ইন্সট্রাক্টরের আত্মহত্যার চেষ্টার নেপথ্যে কী

41

পটিয়া প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগের কোনও কূলকিনারা করতে পারেনি প্রশাসন। অভিযুক্ত চার ইন্সট্রাক্টর ধর্ষণ ও অন্যান্যভাবে শিক্ষার্থীদের হয়রানি ঘটনা আদৌ ঘটিয়েছেন, নাকি শত্রূতার জের ধরে আত্মহত্যার চেষ্টাকারী ওই ইন্সট্রাক্টর এসব অভিযোগ তুলেছেন, তা খতিয়ে দেখছে তদন্ত কর্মকর্তারা।
পিটিআই শিক্ষার্থী, এলাকাবাসীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকে জানিয়েছেন, তারা সরাসরি কারও ধর্ষণ বা হয়রানির তথ্য না জানলেও বাস্তবে এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। নারী প্রশিক্ষণার্থী অনেকে বলেছেন, অভিযুক্ত এই চার ইন্সট্রাক্টর সুযোগ পেলেই প্রশিক্ষণার্থীদের উত্ত্যক্ত করতো। তাদের আচরণে পুরুষ প্রশিক্ষণার্থীরাও বিব্রত হতেন অনেক সময়।
আবার কেউ কেউ বলছেন, অভিযুক্ত চার জনের সঙ্গে দেবব্রত বড়ুয়ার কোনও দ্ব›দ্ব ছিল। ওই দ্ব›েদ্বর জের ধরেই হয়তো তিনি এসব অভিযোগ এনেছেন। কারণ, তিনি এ ঘটনার প্রতিবাদ অন্যভাবেও করতে পারতেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত অভিযোগ দিতে পারতেন। প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে আন্দোলন করতে পারতেন। সংবাদ সম্মেলন করে এসব অভিযোগ তুলে ধরতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটি করেননি। তাই তার আত্মহত্যার চেষ্টার বিষয়টি রহস্যজনক। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
তবে দেবব্রত বড়ুয়া দাবি করেছেন, অভিযোগের বিষয়টি তিনি সুপারিনটেনডেন্টকে জানিয়েছেন। সুপারিনটেনডেন্ট এ বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নেননি। তবে বিষয়টি অস্বীকার করে সুপারিনটেনডেন্ট তপন কুমার দাশ বলেছেন, এ বিষয়ে দেবব্রত বড়ুয়া কোনও অভিযোগ করেননি।’
প্রশিক্ষণার্থীদের দাবি, অভিযুক্ত চার ইন্সট্রাক্টর ক্লাসে নারী প্রশিক্ষণার্থীদের কটূক্তি করতেন। নানাভাবে তাদের উত্ত্যক্ত করতেন। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত ইন্সট্রাক্টররা। তাদের দাবি, প্রশিক্ষণার্থীদের কড়া শাসনে রাখায় তারা সুযোগ পেয়ে এসব অভিযোগ তুলছেন।
ইনস্টিটিউটে গিয়ে একাধিক প্রশিক্ষণার্থীর সঙ্গে কথা বললে জানান, তারা এখানে আছেন দুই মাস। এই দুই মাসে কোনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। তবে আগের ব্যাচের অনেকের সঙ্গে অভিযুক্ত ইন্সট্রাক্টররা অশালীন কাজ করেছেন বলে শুনেছেন তারা। ইন্সট্রাক্টরদের ফাঁদে পা না দিতে আগের প্রশিক্ষণার্থীরাই তাদের সতর্ক করছেন।
এক নারী প্রশিক্ষণার্থী বলেন, ‘ওই চার ইন্সট্রাক্টর নানাভাবে বাজে কথা বলতেন। যেমন, একজন একদিন এক নারী প্রশিক্ষণার্থীকে বলেছেন, ‘তোমার ফিগার দেখতে হুবহু আমার স্ত্রীর মতো’। গত ৫ মার্চ আমাদের ইনস্টিটিউটে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ওই অনুষ্ঠানে ডিসপ্লে হয়। ওই ডিসপ্লের জন্য আমরা নারীরা একটি কক্ষে প্র্যাকটিস করতাম। অভিযুক্তদের একজন আমাদের প্র্যাকটিস কক্ষে হুটহাট ঢুকে পড়তেন। প্র্যাকটিস রুমে গিয়ে উনি বলতেন, ‘ওই মেয়ের কোমর দোলানো ঠিক নেই’। আরও নানা বাজে কথা, সব বলাও যায় না। একদিন একজনের কাঁধে হাত দিয়ে দিয়েছেন। অভিযুক্তদের একজন (রবিউল) হুটহাট মেয়েদের হলে খাবার খেতেন। একজন পুরুষ ইন্সট্রাক্টর কেন মেয়েদের হলে খেতে আসবেন? ছেলেদের হল আছে, উনি সেখানে যেতে পারেন।’
পুরুষ প্রশিক্ষণার্থী অনেকে অভিযোগ করেছেন, ক্লাসে অভিযুক্ত এই চার ইন্সট্রাক্টর তাদের অপমান করতেন। খাটো করে কথা বলতেন। একদিন ক্লাসে অভিযুক্তদের একজন বলেন, ‘ফার্স্ট শিফটে যেসব ছেলে আছে তারা সবাই ঢিলা, তাদের সবার তার ছেঁড়া’, ‘চার আনার মাস্টার’। এসব বলে আমাদের হেয় করতেন। নানাভাবে আমাদের নাজেহাল করতেন।’
গত ৬ মার্চ রাতে নগরীর কালামিয়া বাজার এলাকায় নিজ বাসায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ইন্সট্রাক্টর দেবব্রত বড়ুয়া। আত্মহত্যার আগে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে অভিযোগ করেন, ইন্সট্রাক্টর (শারীরিক শিক্ষা) মোহাম্মদ ফারুক হোসেন, ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ) জসীম উদ্দিন, ইন্সট্রাক্টর (কম্পিউটার সায়েন্স) রবিউল ইসলাম, ইন্সট্রাক্টর (চারু ও কারুকলা) সবুজ কান্তি আচার্য্য নানা কৌশলে নারী প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাদের পরীক্ষায় বেশি নম্বর দেওয়ার কথা বলে ধর্ষণ করতেন। নারী প্রশিক্ষণার্থীদের নানাভাবে যৌন নির্যাতন করতেন। এর কোনও প্রতিকার করতে না পেরে বিবেকের তাড়নায় তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
দেবব্রত বড়ুয়ার এই অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ২০১১ সাল থেকেই অভিযুক্ত ইন্সট্রাক্টর মোহাম্মদ ফারুক হোসেনের সঙ্গে দেবব্রত বড়ুয়ার দ্ব›দ্ব শুরু হয়। ওই দ্ব›েদ্বর জের ধরে তাদের মধ্যে কয়েকবার কথা কাটাকাটিও হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের পর থেকে তারা দুই জন কথা বলতেন না। অভিযুক্ত আরেক ইন্সট্রাক্টর জমিস উদ্দিনের সঙ্গেও তার দূরুত্ব ছিল। দুই বছর ধরে তার সঙ্গে কোনও কথা বলতেন না দেবব্রত বড়ুয়া।
এ বিষয়ে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে অবসরে যাওয়া ইনস্টিটিউটের ইন্সট্রাক্টর নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ফারুক ও জসীমের সঙ্গে দেবব্রতের একটা দূরত্ব ছিল। ফারুকের সঙ্গে ২০১১ সাল থেকে তার দূরত্ব তৈরি হয়। তখন তারা প্রয়োজন ছাড়া কোনও কথা বলতেন না। এরপর দুই আড়াই বছর ধরে জসীমের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। ফারুক ও জসীমরা এক হয়ে দেবব্রতের বিরোধিতা করতো। দেবব্রতও তাদের বিরোধিতা করতেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইন্সট্রাক্টর বলেন, ২০১১ সালের এক নির্মাণ শ্রমিকের হাতে ইনস্টিটিউটের এক নারী প্রশিক্ষণার্থীর শ্লীলতাহানি ঘটে। এই ঘটনার সঙ্গে ফারুক হোসেন ও চিন্তাহরণ পাল নামে এক ইন্সট্রাক্টরের যোগসাজশ ছিল বলে অভিযোগ তোলেন প্রশিক্ষণার্থীরা। এ ঘটনায় ওই দুই ইন্সট্রাক্টরকে অভিযুক্ত করে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান প্রশিক্ষণার্থীরা। ওই ঘটনার জের ধরেই দেবব্রত বড়ুয়ার সঙ্গে তাদের দ্ব›দ্ব শুরু হয়। ফারুক হোসেন ধরে নিয়েছেন, দেবব্রত বড়ুয়া ও সামসাদ নামে আরেকজন ইন্সট্রাক্টর প্রশিক্ষণার্থীদের দিয়ে তাদের অভিযুক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এবং মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন। এরপর এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর ফারুক হোসেন নানাভাবে দেবব্রত বড়ুয়াকে কোণঠাসা করে রাখতেন। স্থানীয় হওয়ায় ফারুক হোসেন ইনস্টিটিউটে প্রভাব বিস্তার করতেন। কিন্তু এসব বিষয় ভালোভাবে মেনে নিতে পারতেন না দেবব্রত বড়ুয়া।
কেন প্রত্যাহার আদেশ ফিরিয়ে নিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য প্রত্যাহার আদেশ দিয়েছিলাম। এখন পরিস্থিতি শান্ত, তাই প্রত্যাহার আদেশ ফিরিয়ে নিয়েছি। তবে তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি আরও জানান, ইনস্টিটিউটের একটি অনুষ্ঠানে দেবব্রত বড়ুয়াকে প্রশিক্ষণার্থীদের সামনে অপমান করেন জসীম। ওই ঘটনার জের ধরে দেবব্রত দুই বছর আগে একবার চাকরিও ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে সামশু নামে এক প্রশিক্ষণার্থী দেবব্রত বড়ুয়ার ক্লাস নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জসীম তাকে নাজেহাল করেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন দেবব্রত।
দূরত্ব থাকার বিষয়টি দেবব্রত বড়ুয়া নিজেও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘ফারুক ও জসীমের সঙ্গে কথা বলতাম না এটি সত্য। সে নারী প্রশিক্ষণার্থীদের নানাভাবে নির্যাতন করতো। বিষয়গুলো আমার কাছে ভালো লাগতো না, তাই আমি তাকে এড়িয়ে চলতাম। ২০১১ সালের একটি ঘটনার পর থেকে আমি তার সঙ্গে কম কথা বলতাম। ২০১৪ সালের পর আর কথা বলি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফারুক ইনস্টিটিউটে অনধিকার চর্চা করতো। স্থানীয় হওয়ায় সে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। ইনস্টিটিউটকে সে নিজের বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করে। মানুষ বাপ-দাদার সম্পত্তিরও যতœ নেয়, কিন্তু সে ইনস্টিটিউটকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তবে এসব কারণে আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করিনি। কী কারণে করেছি সেটি প্রশিক্ষণার্থীরা জানেন, আগে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারাও জানেন। বিষয়গুলো হয়তো বাইরে থেকে দেখা যায় না। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আমি আত্মহত্যার কারণ জানিয়েছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক হোসেন বলেন, ‘দেবব্রত বড়ুয়ার সঙ্গে আমার ওই অর্থে দ্ব›দ্ব ছিল না। তিনি একরোখা ছিলেন, যা বুঝতেন সেটি করতেন। উনি আমার সঙ্গে নয়, অন্যদের সঙ্গেও কথা বলতেন না। আমাদের সবার বসার জন্য একটা রুম আছে। কিন্তু উনি আমাদের সঙ্গে বসতেন না। উনি অনেক বেশি আবেগী, আবেগ থেকে এই কাজটা করেছেন।’
ইনস্টিটিউটে আধিপত্য বিস্তারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে অধিকাংশ সময় সুপারিনটেনডেন্ট থাকেন নারী। উনারা জোরালোভাবে কোনও কথা বলতে পারেন না। তাই উনাদের হয়েই আমি ঠিকাদার থেকে শুরু করে সবার সঙ্গে কথা বলতাম। আর আমার নিজের এলাকা হওয়ায় ইনস্টিটিউটের সব ভালো-মন্দের সঙ্গে জড়িত থাকতাম।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইনস্টিটিউটের সুপারিনটেনডেন্ট তপন কুমার দাশ বলেন, ‘আমি তো দায়িত্ব নিয়েছি বেশি দিন হয়নি। তিন মাস হবে। এর আগে এখানে কী হয়েছে আমি বেশি কিছু বলতে পারবো না। আমার মনে হয় এখানে কোথাও ভুল বোঝাবুঝি আছে। তারপরও যেহেতু একটি অভিযোগ উঠেছে, তাই এ ঘটনায় আমাদের উপ-পরিচালকের কার্যালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের আলোকে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। পাশাপাশি জেলা প্রশাসন থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও বিষয়গুলো উঠে আসবে।’
এ বিষয়ে জানতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের উপ-পরিচালক (চট্টগ্রাম) কার্যালয়ে থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান সহকারী পরিচালক রাশেদা বেগমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে উপ-পরিচালক সুলতান মিয়ার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি এখনও প্রতিবেদন দেয়নি। তারা তদন্ত করছেন। আমরা অধিদফতরের মহাপরিচালককে বিষয়টি অবহিত করেছি। সেখান থেকেও বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আপাতত আমরা প্রত্যাহার আদেশ তুলে নিয়ে তাদের চার জনকে বদলির আদেশ দিয়েছি। ফারুককে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বদলি করা হয়েছে।’ অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনও তদন্ত চলছে। এ বিষয়ে পরে জানানো হবে।
এ বিষয়ে জানতে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আবু হাসান সিদ্দিককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।