ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ

120

(গত সংখ্যার বাকি অংশ) পৃথিবীর মধ্যে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় এক প্রধান সমস্যা। কোন মানুষ নিজেকে বর্তমানে নিরাপদ ভাবতে সক্ষম নন। জঙ্গিবাদের কোন আদর্শ-দর্শন নেই। তারা নিজেরাও জানে না কি আদর্শ উদ্দেশ্যে এই অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। তারা বিনা দ্বিধায় মুসলমান ভাইকেও হত্যা করে। অথচ একজন মুসলমান কখনো আরেক মুসলমানকে হত্যা করতে পারে না। নর হত্যা সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস করার সমতুল্য অপরাধ। একজন ব্যক্তিকে যখন হত্যা করা হয় তখন মানুষ বলেন এক ব্যক্তিকে হত্যা করো হয়েছে। সাক্ষী, আইনজীবী, বিচারক বলেন এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে, মহান বিচারক আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘কাউকে কেউ হত্যার অপরাধ ছাড়া এক ব্যক্তিকে হত্যা করলো (সে যে ধর্মের হোক) সে যেন সমগ্র মানব সম্প্রদায়কে হত্যা করলো। আর যদি কেউ কারো প্রাণ বাঁচায় সে যেন সমগ্র মানব সম্প্রদায়কে বাঁচাল। (সূরা মায়িদা আয়াত:৩২)
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ (যে ধর্মের লোক হউক) হত্যা করা। (তিরমিজী শরীফ)
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক আরো ঘোষণা করেছেন, ‘কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মোমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে।’ (সূরা: নিসা আয়াত ৯৩)
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যদি সকল আসমানের ফেরেস্তা জমিনের মানুষ মিলে একজন মুসলমানকে অন্যায়ভাবে হত্যার জন্য একমত হয় তবে মহান আল্লাহ পাক তাদের সবাইকে অবশ্যই জাহান্নামে নিক্ষেপ করাবেন। (মসনদে আহমদ)
‘ডোম’ পোস্ট মর্টেমের জন্য মৃত মানুষের লাশ কাটে, জীবিত মানুষের নয়। স্বাভাবিক অনুভূতি নিয়ে ‘ডোম’ এ কাজ করতে পারে না তাই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে নেশা করে তারা। (১ জুলাই ২০১৬) গুলশানের রেস্তোরাঁয় যে সব যুবক ২২জন নিরপরাধ জীবিত মানুষকে কুচিয়ে কুচিয়ে হত্যা করলো, নারী হত্যা করলো গলা কেটে। রক্তে ভেসে যাওয়া রেস্তোঁরায় সেহেরী খেল রোজা রাখতে। হায়রে ইসলাম, হায়রে ধর্ম! কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন (রা.) কে যারা শহীদ করেছিল তারা একে অপরকে বলেছিল ‘তাড়াতাড়ি হত্যা কর, নামাজ কাজা হয়ে যাবে, এই খুনিরা নামাজে গিয়ে বলবে ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মোহাম্মদ ওয়াল আলে মোহাম্মদ’, অর্থাৎ হে আল্লাহ তুমি মোহাম্মদ (দ.)’র ওপর রহমত কর তাঁর পরিবারের ওপর রহম কর।‘ নবীজীর পরিবারকে শহীদ করে নামাজে পরিবারকে দোয়া করতে যাচ্ছে, হায়রে নামাজী? এই এজীদী পথের অনুসারী জঙ্গিরা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হত্যার উৎসব করে রক্ত বন্যার মাঝে দাঁড়িয়ে সেহেরী খেল এটি কেমন ধর্মের কাজ। মনে রাখতে হবে এই হত্যাকাÐ করেছে রমজানের মত পবিত্র মাসে, এশা-তারাবিহ নামাজের সময়। এটি অমার্জনীয় অপরাধ। এসব জঘন্য অপরাধ হতে আমাদের ছাত্র যুব সমাজকে রক্ষা করতে হবে।
কয়েকটি কারণে মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায় হজ্বের ভাষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জীবনে একলক্ষাধিক মানুষের সামনে কোন হাদিস বর্ণনা করেননি। জীবনে হজ্ব করেছিলেন একবার। লক্ষাধিক হাজীদের সামনে পবিত্র দিনে (শুক্রবার ও হজ্বের দিন) পবিত্র মাসে (যে মাসে যুদ্ধ সংঘাত হারাম) পবিত্র শহরে (পবিত্র মক্কা নগরী) প্রদেয় এই ভাষণ একটি ঐতিহাসিক ভাষণ। মুসলমানের জন্য নবীজীর পূর্বের বাণীর চেয়ে পরের বাণীর গুরুত্ব অধিক। তাঁর কর্মের চেয়ে কথার গুরুত্ব বেশি। বিদায় হজ্বের ভাষণ ছিল তাঁর জীবনের শেষ কালো বাণী, তাই এ ভাষণের গুরুত্ব ব্যাপক। এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে তিনি মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করে বারবার বললেন ‘ইয়া আইয়ুহান নাস’ (হে মানব মণ্ডলী) অর্থাৎ সবধর্মের মানুষ! আল্লাহ তোমাদের ওপর এদিন, এ মাস ও এ শহরের মতো চিরদিনের জন্য একে অন্যের রক্তপাত করা, সম্পদ ও সম্মানহানি হারাম করেছে। (সহিহ বোখারী)
বিদায় হজ্বের বিদায় বেলার অমর বাণীর মাধ্যমে কেয়ামত পর্যন্ত একে অপরের রক্তপাত হারাম ঘোষণা করেছে। যুদ্ধ সংঘাত কোন দিন কেউ আর বৈধ করতে পারবেনা।
পবিত্র কোরানে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ডাকে তাদের গালমন্দ করোনা কারণ অজ্ঞতাবশত তারা আল্লাহকে গালি দিবে। (সূরা আনআম, আয়াত : ১০৮)
মহান আল্লাহ পাক যেখানে মূর্তি পূজারীদের গালমন্দ করতে নিষেধ করেছেন সেখানে জঙ্গিরা ধর্মের অভ্যন্তরে পরস্পর ঝগড়া ফ্যাসাদ সৃষ্টি করছে।
ইংরেজ একজন অমুসলিম লেখক লিখেছেন, আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগে দুইজন মুসলমান দেখা হলে একটি আরবী বাক্য বলতে দেখি। আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম। তোমরা দেখা হলে কী যেন বলো? তারা আমাকে জানালেন আমরা শান্তি বিনিময় করি। ‘আস্সালামু আলাইকুম’ বলি। ইউরোপ আমেরিকার মানুষরা দেখা হলে বলে ‘গুডমর্নিং’ সকালে ভালো থাকো বিকালে নয়। ‘গুড ইভিনিং’ বিকালে ভালো থাকো রাতে নয়, রাতে ভালো থাকো, আগামী কাল নয়। ইসলাম ধর্মের নির্দেশ হলো একে অপরের সাথে দেখা হলে সাথে সাথে বলো আস্সালামু আলাইকুম, অর্থাৎ তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হউক। আজ নয়, কাল নয়, শুধু ইহকাল নয় অন্তকাল শান্তি বর্ষিত হউক। সালামের পর মোসাফাহা (হাত মিলানো), তারপর মোয়ানাকা (গলাগলি) করা সুন্নাত। আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারাহ মাতুল্লাহ (তোমাদের ওপর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক)বলে নামাজ শেষ করতে হয়। যে ধর্মে সাক্ষাতের সাথে সাথে অন্তকাল শান্তি বর্ষণের নির্দেশ আছে, সে ধর্মের লোক কী ভাবে সাক্ষাতে একে অপরকে বোমা বর্ষণ করতে পারে! যে মানুষকে নিয়ে স্বয়ং আল্লাহ পাক গর্ববোধ করেছেন, সেই মানুষকেই ধর্মের নামে হত্যা করা চরম গর্হিত কাজ নয় কী ?
যেকোন অপবাধের বিরুদ্ধে যে কেউ নালিশ করতে পারে। মানুষ আইনজীবীর ভূমিকায় বিচারের দাবি করতে পারে কিন্তু ধর্ম বিরোধিতার অভিযোগে আইনকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে এক সাথে আইনজীবী, বিচারক ও জল্লাদের ভূমিকা পালন করতে পারে না। জঙ্গিরা ধর্ম বিরোধিতার অভিযোগে অনেক ব্যক্তি হত্যা করে একই সাথে আইনজীবী, বিচারক ও জল্লাদের ভূমিকা পালন করছে।
ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, ১৪শ’ বছর সময়ে মুসলমানদের আত্মঘাতি হামলার কোন দৃষ্টান্ত নেই। বর্তমান কিছু পথভ্রষ্ট লোক জান্নাত পাওয়ার লোভে আত্মহননের মাধ্যমে নিরীহ লোক হত্যা করছে। ইসলামের দৃষ্টিতে আমার দেহের মালিক আমি নই। তাই আত্মহত্যা মহাপাপ। নিজের অঙ্গহানি হারাম। আমার দেহের মালিক আমি হলে, যেকোন নারীর নিকট আমার দেহ দান বৈধ হতো। যেকোন নারী পুরুষের নিকট দেহ দান অবৈধ হতো না। যে ধর্মে নিজের আত্মহনন, অঙ্গহানি মহাপাপ বলে ঘোষণা করা হয়েছে সে ধর্মের নামে অপর ব্যক্তি হত্যা করা কত জঘন্য পাপ তা চিন্তা করা প্রয়োজন।
কোন কবিরা গুনাহ বা মহাপাপের কারণে মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজ অবৈধ নয় না, কিন্তু আত্মহত্যাকারীর নামাজে জানাজা অবৈধ বলে অধিক ফকিহগণ মত ব্যক্ত করেছেন। হয়রত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ও ফকিহগণ বলেছেন, মানুষ হত্যা ও আত্মহত্যা শুধু মহাপাপ নয়, জায়েজ মনে করলে সে কাফির হয়ে যাবে।
ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম খারেজী নামক একটি গোষ্ঠি জঙ্গিদের মত কোরান হাদিসের কিছু কথার অপব্যাখ্যা করে আমিরুল মোমেনিন মওলা আলী (রা.) কে গুপ্তহত্যা করে। জঙ্গিরা খারেজীদের মত গুপ্তহত্যা করে চলছে, এমন সময় আলেম সমাজ ও সাধারণ দেশপ্রেমিক মানুষ কী চুপ থাকা জায়েজ হবে? যার যার অবস্থান হতে সবাই জঙ্গিদের প্রতিরোধ করা এখন ঈমানী দায়িত্ব।
জঙ্গিবাদের অন্যতম কাজ ধর্মের অপব্যাখ্যা করে যাদের ধর্ম জ্ঞান কম তাদের ব্যবহার করা। ভ্রান্ত আদর্শে বিশ্বাসী এবং যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আল্লাহর অলিদের মানবতা ও কল্যাণের ধর্মের বিশ্বাসী নয়, তারাই জঙ্গিবাদের নিয়ন্ত্রক।
ইসলামে ফিতনা ফাসাদ নয়হত্যা ও সন্ত্রাস কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কোন মুসলমান ভাইয়ের প্রতি অস্ত্র উত্তোলন করা হতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিরত থাকতে বলেছেন। এ সম্পর্কে তিনি ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ যেন কোন মুসলমান ভাইয়ের প্রতি অস্ত্র দ্বারা ইঙ্গিতও না করে। কারণ শয়তান তার অজান্তে তার হাতে স্খলন ঘটাতে পারে। আর অন্যায়ভাবে হত্যার কারণে জাহান্নামে পতিত হবে। (বোখারী শরীফ)। … চলবে
লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক