ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই আমাদের করণীয়

127

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম

সংঘাতপূর্ণ মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে মহান আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত পথ ও মত অনুসরণ করতে হবে। এক আল্লাহর বিশ্বাস, তিনি জগতের সৃষ্টিকর্তা ও ইবাদতের মালিক এ কথা মেনে চলতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে-‘আল্লাহ কি বিচারকদের সর্বোচ্চ বিচারক নয়?’ বিচার দিনের মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীতে মানুষের মাঝে বিচার ফয়সালার দায়িত্ব দিয়ে কিতাব সহকারে হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন। পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনে সঠিক পন্থা অবলম্বন করে যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হয়,তা হাতে কলমে শিখিয়েছেন । তিনি নিজের কারণে কখনো কাউকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাননি। কেবল জনগণের জন্যই অপরাধীর উপর দন্ড কার্যকর করেছেন। জয়নাব বিনতে হারিস নামক খাইবারের ইহুদী মহিলা নবীজিকে হত্যা করার মানসে ছাগল ভুনা করে বিষ মিশ্রিত করে তাঁর নিকট হাদিয়া প্রেরণ করেছিল। সাথে সাথে এ বিষের ক্রিয়া নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সহচররা টের পেলেন। সাহাবীরা তরবারি উঁচিয়ে মহিলার দিকে ধেয়ে আসলে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ মহিলাকে রক্ষা করেন। তাকে কোন শাস্তি দিলেন না। পরবর্তীতে যখন বিশিষ্ট সাহাবী বিশর ইবনে বারা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বিষক্রিয়ায় ইন্তেকাল করলেন, তখন এ হত্যাকান্ডের শাস্তি স্বরূপ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে মহিলাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন।
আমরা যদি প্রিয় নবীর হাতে গড়া ইসলামী প্রজাতন্ত্র মদীনাতুর রাসূলের দিকে অবলোকন করি তবে বলা যায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত- জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সমাজে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। যথা-
১. ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া : ভ্রাতৃত্ব হচ্ছে ফুল ও পল্লবে শোভিত এক বরকতপূর্ণ বৃক্ষ, নানাভাবে নিরবধি যা ফলদায়ক। ভ্রাতৃত্বের মূল ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা। এ প্রসঙ্গে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-তোমাদের কেউ ততক্ষণ মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে যে কল্যাণ নিজের জন্য পছন্দ করে, তার অপর ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ করে।
২. প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান ও দয়া প্রদর্শন করা: বিতর্ক করতে হবে সত্য প্রকাশ ও মানুষের প্রতি দয়া-মমতার জন্য। প্রতিপক্ষকে হীন করার উদ্দেশ্যে কিংবা মূর্খ বলার জন্য নয়। মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘‘আর রাহমানের বান্দা তারাই যারা জমিনে ন¤্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদের সম্বোধন করে তখন বলে ‘সালাম।’’ তাই নবীজিকে হত্যার জন্য হাজার বার যারা চেষ্টা করেছিল বরাবরই তাদের সবাইকে তিনি ক্ষমা করে দিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে আচরণের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
৩. কারো ওপর জুলুম-অবিচার না করা: যার যা প্রাপ্য তাকে তা না দেয়া হলো জুলুম। এটা ব্যক্তির সম্পদ আত্মসাৎ, শারীরিক আক্রমণ বা সম্মানহানির মাধ্যমেও হতে পারে, যা ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক অন্যায় বলে বিবেচিত। আল্লাহর হক আদায় না করলে আল্লাহ ক্ষমা করলেও বান্দার হক বিনষ্টকারীকে আল্লাহ কখনও ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ না যার ওপর জুলুম করা হয়েছে, সে ক্ষমা করে দেয়।
৪.সৎ কাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজের নিষেধ করা : এটা সমাজ সংস্কার ও সংশোধনের অনন্য মাধ্যম। এর মাধ্যমে সত্যের জয় হয় এবং মিথ্যা ও বাতিল পরাভূত হয়। যে ব্যক্তি আন্তরিকতা ও সততার সাথে এ দায়িত্ব পালন করে তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার ও মর্যাদাপূর্ণ পারিতোষিক।
৫. ইনসাফ করা : ইসলামের পরিভাষায় ইনসাফ হচ্ছে কোনো বস্তু তার হকদারদের মধ্যে এমনভাবে বণ্টন করে দেয়া যাতে কারও ভাগে বিন্দুমাত্র কম বেশি না হয়। বসুন্ধরার বুকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার কায়েম নিয়ে আসে নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও শান্তির ফল্গুধারা। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জিন্দেগীর সকল পর্যায়ে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে ইসলাম সমধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। এমনকি মুসলমানদের সাথে কাফিরদের লেনদেন ও সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ইনসাফের নীতিতে অবিচল থাকতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দÐায়মান হও। কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রæতা যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জন করতে কোনোভাবেই প্ররোচিত না করে।”
৬. দ্বীনী শিক্ষা অর্জন ও প্রচার-প্রসার : দুনিয়ার নিযাম ও ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখার জন্য যেমন জাগতিক শিক্ষার প্রয়োজন তেমনি দ্বীনের হিফাজতের জন্য এবং দুনিয়ার সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক করার জন্য দ্বীনী শিক্ষার প্রয়োজন। কুরআন-সুন্নাহর চর্চা ও অনুসরণের অভাব হলে সমাজের সকল অঙ্গনে দুর্নীতি ও অনাচার দেখা দেয়। দেখা দেয় অশান্তি। শিক্ষিত মানুষ পথভ্রষ্ট হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমাজ যতই উন্নতি লাভ করুক ঈমান ও খোদাভীতি না থাকলে তা মানুষের ক্ষতি ও অকল্যাণে ব্যবহৃত হয়। মানুষের সকল আবিষ্কারকে অর্থপূর্ণ ও কল্যাণমুখী করার জন্যই অপরিহার্য প্রয়োজন ইলমে ওহীর চর্চা।
৭. আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করা : শত্রু-মিত্রের বিচার না করে সব মানুষ যদি সঠিক পথের অনুসারী হতো তবে হক্ব-বাতিল, ঈমান-কুফর, আল্লাহর বন্ধু এবং শয়তানের বন্ধুর মাঝে কোনো পার্থক্য থাকতো না। তাই বন্ধু নির্বাচন ও শত্রুতা পোষণ আল্লাহর জন্য হওয়া উচিত।
৮. জবাবদিহিতার মানসিকতা থাকা :মানুষকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতার সঙ্গে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। বিভিন্ন কাজকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশের উপযুক্ত তত্ত্ব-তথ্য, আয়-ব্যয়, হিসাব-নিকাশ ও লেনদেনকে সুস্পষ্টভাবে জানার জন্য উন্মুুক্ত করাই হলো স্বচ্ছতা। ইহকালীন ও পারলৌকিক উভয় জগতে জবাবদিহিতা রয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-‘অন্তত যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে (জবাবদিহি) ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।’’
সমাজে সৃষ্ট অরাজকতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে। যথা-১. সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন, আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র, ২. বেকারত্ব ও হতাশা এবং ৩. অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নামে নিরপরাধের শাস্তি ইত্যাদি।
সা¤্রাজ্যবাদী নিপীড়ন, আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র: যতদিন এরূপ আগ্রাসন, নিপীড়ন ও ষড়যন্ত্র থাকবে ততদিন যে কোনো দেশে কিছু মানুষ অজ্ঞতা ও আবেগের প্রেষণে উগ্রতায় লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। এরূপ সম্ভাবনা একেবারে রহিত করা যায় না। অনুরূপভাবে যে মুসলিম দেশের ভৌগলিক বা অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে সে দেশে আধিপত্য বিস্তার করতে বা সে দেশের সরকারকে ছাড় দিতে বাধ্য করতে কিছু ‘‘জঙ্গি’’ তৈরি করা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জন্য অত্যন্ত সহজ ও কার্যকরী পন্থা। তবে আমরা বাকি তিনটি কারণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে প্রথম কারণটিও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে।
বেকারত্ব ও হতাশা : বেকারত্ব, বঞ্চনা ও হতাশার পাশাপাশি জ্ঞানহীন আবেগ চরমপন্থা ও জঙ্গি কর্মকাÐের জন্ম দেয়। আমাদের সমাজে যারা সর্বহারার রাজত্বের জন্য বা ইসলামী রাজত্বের জন্য সহিংসতায় লিপ্ত তাদের প্রায় সকলের জীবনেই এ বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা শিক্ষিত বেকার যুবককে কেউ বুঝিয়েছে যে, এরূপ সহিংসতার মাধ্যমে অতি তাড়াতাড়িই তোমার ও অন্যদের কষ্ট ও বঞ্চনার সমাপ্তি ঘটবে এবং সর্বহারার রাজত্ব বা ইসলামী রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। তুমি ক্ষমতা ও কর্ম অথবা জান্নাত লাভ করবে। হতাশগ্রস্থ যুবকরা সহজেই এ কথা বিশ্বাস করে এ সকল কর্মে লিপ্ত হয়। কারণ তার অন্য কোনো কর্ম নেই এবং তার পাওয়ার আশার বিপরীতে হারানোর তেমন কিছই নেই। বেকারত্ব, সামাজিক অবহেলা, ন্যায় বিচারের দুর্লভতা, বঞ্চনা ও অজ্ঞতা প্রভৃতি দূর না করে শক্তি বা আইন দিয়ে কঠোর হস্তে ‘‘জঙ্গি’’ নির্মূলের চেষ্টা করলে জাতির ক্ষতি হবে। এতে এদেশের অনেক সন্তান ‘‘নির্মূল’’ হলেও ‘‘জঙ্গিবাদ’’ নির্মূল হবে না। যারা চরমপন্থা বা জঙ্গি কর্মকাÐে লিপ্ত তারা আমাদের সামাজিক বঞ্চনা ও অবিচারের শিকার। তাদেরকে শত্রু বিবেচনা করে নির্মূল করার চেয়ে নাগরিক ও দেশের সন্তান বিবেচনা করে যথাসম্ভব সংশোধন করে সমাজের মূলধারায় সংযুক্ত করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষত যারা হত্যা বা অনুরূপ অপরাধে জড়িত হয় নি এরূপ যুবকদের সংশোধনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নামে নিরপরাধের শাস্তিঃ জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় ভয়ঙ্কর দিক হলো নিরপরাধের শান্তি। জঙ্গিবাদ দমনের নামে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে নিরপরাধ মাদ্রাসা ছাত্র বা ধার্মিক মানুষদেরকে আটক, জিজ্ঞাসাবাদ, কারাগারের রাখা, রিমান্ডে নেওয়া ইত্যাদি কর্ম একদিকে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত করবে, অপরদিকে এ সকল নিরপরাধ মানুষ ও তাদের আপনজনদেরকে জঙ্গিবাদের প্রতি আকৃষ্ট করবে এবং সর্বোপরি আমাদেরকে আল্লাহর গজব ও শাস্তির মধ্যে নিপতিত করবে। কারণ নিরপরাধের শাস্তি ও বিচারবহির্ভুত হত্যা, শাস্তি ও কষ্টদান যখন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক রূপ প্ররিগ্রহণ করে তখন আল্লাহর গজব ও জাগতিক শাস্তি সে দেশের ভাল ও মন্দ সকল মানুষকে গ্রাস করে।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে প্রিয়নবী এর রাষ্ট্র পরিচালনার অনুপম আদর্শে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে ন্যায় বিচার ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে সমাজ-রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণের তাওফিক দান করুন।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক