ইসিতে গ্রেপ্তার-বদলি আতঙ্ক

80

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক তদন্তেই রোহিঙ্গাদের ভোটার করার সাথে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের সম্পৃক্ততার বিষয়টি ওঠে আসে। নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক তদন্তেও একই চক্রের অস্তিত্ব পায় তদন্ত কমিটি। মামলার প্রেক্ষিতে গ্রেপ্তার হন ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের পিয়ন জয়নাল আবেদীনসহ তিনজন। গতকাল চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আবু ছালেহ মো. নোমানের আদালতে জয়নাল ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এতে রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসের বেশ কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম প্রকাশ করেছেন জয়নাল।
সিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘জয়নাল আবেদিন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে অনেক তথ্য দিয়েছেন। আমরা রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদকালেও একই তথ্য পেয়েছিলাম। এমন অপকর্মে যাদের নাম আসবে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হবে।’
জানা যায়, নির্বাচন কমিশনে পৃথক দুটি সিন্ডিকেট রোহিঙ্গাদের ভোটার পাইয়ে দিতে কাজ করতো। ৫০-৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে তারা এ অপকর্মের সাথে যুক্ত ছিল। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারকৃত জয়নাল রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অর্ন্তভুক্তি ও এনআইডি পাইয়ে দেয়ার সাথে যারা জড়িত ছিলেন তাদের নাম প্রকাশ করেছেন। এতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসের কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা, স্থায়ী ও আউটসোর্সিং কর্মচারী, একসময়ে চট্টগ্রামে থাকলেও পরে বদলি হয়ে যাওয়া এবং এখনো বিভিন্ন নির্বাচন অফিসে কর্মরত কয়েকজনের নাম প্রকাশ করেন। পুরো প্রক্রিয়ার সাথে যারাই জড়িত ছিলেন তাদের নামই আদালতে জানিয়েছেন পিয়ন জয়নাল। আউট সোর্সিংয়ে নিয়োজিত মোস্তফাকেও রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। সেও ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের ভোটার করে দিতে নিজের সম্পৃক্ততার কথা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের বড়ধরনের এ কেলেঙ্কারির পর থেকে গ্রেপ্তার ও বদলি আতঙ্কে আছেন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা ও গ্রেপ্তারকৃতদের তথ্যে অনেকের নাম গণমাধ্যমে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার দুদক চূড়ান্ত তদন্তের জন্য চেয়ারম্যান বরাবরে আবেদন করেছেন। অনুমোদন মিললেই বিস্তারিত তদন্ত শুরু করে ভয়াবহ এ দুর্নীতির গোমর ফাঁস করতে চায় দুদক।
দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জাফর সাদেক শিবলী পূর্বদেশকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে আমরা চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছি। রোহিঙ্গাদের ভোটার করার সাথে যারাই জড়িত তাদের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি। বিষয়টি তুলে ধরে চূড়ান্ত তদন্তের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছি।
দুদক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের এনআইডি কার্ড পাইয়ে দিতে সবধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে সংঘবদ্ধ চক্র। এ কার্ড প্রাপ্তিতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করেছে একাধিক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও জণপ্রতিনিধিরা। কারা এসব কাগজ দিয়েছে তাদেরকেও শনাক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে নির্বাচন কমিশনের সাতজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদ অনুসন্ধানের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে।
দুদক, ইসি ও পুলিশের তদন্তে নির্বাচন অফিসের বেশ কয়েকজনের নাম বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে রয়েছেন, ইসির প্রধান কার্যালয়ের এনআইডি প্রকল্পের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট শাহনুর, গ্রেপ্তারকৃত জয়নালের খালাতো ভাই বর্তমানে কক্সবাজারে কর্মরত মোজাফ্ফর, ভগ্নিপতি নুর আহমদ, রাঙামাটি জেলা নির্বাচন অফিসের উচ্চমান সহকারী মোহাম্মদ আলী, ইসি সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ওসমান গণি, জেলা নির্বাচন অফিসের অস্থায়ী অপারেটর সৈকত বড়ুয়া, ডবলমুরিং নির্বাচন অফিসের শাহ জামাল, পাভেল বড়ুয়া, জনপ্রিয় বড়ুয়া, বয়ান উদ্দিন, মিরসরাই নির্বাচন অফিসের অফিস সহকারী আনোয়ার, পাঁচলাইশ নির্বাচন অফিসের হোসাইন পাটোয়ারী, দালাল নজিবুল্লাহ, জাফর, পাঁচলাইশ নির্বাচন অফিসের অপারেটর তাসলিমা আক্তার, বাঁশখালী নির্বাচন অফিসের জাহিদ হোসেন, কক্সবাজার সদর নির্বাচন অফিসের অপারেটর নঈম ইসলাম, রামু নির্বাচন অফিসের অপারেটর হিরো, ইয়াসমিন আক্তার রুপা, ফারজানা আক্তার ও শাহানুর মিয়ার মামা শহীদুল্লাহ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসের দুইজন কর্মকর্তা-কর্মচারী পূর্বদেশকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ভোটার জালিয়াতির সাথে যারাই জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করা হোক। কিন্তু এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পক্ষ-বিপক্ষে থাকা অনেকেই জলঘোলা করতে চাইছে। ইসিতে কর্মরত এমন কেউ কেউ এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একে অপরকে ঘায়েল করতে চাইছে। তদন্তের সময়েও বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে মতামত দিয়েছে। যা তদন্তে জড়িতরা আমলে নিয়েছেন। এখন সবার মধ্যে একপ্রকার ভীতি কাজ করছে। ঢালাও বদলি ও গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে।’