইহুল্লোড়, ঘুরে বেড়ানো, প্রতিবেশীদের নিয়ে খাওয়া-দাওয়া ও আড্ডায় জমে ওঠে ঈদ উৎসব।
মহিমা আর ভ্রাতৃবোধের বার্তা নিয়ে পবিত্র ঈদুল ফিতর আমাদের মাঝে সমাগত। ঈদ কেবল বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবই নয়, সুস্থ আনন্দ-বিনোদন এবং মিলনমেলাও।
ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য কারোর মধ্যেই যেন চেষ্টা ও আন্তরিকতার অভাব নেই। চারদিকে ঈদের আগমনী সুর ঝঙ্কৃৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছোট-বড় সবার মনে আনন্দের ফানুস উড়তে থাকে। নাড়ির টানে মানুষ ছুটে চলে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। নিজ ঘরে কিংবা গ্রামে ফেরার সে যে কী ব্যাকুলতা, তা বলে বোঝানো দুষ্কর। মানুষ ছুটে চলে তার আপন ঠিকানায়- জন্মভূমিতে। ঈদুল ফিতরের ধর্মীয় মাহাত্ম হলো আত্মত্যাগের মহিমায় নিজেকে শাণিত করা। ইসলাম ধর্ম যে সাম্য-মৈত্রী ও ভাতৃত্বের দীক্ষা দেয় ঈদ প্রতিবছর সেকথাই মনে করিয়ে দেয়। ঈদ ধনী-গরিবের বৈষম্য বিলীন করে দেয়। একই কাতারে দাঁড়িয়ে একই আনন্দে হারিয়ে সাম্যের নিদর্শন স্থাপনই ঈদুল ফিতরের প্রধান শিক্ষা।
সুন্নত তরিকা হল ঈদের নামাজের আগে গোসল করে নেওয়া, পরিষ্কার পোশাক পরে আতর-সুগন্ধি মেখে ঈদগাহে যাওয়া, সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হলে ঈদের নামাজের আগে তা আদায় করে দেওয়া, হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া, সম্ভব হলে এক রাস্তায় যাওয়া, অপর রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা, ঈদগাহে যাওয়ার আগে মিষ্টিমুখ করে নেওয়া, ঈদগাহের দিকে ধীরস্থিরভাবে যাওয়া, নামাজ শেষে আত্মীয়-স্বজনের কবর জিয়ারত করা, ঘরে ফিরে চার রাকাত নফল নামাজ পড়া।
বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে ঠাঁই নেই, তবুও বাড়িতে যেতে হবে। বাসে, ট্রেনের কামরায় ভেতরে দাঁড়িয়ে, সেখানে ঠাঁই না হলে ছাদে। লঞ্চেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্লোরে বসে, ডেকে দাঁড়িয়ে এমনকি ছাদের ওপর বিছানা পেতে সেখানেই গন্তব্যের জন্য বসে পড়া। ঈদকে সামনে রেখে প্রতিবছর একই অবস্থা হয়। যেভাবেই হোক বাড়িতে পৌঁছাতেই হবে। এ যেন দৃঢ়চেতা অদম্য মানসিকতা। এ টান যে বড় বেশি প্রাণের। এ টান নাড়ির। দুনিয়ার কোথাও কি মানুষ এভাবে ছোটে প্রাণের টানে, শেকড়ের সন্ধানে? অবশ্য এবার সরকার আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে।
বাঙালি সব প্রতিকূলতা মাড়িয়ে মেতে উঠবে ঈদ-আনন্দে। মনের আনন্দই দেহের শক্তির উৎস। মানুষ মাত্রই আনন্দের কাছে নিবেদিত হতে চায়। আমরা চাই না, কারও আনন্দ এবার বিষাদে রূপ নিক। কেউ স্বামী-সন্তানহারা হোক। অথবা হোক কেউ স্ত্রী কিংবা ভাইবোন হারা। এত ঝক্কি ঝামেলার মধ্যেও প্রকৃত আনন্দ নিয়ে বাঙালির প্রতিটি ঘরে আসুক ঈদ।
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, প্রত্যেক জাতির জন্য রয়েছে উৎসবের দিন। মুসলিম উম্মাহর উৎসবের দিন হচ্ছে ঈদের দিন। কেন এ ঈদ উৎসব? এর কারণ হলো, দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে একজন মুসলমান প্রকৃত মানুষ হওয়ার, আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির, মাগফিরাত লাভ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি অর্জনের যে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে সেই প্রচেষ্টারই একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হচ্ছে খুশির ঈদ।
অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঈদের নামাজ আদায়ের আগে ফিতরা দিয়ে তাদের ঈদের আনন্দে অংশগ্রহণ করানোর নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। ঈদের দিন আমির-ফকির সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে আদায় করতে হয় দু’রাকাত ওয়াজিব নামাজ। খুতবা শোনা একটি অপরিহার্য বিষয়। এদিন দান-খয়রাত করার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ঈদের আগের রাতে ইবাদত-বন্দেগি করার কথা বলা হয়েছে সহিহ হাদিসে। একই সঙ্গে ঈদের জামাতে যাতায়াতকালে, খুতবার সময় তাকবির ধ্বনি দিতে হাদিসে বলা হয়েছে।
ঈদুল ফিতর নেক বান্দাদের জন্য খুশির দিন। যারা রোজা পালন করেছেন, তাদের জন্য আরও বেশি আনন্দ ও উৎসবের দিন ঈদুল ফিতর। সাহাবি হজরত ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ (রা.) ঈদের দিন কাঁদছিলেন। কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আজ খুশির দিন ওই ব্যক্তির জন্য, যার রোজা কবুল হয়েছে।
এবারের ঈদে আমাদের একান্ত প্রত্যাশা রাষ্ট্র ও সমাজ সব সমস্যা-সংকট কাটিয়ে উঠুক। মজবুত হোক আমাদের জাতীয় ভ্রাতৃত্ববোধ। সব ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দল-মতের মানুষের মধ্যে গড়ে উঠুক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের অটুট বন্ধন। সহনশীলতা, সহাবস্থান ও পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা হোক সমাজের সর্বত্র। ঘুচে যাক ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু ও ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীনের ফারাক। ঈদের আনন্দে ধুয়ে-মুছে যাক সব দু:খ-গøানি। ঈদ-আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক