ইসলামে সাধনার স্বাদ (৩)

34

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

মনীষীরা বলেছেন, জগতের সমস্ত কিতাব যদি হারিয়ে যায় আর একটি মাত্র কিতাব ‘ইহইয়া উলুমুদ্দীন’ যদি মানুষের হাতে থাকে ইসলাম ধর্ম অমর অক্ষয় অব্যয় হয়ে থাকবে মহাপ্রলয়ের শেষ রজনী পর্যন্ত।
সে অমর গ্রন্থের রচয়িতা জগৎ বিখ্যাত ইসলামী দার্শনিক হযরত ঈমান গাযযালী (রহ.)। ছাত্র জীবনে তাঁর কিছু মনে থাকতো না। ডায়েরি পর ডায়েরি লেখতেন আর জমানো তথ্যগুলো বার বার পাঠ করতেন। একদিন ডাকাতদল তাঁর সব কিছু লুঠ করে নিয়ে যায়। শুধু কাপড়ের ভাঁজে থাকা তিনটি সোনার মোহোর তারা খোঁজে পায়নি। সে মোহোর হাতে নিয়ে ঈমাম গাজ্জালী (রহ.) ডাকাত দলের পিছনে দৌড়তে থাকেন। আর বলতে থাকেন, তোমরা আমার তিনটি স্বর্ণের মোহোর খুঁজে পাওনি, এগুলো নিয়ে যাও, আমার ডায়েরিগুলো দিয়ে যাও। ডাকাত সরদার মোহোরগুলো হাতে নিয়ে জানতে চান, তোমার ডায়েরিগুলোতে কী আছে? তিনি জানালেন, ‘আমার জ্ঞান। ডাকাত সরদার বললেন, চোরে নিয়ে যেতে পারে ডাকাতে নিয়ে যেতে পারে এ কেমন জ্ঞান? ডায়েরি ফেরত না দিয়ে মোহোর নিয়ে চলে গেলো ডাকাত দল। ডাকাত সরদারের বাক্যটি ‘চোরে নিয়ে যেতে পারে ডাকাতে নিয়ে যেতে পারে এ কেমন জ্ঞান’? ঈমাম গাযযলী (রহ.)’র মাথায় ঘুরতে থাকে। এক সময় ফিরে আসে তাঁর চেতনা। সিদ্ধান্ত নেন তিনি আর নোট করবেন না। সাধনার পর সাধনা করে নিজের স্মৃতিকে করলেন তীক্ষ্ণ। একদিন হয়ে যান বিশাল এক দার্শনিক। জগৎ খ্যাত এই দার্শনিক একদিন মুরিদ হতে গেলেন, দুনিয়ার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয় না করা এক আধ্যাত্মিক সাধক হযরত আবু আলি ফরমাদি (রহ.)’র নিকট। তিনি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখে ঈমাম গাযযালী (রহ.)কে বললেন, বাবা তোমার নিকট তো আধ্যাত্মিকতার লেশমাত্র নেই। তোমাকে কী করে মুরিদ করি? গাযযালী বললেন, আমি এতগুলো ইসলামী গ্রন্থ রচনা করার পরও আমার নিকট আধ্যাত্মিকতার লেশ মাত্র নেই? আবু আলি ফরমাদি (রহ.) বললেন, ‘বাবা তুমি কলমের কালো কালি দিয়ে ঘষে ঘষে সাদা কাগজকে কালো করেছো, আর আমি আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেম দিয়ে ঘষে ঘষে আমার কালো হৃদয়কে সাদা করেছি। তোমার আর আমার মধ্যে এই হলো পার্থক্য’। তাঁর নিকট ফিরে আসে আরেক চেতনা। কোরআন নাজিল হয়েছে সিনায়। আউলিয়া কেরামের আধ্যাত্মিক শক্তি অর্পণ হয় সিনায় সিনায়। যা কালো হৃদয়কে সাদা করে। মাথার জ্ঞান অনেক মানুষকে অহংকারী করে। মাথার জ্ঞান ত্যাগ করে পূর্ণ জ্ঞানের সন্ধানে হযরত আবু আলি ফরমাদি (রহ.)’র নিকট আত্মসমর্পণ করে জগতের একজন সেরা দার্শনিক ঈমাম গাযযালী (রহ.) হয়ে যান আধ্যাত্মিক মহা সাধক। দর্শনের সাথে সুফিবাদের মেলবন্ধন তিনি হয়ে উঠেন ইনসানে কামিল।
এখন সবাই সহজ ভাবে শিখতে চায়,জানতে চায়, আয় করতে চায়, অর্জন করতে চায়। বিজ্ঞান প্রযুক্তি সবকিছু সহজ করে দেওয়ার পরও আমরা অতৃপ্ত। অথচ দুনিয়ার কোন খ্যাতিমান ব্যক্তির জীবন সরল পথে চলেনি। তাঁরা কঠিন কঠোর সংগ্রাম সাধনায় বড় হয়েছেন, মহান হয়েছেন। যে পথে কাঁটা নেই সেটা পথ নয়, কার্পেট। কার্পেটে হেটে মজলিশে পৌঁছা যায়, মনজিলে নয়। কাঁটাযুক্ত পথ অতিক্রম করে মনজিলে পৌঁছতে সক্ষম হলে তোমার লুঙ্গিটাও হবে ইতিহাস। আর ব্যর্থ হলে দুনিয়ার সেরা দামি স্যুট কোট টাই সবই উপহাস।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ জে পি আবদুল কালাম বলেছেন, জীবনে এমন কিছু করো, যে আজ তোমার ফোন রিসিভ করছে না, আগামীতে সে যেন তোমাকে গুগলে সার্চ করে।
তুমি কত বড় ধনী তা নির্ধারিত হবে, তোমার নিকট এমন কিছু আছে যা অর্থ দিয়ে কেউ কখনো কিনতে পারবে না। তাহলো ‘জ্ঞান’। টাকা দিয়ে বই কেনা যায়, জ্ঞান নয়। শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে কখনো গর্ব করো না, কারণ তা তোমার অর্জন নয়। সৌন্দর্য যে ক্ষণস্থায়ী তা ফুলকে দেখলে উপলব্ধি করা যায়। বংশ নিয়েও গর্ব করার কিছু নেই, কারণ এটি তোমার অর্জিত নয়, গর্ব করতে পারো চরিত্র ও জ্ঞান নিয়ে যা তুমি সাধনা করে অর্জন করেছো।
জনসংখ্যায় দ্বিতীয় বৃহত্তর রাষ্ট্রের মহামান্য রাষ্ট্রপতির পদটিও জ্ঞান পিপাসুদের নিকট তুচ্ছ। জ্ঞানের তৃষ্ণাই উচ্চ। এ জে পি আবদুল কালামকে দ্বিতীয় বারের মতো ভারতের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণের অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, আমাকে বেঁচে থাকার জন্য একটু অক্সিজেন দাও। আমার অক্সিজেন হলো ‘জ্ঞান’। সে জ্ঞান সাধনার জন্য তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতির পদ দ্বিতীয়বার গ্রহণ করলেন না।
পবিত্র কোরআনে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ আছে। সবচেয়ে বেশি যে নামটি উচ্চারিত (একশত বিশবার) তিনি হলেন, হযরত মুসা (আঃ)। এই মর্যাদাবান নবী আল্লাহর ধ্যান সাধনা করতে বার বার যেতেন সিনাই পর্বতের সাড়ে ৭ হাজার ফুট উপরে। এখানেই তিনি নবুয়ত লাভ করেন। মহাবিশ্বে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়ত প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে ১৫ বছর জাবালে নূরের আড়াই হাজার ফুট উপর চুড়ায় ‘হেরা গুহায়’ গিয়ে ধ্যান সাধনা করেন। এখানে কোরআন প্রাপ্ত হন, নবুয়ত প্রকাশিত হয় এবং জিবরাইল (আঃ)র ঘটে সাক্ষাৎ।
মনে পড়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার অমর পংক্তিঃ তুর পাহাড়ের সুর শুনে ভাই প্রেমানন্দে জ্বলি / ফানাফির রাসুল আমি হেরার পথে চলি।
ফানাফির রাসুল (দ.) হলে হেরার কঠিন সাধনার পথ অনুসরণ করতে হবে। না হয় রাসুল প্রেমিক হওয়া যাবে না। প্রেমানন্দে জ্বলতে হলে তুর পাহাড়ের কঠিন সাধনার সূর শুনতে হবে। এসব ঘটনা হতে শিক্ষা অর্জন করতে পারি, মহান কিছু অর্জন সরল পথে করা যায় না। প্রয়োজন হয় কঠোর কঠিন সাধনার।
একাধারে ত্রিশ রোজার প্রশিক্ষণ মুসলমানদের যখন ছিলো না। প্রথম রমজান রোজা মুসলমানদের ছিলো কঠিন কষ্টের পরীক্ষা। প্রথম সিয়াম সাধনার মাসেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে ৩১৩ জন মুসলমান সত্তর মাইল পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে বদর নামক স্থানে এক হাজারের অধিক সবল কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয়ী হন। এসবই ছিলো মুসলমানদের সাধনার স্বাদ। (শেষ)

লেখক : রাজনীতিক, কলাম লেখক