ইয়াবা পাচার অপ্রতিরোধ্য

105

টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মরণনেশা ইয়াবার পাচার কার্যত অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণার পর তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিদের অনেকে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত, আত্মসমর্পণ ও আত্মগোপন এবং গ্রেপ্তারে হয়ে কারাগারে গেলেও মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ইয়াবার চালান নিয়ে আসা বন্ধ হয়নি। সীমান্তের কোনও না কোনও পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবার চালান দেশে ঢুকছেই।
সীমান্তরক্ষায় নিয়োজিত বর্ডার গার্ড, এলিট ফোর্স র‌্যাব ও পুলিশের সর্বাত্মক অভিযানে সাম্প্রতিক সময়ে ইয়াবার বড় কয়েকটি চালান ধরা পড়েছে। এসময় পাচারের সাথে জড়িত রোহিঙ্গা ও নারীসহ বেশ কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ১৭ লাখ ৪২ হাজার ৯৭০ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। সর্বশেষ গত শুক্রবার ভোরে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গীখালী এলাকায় র‌্যাব-৭-এর জব্দকৃত আট লাখ ১৪ হাজার ৯৭০ পিস ইয়াবার চালানটিই চলতি বছরের সবচেয়ে বড় ইয়াবার চালান।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে গত দেড় বছরে টেকনাফে ইয়াবা পাচারে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত দেড় শতাধিক ব্যক্তি কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছে ১০২ জন। আত্মগোপনে রয়েছেন অনেকেই। এদের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিও রয়েছে। এত অভিযানের পরও সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে আসা বন্ধ হওয়ার বদলে নতুন করে বেড়ে যাওয়ার ঘটনা সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে।
বিজিবির টেকনাফ অঞ্চলের অধিনায়ক ফয়সাল হাসান খান ও র‌্যাব ১৫-এর অধিনায়ক মো. আজিম আহমেদও মনে করেন, মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরুর পরও আগের মতোই ইয়াবা জব্দ হচ্ছে। যেটুকু ধরা পড়ছে, তা চালানের ৫ থেকে ১০ শতাংশ মাত্র। এর কারণ, ইয়াবার গডফাদারদের অনেকেই এখনও আত্মসমর্পণ করেনি। অনেকে আত্মগোপনে থাকলেও কেউ কেউ এলাকায় অবস্থান করছে। তারা আবার জনপ্রতিনিধিও। আত্মগোপনে থাকা গডফাদাররা তাদের ঘনিষ্ঠ লোকদের মাধ্যমে ইয়াবার কারবার অব্যাহত রেখেছে।
গত বছর মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কক্সবাজারে ৭৩ জন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী বা গডফাদারের তালিকা করেছিল। তারা প্রায় সকলেই টেকনাফের বসিন্দা। তাদের মধ্যে আত্মসমর্পণ করেছেন কেবল ২৯ জন। এর মধ্যে আবার ১৩ জনই সাবেক সাংসদ বদির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। দশজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। বাকিরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছে।
ইয়াবা পাচার রোধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জিরো টলারেন্স নীতিই বাস্তবায়ন করছে দাবি করে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ইয়াবা পাচার রোধে পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ইয়াবার কারবারিদের অনেকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। আত্মসমর্পণ করেছে তালিকাভুক্তদের অনেকে। তবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষকেও এ ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে। তাহলেই ইয়াবা পাচার পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হবে।
এদিকে, ইয়াবার চালান নিয়ে আসা বেড়ে যাওয়ার মধ্যেই গত শনিবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গিখালী গাজী পাড়ার পশ্চিমে পাহাড়ে পুলিশের সাথে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নয়াবাজার এলাকার দিল মোহাম্মদের ছেলে ও শীর্ষ ইয়াবা কারবারি মো. আমিন (৩২) ওরফে নুর হাফেজ ওরফে বার্মাইয়া হাফেজ ও হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গীখালী এলাকার সাব্বির আহমদের ছেলে মোহাম্মদ সোহেল (২৭) নিহত হয়েছেন। এসময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৯৫ হাজার ইয়াবা, ৬টি দেশিয় এলজি, ১৮ রাউন্ড গুলি ও ১৩ রাউন্ড খালি খোসা উদ্ধার করেছে। বন্দুকযুদ্ধে নিজেদের পাঁচ সদস্য আহত হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। যদিও বন্দুকযুদ্ধে নিহত দু’জনসহ সৈয়দ নুর (২৮) এবং সৈয়দ আলম কালু (৪৫) নামে অপর দু’জনকে র‌্যাব-৭ আগের দিন ইয়াবার বড় চালানসহ গ্রেপ্তারের পর থানায় হস্তান্তর করেছিল।
এর আগে গত ১০ ডিসেম্বর টেকনাফে পৃথক দুটি অভিযানে দুই লাখ ৮০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করেছে কোস্টগার্ড। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। একইদিন ভোরে হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুরা এলাকায় বিজিবি সদস্যরা অভিযান চালিয়ে এক লাখ ২০ হাজার ইয়াবা জব্দ করে। এসময় বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ইমাম হোসেন (২৫) নামে এক পাচারকারী নিহত হন। গত ১ ডিসেম্বর হোয়াইক্যং আমতলী এলাকা থেকে ৩০ হাজার ইয়াবাসহ জয়নাল নামে এক ইয়াবা কারবারিকে আটক করে বিজিবি সদস্যরা। একই দিন রাতে র‌্যাব-১৫ টেকনাফ ক্যাম্পের অভিযানে জাদিমুরা এলাকা থেকে দুই লাখ ইয়াবাসহ আবুল কালাম নামে এক রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। একই দিন বিজিবি জওয়ানরা মৌলভী বাজার এলাকা থেকে আসমা খাতুন নামে এক নারীকে তিন হাজার ৯৫০ পিস ইয়াবাসহ আটক করেন। পরদিন দুই ডিসেম্বর বিজিবি জওয়ানরা হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পূর্ব সাতঘরিয়া পাড়া এলাকায় আব্দুল মজিদের বসতভিটায় অভিযান চালিয়ে ৪০ হাজার ইয়াবাসহ বাড়ির মালিককে আটক করেন। তিন ডিসেম্বর বিজিবি জওয়ানরা দমদমিয়া ১৪ নম্বর ব্রিজ এলাকায় অপর এক অভিযানে দেড় লাখ ইয়াবাসহ দুই পাচারকারীকে আটক করতে সক্ষম হন। চার ডিসেম্বর বিজিবি জওয়ানরা লেদা এলাকা হতে ৬০ হাজার ইয়াবা ও অস্ত্রসহ হ্নীলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোতালেব ফরহাদকে আটক করেন। ৭ ডিসেম্বর ভোরে বিজিবি জওয়ানরা জাদিমুরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে মিয়ানমার থেকে নাফ নদী সাঁতরে ৪৪ হাজার ইয়াবার চালান নিয়ে আসা রোহিঙ্গা হাফেজ আহমদকে আটক করেন। বিজিবির হিসাবে, গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে কক্সবাজার সীমান্তে তাদের অভিযানে এক কোটি ২৩ লাখ ৪৯ হাজার ৪৫৮ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। আটক করা হয় ৭৪৮ ইয়াবা কারবারিকে। আর চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে উদ্ধার হয়েছে ৫৩ লাখ ৬৩ হাজার ২৫৫ পিস ইয়াবা।