ইসলামে উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ বা বর্ণবাদের কোন স্থান নেই

89

শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের মেধাকে সৃজনশীলতার চরম শীর্ষে পৌঁছে দেয়, এতে কোনও সন্দেহ নেই। অথচ নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে আশানুরূপ সাফল্য অর্জিত হয়নি। আজো সাদা, কালো, মুসলিম, অমুসলিম, এশীয়, ইউরোপীয় নারী-পুরুষের অধিকারের ন্যায় আন্তর্জাতিকমানের পরিচিতি নিয়ে দ্ব›দ্ব-সংঘাত অব্যাহত রয়েছে।
অথচ মহানবী সা. ১৪শ’ বছর আগে বিদায় হজের ভাষণে এসব বিষয়ের সুন্দর সমাধান দিয়ে গেছেন। যেমন: তিনি বলেছেন, সাদার ওপরে কালোর এবং কালোর ওপরে সাদার কোনো প্রাধান্য নেই। নারী জাতির মর্যাদা রক্ষার্থে তিনি বলেছেন, স্ত্রীর ওপর স্বামীর যেমন অধিকার, স্বামীর ওপর স্ত্রীরও তেমন অধিকার। ভৌগলিক বা আঞ্চলিকতার বিপক্ষে তিনি বলেছেন, আরবের ওপরে অনারবের এবং অনারবের ওপর আরবের কোনো প্রাধান্য নেই। শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার রক্ষায় তিনি বলেছেন, শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। তুমি যা খাবে বা পরিধান করবে, তোমার অধীনস্থদেরও তাই খাওয়াবে ও পরিধান করাবে। দাসত্ব প্রথার অবসানের লক্ষ্যে দাসমুক্তির পথ উন্মুক্ত করেছেন। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে দাসত্ব প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
মুসলিম জাতি মূলত অসাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠী, মহানবীর মহান আদর্শে উজ্জীবিত মুসলমানেরা কোনো কালেই অমুসলিমের প্রতি সাম্প্রদায়িক আচরণ করেনি। ভারতবর্ষে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ বিন কাশিম সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে মুসলমানদের জয়ের ধারার শুভ সূচনা করেছিলেন। পরবর্র্তীকালে ১৭০৭ সালে পলাশীর বিপর্যয়ের আগ পর্যন্ত মুসলমানেরা কমবেশি ভারতের শাসনভার পরিচালনা করেছেন। কিন্তু এ দীর্ঘ কালেও ভারতীয় উপমহাদেশে আধিপত্য বিস্তারের সংঘাত ব্যতীত কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত বা সংঘর্ষের নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন কি পলাশী বিপর্যয়ের পরও ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণœ ছিল। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপর্যয়ের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারত বর্ষে ব্রিটিশ শাসন স্থায়ী করার লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন শুরু করে। পরে ভারত বর্ষের স্বাধীকার ও স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের মাধ্যমে ভারতীয় জনসাধরণ স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়। পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে রূপ নেয়। ভারতবাসী পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়। ব্রিটিশ প্রশাসন তাদের ওপনিবেশিক শাসনের সুবিধার্থে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের লক্ষে কৌশলগতভাবে ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক বীজ বপন করে। হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ ভারতে ব্রিটিশরা বিভিন্ন কৌশলে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা ঘটায়। বিশেষত স্বাধীকার আন্দোলন যখন তুঙ্গে এবং ব্রিটিশ সরকারের পতন যখন আসন্ন, তখন ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশদের উস্কানিতে ভারতবর্ষে সর্বকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিস্তার লাভ করে। তবে ভারতবাসী স্বাধীনতার আন্দোলনের দাবি থেকে সরে আসেনি। ক্রমাগত এ দাবি জোরালো হতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষে পাকিস্তান নামক একটি মুসলিম রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে। ১৫ আগস্ট ভারতের অবশিষ্ট বৃহৎ অংশকে নিয়ে ভারত নামক অপর রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এভাবে চিরতরে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। পরবর্র্তীকালে পাকিস্তানের পূর্বাংশে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীকার আন্দোলন শুরু হয়।
পরবর্তীকালে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ, অগণতান্ত্রিক ব্যবহার, অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতনের কারণে প্রচুর রক্তক্ষয় ও ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। ব্রিটিশ শাসকেরা ভাগ কর ও শাসন কর নীতির প্রয়োগ তাদের সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের কৌশল হিসেবে করেছিল।
পরবর্তী সময়ে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালের রাজনীতিবিদেরা ব্রিটিশের সেই পচা ও পুরনো অপকৌশলকে ক্ষমতায় আরোহনের সিঁড়ি হিসেবে কিছুটা হলেও ব্যবহার করেছেন। ভারতে এ পর্যন্ত হাজার হাজার বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। পাকিস্তান আমলেও কমবেশি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দেশ হিসেবে নজির স্থাপন করেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে বিক্ষিপ্ত ভোটারেরা জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়। যা কৌশলে রাজনীতিবিদেরা নিজেদের দলের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করেন। বিক্ষিপ্ত মানসিকতার ভোটারদের ঐক্যবদ্ধ করতে অনেক শ্রম, মেধা ও অর্থের প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে ভোটব্যাংক সৃষ্টি হলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য অধিক শ্রম বা মেধার প্রয়োজন হয় না। এ কারণে বিভিন্ন খোড়া অজুহাতে অনেক সময় দাঙ্গা সৃষ্টি হয়। এদিকে, পাশ্চাত্যের সবাই আজ মুসলিম বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ। প্রকৃত অর্থে সারাবিশ্বে আজ মুসলমানেরা অমুসলিম শক্তি কর্তৃক অমানবিক আচরণের শিকার।
আদিকাল থেকে ‘বর্ণবাদ’ বলতে মানুষ সাদা-কালোর ব্যবধানকে বুঝে থাকে। অধুনা নতুন ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে অভিবাসী লোকদের অন্য বর্ণের লোক হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। জাতিগত পরিচয়ের মধ্যে। এমনকি অভিবাসীদের মধ্যেও বর্ণবাদের বিভাজন শুরু হয়েছে। বর্ণবাদের চেতনায় অভিবাসী বিবেচনা করলে ভারতবর্ষের আদিবাসী ছিলেন অনার্যরা। তারা সিন্ধু-মহেঞ্জোদারো ও ম্যাক্রমুলারর মতে, আর্যরা ১২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ভারতবর্ষে আগমন শুরু করে। আনুমানিক ১৫শত খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর্যদের হাতেই সিন্ধু, মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতার পতন গটে। মুসলমানেরা সপ্তম শতাব্দী থেকে ভারতবর্ষে আগমন শুরু করে। বর্তমানে ভারতবর্ষে আর্যরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। অথচ ‘যাদের ভারত ভূমি’ সে অনার্যরা এখনো অবহেলিত। তাদের অচ্চুৎ, নিম্নবর্ণ, হরিজন, দলিত নামে আখ্যায়িত করা হয়। ভারতের আদি ভূমি যাদের, তারা আজ ভূমির অধিকার থেকেও বঞ্চিত। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মত্যাগী জাতীয় বীরদের কাতারে বীরসা মুÐার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। সূত্র ইপিআই। অথচ ভারতের উত্তর প্রদেশের আমেথি এলাকা কয়েক দিন আগে ভূমি বিরোধের জেলে তার মতো নিম্নবর্ণের মানুষদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
সম্প্রতি প্রিয়া সাহা হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিষয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। প্রিয় সাহা উচ্চ শিক্ষিত মহিলা। সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিসংখ্যা অনুসারে বাংলাদেশে প্রায় ৪৪ লাখ দলিত জনগোষ্ঠী বসবাস করে। আছে প্রায় ১৩ লাখ হরিজন এবং প্রায় আট লাখ বেদে জনগোষ্ঠী। তাদের পক্ষ থেকে অধিকার বঞ্চিতের কোনও অভিযোগ শুনা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি করেছে। ঠিক সেই সময়ে প্রিয়া সাহারা আমেরিকান প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু দমনপীড়নের বিষয়ে অভিযোগের হেতুটা কী? আসলে বিশ্বজনমতকে রোহিঙ্গা ইস্যু থেকে দৃষ্টি সরানোর এটা এক হীন ষড়যন্ত্র।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট