ইসলামে ন্যায়বিচার

519

মহানবী (দঃ)‘র ন্যায়বিচার :
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আরাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে কিছু কোরাইশ বংশের লোক হুজুর (সঃ) এর পালক পুত্রের ঘরের নাতি হযরত উসামা ইবনে জায়েদ (রাঃ)‘র মাধ্যমে একটি সুপারিশ পেশ করা হয়। চুরির কারণে কোরাইশ বংশের এক মহিলার হাত কাটার শাস্তির রায় হলে কোন কোন সাহাবী বলতে থাকে যে, অভিজাত বংশের মহিলাকে ক্ষমা কিংবা অন্য কোন শাস্তি প্রদান করা যায় কিনা? এ ব্যাপারে কারও সাহস না হওয়ায় নবীজীর প্রিয় নাতি দ্বারা সুপারিশ করা হয়েছিল। মহানবী (সঃ) তাঁর সুপারিশের কথা শুনে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললেন,” আমার মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করত, তাহলে আমি তাঁর হাতও কাটার নির্দেশ দিতাম।
হযরত আলী (রাঃ’র শাসনামলে ন্যায়বিচার :
চর্তুথ খলিফা হযরত আলী (রাঃ)’র শাসনামলে তাঁর লোহার একটি পোশাক চুরি হয়ে যায়। একদিন এক ইহুদীর নিকট তিনি তা দেখতে পেয়ে বললেন, এটি তো আমার। ইহুদী বললো, আপনার হলে বিচার প্রার্থী হোন আদালতে। আমিরুর মোমেনিন খলিফাতুন মোসলেমিন শেরে খোদা হযরত আলী (রাঃ) প্রধান বিচারপতি হযরত কাজী শোরাইহের আদালতে বিচারপ্রার্থী হলেন। বিচারপতি হযরত আলী (রাঃ) কে তাঁর পক্ষে সাক্ষী হাজির করার আবেদন পেশ করেন। হযরত আলী (রাঃ) তাঁর বড় ছেলে হযরত হাসান (রাঃ) এবং তাঁরই মুক্ত করা ক্রীতদাস কুম্বরকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করলে প্রধান বিচারপতি বলেন, হযরত হাসান (রাঃ) আপনার সন্তান এবং কুম্বর আপনার মুক্ত করা গোলাম তাই তাদের সাক্ষী এই বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়, অন্য সাক্ষী আপনার পক্ষে হাজির করতে হবে। খলিফাতুল মোসলেমিন বললেন, আমার পক্ষে আর কোন সাক্ষী নেই। প্রধান বিচারপতি সাক্ষীর অভাবে বিচারের রায় ইহুদীর পক্ষেই প্রদান করলেন। ইসলামের মহান বিচার ব্যবস্থা দেখে ইহুদী আদালতে বাইরে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে চুরি করা লোহার পোশাকটি হযরত আলী (রাঃ) কে ফেরত দিতে চাইলে তিনি তাকে পোষাকটি দান করে দেন।
হযরত ওমর (রাঃ) ন্যায়শাসন :
হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)’র দরবারে এক সাধারণ মানুষ হাজির হয়ে বললেন, পুরুষ মানুষের জন্য রেশমের কাপড় পরিধান করা হারাম। আপনি নির্দেশ প্রদান করেছেন, প্রাদেশিক কোন শাসক জনগণের যোগাযোগ ছিন্ন না হয়। মিসরের শাসনকর্তা আইয়াজ বিন ঘনম রেশমের কাপড় পরিধান করেন এবং তাঁর গৃহদ্বারে দারোয়ান রেখেছেন। জনগণ তার সাথে সাক্ষাৎ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত হচ্ছে। ঘটনার সত্যতা জানতে আমিরুল মোমেনিন খলিফাতুল মোসলেমিন হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)একজন দূত মিসরে পাঠালেন। তাকে বললেন, অভিযোগ সত্য হলে আইয়াজ বিন ঘনমকে যেন মদীনায় নিয়ে আসে। দূত মিসরে গিয়ে দেখলেন অভিযোগ সত্যি। খলিফার নির্দেশ অনুযায়ী তাকে নিয়ে এলেন রাজধানী মদিনায়।
আইয়াজ বিন ঘনমের দিকে দৃষ্টিপাত করে হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) বললেন, আইয়াজ! তুমি ইসলামের আর্দশ থেকে বিচ্যুত হয়েছো। আমার নির্দেশ অমান্য করেছো। তোমাকে এখন বিলাসী পোশাক পরিবর্তন করে বনে জঙ্গলে ঘুরে ভেড়া চরাতে হবে। খলিফার নির্দেশ শুনে আইয়াজ বললেন, আমিরুর মোমেনিন! আমি দুঃখিত, অনুতপ্ত। আমি এখনই আমার রেশমি পোশাক খুলে শাসন ক্ষমতা ত্যাগ করছি। আপনি দয়া করে আমাকে ভেড়া চরানোর কাজ থেকে রেহায় দিন।
হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) বললেন, ব্যক্তিগত অপরাধ করলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিতাম। তুমি ইসলাম ধর্মের কাছে অপরাধ করেছো। এই ধর্মের বিধানে ন্যায়বিচারের কোন আপোস নেই।
আইয়াজ বললেন, আমিরুল মোমেনিন ! এই শাস্তির চাইতে মৃত্যুদণ্ড আমার জন্য উত্তম। আামি তো এক সম্মানিত পদে অধিষ্ঠিত ছিলাম। খলিফা তাকে বললেন, আজ তুমি ভেড়া চরাতে লজ্জা পাচ্ছ? অথচ তুমি এমন লোকের সন্তান যিনি সারাজীবন ভেড়া চরিয়ে তোমার মত ছেলেকে মানুষ করেছে। যে কারণে তোমার পিতার নাম ‘ঘনম’ খ্যাতি লাভ করে। পিতার যে কোন বৈধ কাজকে পুত্রের শ্রদ্ধা করা উচিৎ।
আইয়াজ ন্যায়পরাণ খলিফার নির্দেশ মাথা পেতে গ্রহণ করলেন ইসলামের ন্যায়বিচারের স্বার্থেই।
সুলতান মোহাম্মদ ইবনে তোগলকের আমলে ন্যায়বিচার :
ইসলাম প্রকাশের প্রায় এক হাজার বছর পর যখন সেই স্বর্ণালী যুগ আর নেই; তখন ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস খ্যাত সম্রাট সুলতান মোহাম্মদ ইবনে তোগলকের সর্ম্পকে বিখ্যাত আরব পর্যটক ইবনে বতুতা তার সফরনামার দ্বিতীয় খণ্ডের ১৩০ পৃষ্ঠায় নিজের চোখে দেখাএকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। ঘটনা হলো এই, এক হিন্দু প্রজা সম্রাটের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করে যে,সম্রাট তার ছেলেকে কোন কারণ ছাড়া মেরেছে। বিচারক সাথে সাথে বিবাদী হিসেবে বাদশাহকে আদালতে তলব করলেন এবং তাদের বক্তব্য শুনলেন। পরিশেষে বাদশাহ দোষী সাব্যস্ত হন এবং তার কাজ হতে প্রতিশোধী গ্রহণ করতে নির্দেশ প্রদান করেন। বাদশাহ কোন কৈফিয়ত না করে আদালতের রায় শিরোধার্য করে নিলেন। ইবনে বতুতা বলেন, আমি দেখতে পেলাম,বাদশাহ আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে হিন্দু প্রজার ছেলেটিকে দরবারে ডেকে এনে তার হাতে একটি বেত প্রদান করে বলেন,- আমার কাছ হতে প্রতিশোধ গ্রহণ কর। বাদশাহ হিন্দু ছেলেটিকে নিজের মাতা শপথ দিয়ে বললেন, যেভাবে আমি তোমাকে মেরেছি ঠিক সেভাবে তুমিও আমাকে মার। ছেলেটি বাদশাহকে একুশ বেত্রাঘাত করল, এমনকি একপর্যায়ে মারার সময় বাদশাহর টুপি মাথা থেকে পড়ে যায়।

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক