ইসলামের দৃষ্টিতে অহংকার জঘন্য অপরাধ

349

গর্ব অহংকার দুনিয়ার মধ্যে একটি নিকৃষ্ট স্বভাব, যা মানুষের সকল পুণ্য কাজ ধ্বংস করে দেয়। শয়তান কম ইবাদত করেনি কিন্তু তাঁর ইবাদতসমূহ অহংকারের কারণেই ধ্বংস হয়ে যায় এবং শয়তান হয়ে গেল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিশপ্ত ব্যক্তি। শয়তানের মত অহংকার অনেক কুস্বভাবের জন্ম দেয়। অহংকার জ্ঞানী ব্যক্তির জ্ঞান ধ্বংস করে। কত রাজা বাদশাহর রাজত্ব অহংকারের কারণে মুহ‚র্তের মধ্যে হারিয়ে ভিখারী হয়ে গেছে তার কোন ইয়াত্তা নেই। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘এ পরকারকে তাদের জন্য আমি নির্ধারিত করেছি, যারা দুনিয়াতে ঔদ্ধত্য অনাচার করতে চায়নি’। (সূরা কাসাস : ৮৩)
আল্লাহ পাক জাল্লে শানহু তাঁর কালাম পাকে আরো ইরশাদ করেছেন, ‘আমি এমন মানুষদের আমার নির্দেশনাবলী থেকে বিমুখ রাখবো, যারা দুনিয়ার বুকে অবৈধ অহংকার করে।’ (সূরা আ’রাফ : ১৪৬)
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে লোকের হৃদয়ে সরিষা পরিমাণ অহংকার থাকবে সে কখনো বেহেস্তে প্রবেশ করবে না’। অন্যত্র বর্ণনা আছে, ‘যিনি অহংকার করে শরীরে আবৃত পোশাক টেনে চলবে, তার প্রতি আল্লাহ পাক রহমতের নজরে থাকাবেন না’।
কোন তাক্ওয়াবান ব্যক্তি অহংকার করতে পারে না। অহংকার তারাই করে যারা আহমক। অহংকারকারী যদি জানতো অহংকারের মধ্যে ধ্বংস লুকিয়ে রয়েছে তাহলে সে কোনদিন অহংকার করতো না। অহংকার যেমন মানুষের দ্বীন-ধর্ম বরবাদ করে তেমনি বুদ্ধি-চিন্তা, মানসম্মান বিদায় করে। নিম্ন চিন্তার মানুষের কাছে অহংকার থাকে। অভিজাত তারাই যাদের কাছে বিনয় আছে। যাঁর যত জ্ঞান সে তত বিনয়ী। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘এ পৃথিবীতে সবায় বোকা, আমিও বোকা, কিন্তু আমি যে বোকা তা আমি বুঝি, ওরা যে বোকা ওরা তো বুঝে না, ওরা ও আমার মধ্যে এই পার্থক্য।’
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘ওমা উতিতাল ইলমা ইল্লা খলিল’। আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে মানুষকে সামান্য জ্ঞানই প্রদান করা হয়েছে। তাই নিউটনের মত জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী উচ্চারণ করেছেন, ‘জ্ঞানের সমুদ্রের তীরে আমি নুড়ি খুঁজছি মাত্র’। ঈশ্বরচন্দ্রকে আমরা বলি ‘বিদ্যাসাগর’ তিনি বলেছেন, ‘জ্ঞানের গভীর সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে এক বিন্দু জল পেয়েছি মাত্র’।
যারা সামান্য জ্ঞান নিয়ে গর্ব অহংকার করে তাদের জন্য কথাগুলোর মধ্যে বড় ধরনের উপদেশ রয়েছে। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) একদিন বাজারে লাকড়ির বোঝা মাথায় নিয়ে। এক ব্যক্তি তাঁর কাছ জানতে চাইলো, মহান আল্লাহ পাক আপনাকে অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছে, তারপরও কেন আপনি এত কষ্ট করছেন ? তিনি উত্তরে বললেন, ‘আমি আমার নফস থেকে অহংকার তাড়াতে চেষ্টা করছি’।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘নিজেদের পা যেন জমিনে সজোরে না ফেলে’। (সূরা নুর : ৩১) আল্লাহর জমিনের ওপর দম্ভ অহংকার করে চলা মহাপাপ। দামি পোশাক পরিচ্ছেদ জুতো পরে মাটির ওপর সশব্দ করে চলা হারাম। এতে অহংকারের প্রকাশ ঘটে।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) ইরশাদ করেছেন, হাশরের দিন আল্লাহ পাক তিন প্রকার লোকের সাথে কথা বলবেন না। এবং কোনরূপ রহমতের দৃষ্টি তাদের প্রতি দেবেন না। তাদের জন্য নির্ধারিত থাকবে দোযখের চরম শাস্তি। তারা হলো, বৃদ্ধ ব্যভিচারী, জালেম বাদশাহ এবং অহংকারী ব্যক্তি।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) এর নিকট সাহাবী হযরত সাবেত ইবনে কায়েস ইবনে শাম্মাস (রা.) জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার স্বভাব এই যে, আমি সৌন্দর্য পছন্দ করি তাই নিজে সাজসজ্জা করি, এটা কি অহংকারের পর্যায়ে পড়ে ? রাসূলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেছেন, না এটা অহংকার নয়। অহংকার হলো সত্যকে পছন্দ না করা, গ্রহণ না করা এবং মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, অথচ মানুষ আল্লাহর বান্দা। সেই বান্দা তো অহংকারী ব্যক্তিটির চাইতে চেষ্টাও হতে পারে।
সাহাবী হযরত ওয়াহাব (রা.) বলেছেন, ‘জ্ঞান অন্বেষণকারী তাঁর প্রচেষ্টার সমান জ্ঞান অর্জন করেন কিন্তু সে যদি অহংকারী হন তার অহংকার আরো বৃদ্ধি পায়। যে জ্ঞানের লক্ষ্য অহংকার সে জ্ঞানী হলেও মূর্খ। যার অন্তরে আল্লাহ পাকের ভয় আছে, সে মূর্খ হলেও জ্ঞান অর্জনের পর বুঝতে পারে যে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সুতরাং ব্যতিক্রম করা যাবে না। তাঁর কাছে তখন অহংকার থাকে না। সে পূর্বের চেয়েও অধিক আল্লাহকে ভয় করে এবং অধিক বিনয়ী হয়।
প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) সামনে এক ব্যক্তির খুব প্রশংসা করা হলো। কয়েকদিন পর নবীজীর দরবারে লোকটি হাজির হলে সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (দ.)! আমরা কিছুদিন পূর্বে যে লোকটির প্রশংসা করেছিলাম, তিনি আপনার দরবারে হাজির হয়েছেন। আল্লাহর রাসূল (দ.) বললেন, ‘আমি তার চেহারায় শয়তানের প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। লোকটি সালাম করে আল্লাহর রাসূলের সম্মুখে দাঁড়ালে তিনি জানতে চাইলেন, তুমি সত্যিকারে বলো, তোমার কি মনে হয় এসব মানুষের মধ্যে তোমার চেয়ে উত্তম কেউ নেই ? লোকটি বললো, হ্যাঁ’
দেখুন লোকটি তার অহংকারের কারণে নিজকে অন্যদের চেয়ে চেষ্ট মনে করতো তো আল্লাহর রাসূল (দ.) নবুয়তের নুরের দৃষ্টিতে তার চেহারায় দেখতে পেয়েছিলেন। বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু যর গেফারী (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি আল্লাহর রাসূল (দ.) এর সামনে এক ব্যক্তিকে বললাম, হে কৃষ্ণাঙ্গিনীর পুত্র! একথা রাসূল (দ.) শুনার সাথে সাথে বললেন, বেশি লম্বা হয়ে গেছে, কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাথে সাথে আবু যর গেফারী (রা.) মাটিতে শুয়ে পড়লেন এবং লোকটিকে বললেন, তুমি আমার গন্ডদেশ পদদলিত কর।
হযরত মাওলা আলী (রা.) বলেছেন, কোন ব্যক্তি দোযখীকে দেখতে চাইলে সে যেন তাকে দেখে যে, নিজে বসে রয়েছে অথচ তার সামনে অন্যান্যরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। যা অহংকারীরাই করে থাকেন। আল্লাহ পাক আমাদেরকে অহংকার ও দম্ভ হতে হেফাজতে রাখুক।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক