ইসলামের দৃষ্টিতে কবি ও কবিতা

634

মাহবুবে খোদা মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবি পরিবারে দুনিয়াতে শুভাগমন করেছিল। তাঁর মা আমেনা বিনতে ওয়াহব ছিলেন একজন স্বভাব কবি। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকালের পর হযরত আমেনা (রা.) যে শোকগাথা রচনা করেছিলেন তা ইতিহাস প্রসিদ্ধ। যে চাচা আবু তালিবের ঘরে লালিত পালিত হন সে চাচা ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ কবি। খোলফায়ে রাশেদীনের চার জনের মধ্যে তিনজন যথা হযরত আবু বকর সিদ্দিক(রা.), হযরত ওমর ফারুক (রা.), হযরত আলী (আ.) ছিলেন ভালো কবি।

মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবি সাহাবীদের পুরস্কৃত করতেন। গণিমতের মালের অংশ কবিদের মাঝে বিতরণ করতেন। তখন সেরা জ্ঞানী সাহাবীরাই কবি ছিলেন। কখনো কখনো নাম উল্লেখ করে কবি সাহাবীদের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করে উৎসাহিত করতেন। মেধাবী কবি কাব ইবনে জুহাইর (রা.) নবী পাকের হাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তাঁর প্রশংসায় কবিতা রচনা করলে, মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নিজ হাতে ডোরাকাটা চাদর মোবারক উপহার দেন।
কবিদের মধ্যে হযরত হাস্সান বিন সাবিত (রা.) হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সভা কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাঁকে মসজিদে নববীতে মধ্যে বসাতেন। কবি সাহাবী হাস্সান(রা.) কে বলা হতো ‘শায়েরুর রাসুল’ বা রাসুলের কবি। তিনি যখন শানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবিতা আবৃত্তি শুরু করেন তখন প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, হাস্সানের জিভ যতদিন রাসুলের পক্ষ হয়ে কবিতার বাণী শুনিয়ে যাবে ততদিন তার সঙ্গে জিবরাঈল(আ.) থাকবে।
বিখ্যাত কবি আনতারা বিন শাদ্দাদ ছিলেন আরবের অন্যতম সৈনিক কবি। সহজ শব্দে কঠিন মনোভাব প্রকাশে তিনি পারঙ্গম ছিলেন। এক সময় প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার কবিতা শোনানো হচ্ছিল। যখন এই পংক্তি পর্যন্ত পৌঁছল, ‘বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছি কত / হালর রিজিকের উপযুক্ত হতে পারি যেন’/ তখন প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুগ্ধ ও অভিভুত হয়ে শ্রোতাদের বলেন, ‘কোন আরবীর প্রশংসা শুনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আমি অনুপ্রাণিত হয়নি। কিন্তু সত্য বলতে কী, আমি এই কবিতা রচয়িতার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ বোধ করছি।
কবি ও কবিতার মর্যাদা আছে বলেই পবিত্র কোরআনে ‘আশ শুআরা’ (কবিরা) নামে একটি সূরার নাম করণ করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের এই সূরায় ঘোষণা করেন, এবং বিভ্রন্তরা কবিদের অনুসরণ করে, আপনি দেখেন না, তারা প্রতিটি উপত্যকায় উ™£ন্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন সব কথাবার্তা বলেন, যা তারা করে না। তবে তাদের কথা ভিন্ন যারা বিশ্বাস করে, সৎকর্ম সাধন করে ও আল্লাহকে অত্যাধিক স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে (সূরা আশ শুআরা-২২৪-২২৭)
উল্লেখিত আয়াতে কবিয়ায় ভাল ও মন্দ দুই ধরনের কবিতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কলেমায় বাক্যের মত কোরানে কোন বক্তব্য জোরালোভাবে উপস্থাপন করার আগে নেতিবাচক দিক আগে এবং ইতিবাচক দিক পরে তুলে ধরার হয়। তাই প্রথম মন্দ কবির ভৎর্সনার পর ভালো কবিদের উৎসাহিত করা হয়েছে পবিত্র কোরআনে।
প্রকৃত পক্ষে আবরা দিল কবিতার পালন। আইয়ামে জাদেলিয়া অনেক মন্দ দিকের মধ্যে একটি ভালো দিক হলো তারা কবিতা ও সাহিত্যানুরাগী ছিল। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘উট থামতে পারে তার সুকরুণ ক্রন্দন। কিন্তু আরবরা থামাতে পারে না তাদের কবিতার সুর।’
আরবে আইয়ামে জাহিলিয়াতে বসতো ও কাজের মেলা। যেখানে হতো কবিতা উৎসব ও প্রতিযোগিতা। কবিতা উৎসবের সর্বশ্রেষ্ঠ সাতটি কবিতা স্থান পেয়েছিল পবিত্র কাবা ঘরের দেয়ালে। এই কবিতাকে বলা হয় ‘সবউন সুয়ল্লাকাত’। এসব কবিতার লেখক ছিল ইমরুল কায়েস। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমরুল কায়েসের কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, তিনি কবিদের শীর্ষে তবে জাহান্নামীদেরও নেতা, তাকে কবিদের শীর্ষে সম্মান দেয়ায় কারণ হলো, ভাষার প্রাঞ্জলতা, শব্দ ব্যবহারে দক্ষতা, অভিনব উপমা, জীবনবোধের অপূর্ব দ্যোতনা। এসব কারণে ইমরুল কায়েসের কবিতা ১৪ শত বছর ধরে মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত রয়েছে।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শিল্পকলার সৌন্দর্য ও জীবনের সৌন্দর্য এক নাও হতে পারে। কারও শিল্প হয়তো সুন্দর কিন্তু জীবনবোধ পরিচ্ছন্ন নয়। অপরিচ্ছন্ন জীবনবোধ সম্পন্ন শিল্পীর যতই মনোহারী হোক তা জাতির সঙ্কটমুহূর্তে তাদের অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে পারে না।
প্লেটোর নিজের রচনা অত্যন্ত কাব্যগুণমÐিত কিন্তু তিনি কবিদের পছন্দ করতে না, তারা মিথ্যাচার করেন বলেন। এরিস্টটল তার সাহিত্য তত্তে¡ প্লেটোর এমতের সমালোচনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে, সাহিত্য হচ্ছে জীবনের পূর্ণতার জন্য সাহিত্য অত্যাবশ্যক। প্লেটোর সঙ্গে এরিস্টটলের এই দার্শনির দ্ব›দ্ব এটা সাহিত্য সমালোচনার জন্য খুবই জরুরি।
এসব কবিতা বা সাহিত্য ধর্মের বানী বা আদর্শের কথা নয়। কবিতা-সাহিত্য ভাষা শৈলী ও সাহিত্য রসের জন্য রচিত হয়। কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক চিঠিতে লেখেছেন, আমি মুসলমান-কিন্তু আমার কবিতা সকল দেশের, সকল কালের এবং সকল জাতির। তিনি অন্য এক চিঠিতে লেখেছেন, আমি কবিতা লিখেছি। ধর্মের বা শাস্ত্রের মাপকাঠি দিয়ে কবিতাকে মাপতে গেলে ভীষণ হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। তাই সব সময় ধর্মের মাপকাঠি দিয়ে দিয়ে কবিতা সাহিত্য বিচার করা সঠিক কাজ নয়।

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক