ইজারা কাঁচাবাজারের ‘হাসিলের’ নামে পুরো চকবাজারে চাঁদাবাজি

276

ছৈয়দ উদ্দীন (ছদ্মনাম) বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন ছাত্র। করোনার কারণে শহরে টিকে থাকার একমাত্র আয়ের পথ টিউশনি বন্ধ। দীর্ঘসময় বেকার থাকার পর বন্ধুর সাথে মিলে হাতে থাকা কিছু টাকা দিয়ে পাইকারী দামে টিশার্ট কিনে কার্টনে করে চকবাজার গোলজার মোড়ে বিক্রি করেন বিকাল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। এই তিন ঘন্টা সময়ে তাকে গুনতে হয় পাঁচ দফা চাঁদার টাকা। কখনও বাজারের হাসিল আবার কখনও পুলিশ-দারোয়ানের নামে তোলা হয় এসব চাঁদা। স্টুডেন্ট পরিচয় দিয়ে রেহাই পেতে চাইলেও টহলরত পুলিশ সদস্য সাফ জানিয়ে দেয় চকবাজারে ব্যবসা করতে হলে টাকা দিয়ে করতে হবে।
তিনি পূর্বদেশকে জানান, প্রথমদিন কাঁচাবাজরের ইজারাদারের লোক এসে একশ টাকার টোকেন ধরিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে যান। এছাড়া থানার এসআইয়ের নামে ১০ টাকা, বিট পুলিশের নামে ৬০ টাকা, টহল পুলিশের নামে ৫০ টাকা এবং মার্কেটের দারোয়ানের নামে ২০ টাকা চাঁদা নেন পৃথক পাঁচজন এসে। শুধু ছৈয়দ নয় কথা হয় ভ্যানে করে কাপড় বিক্রি করা আরও ছয়জন হকারের সাথে।তাদের কাছ থেকেও পাঁচ দফায় চাঁদা আদায় করা হয়। তবে টাকার অংক আরও বেশি। বাজারের হাসিলের নামে একেক ভ্যান থেকে দেড়শ থেকে তিনশ টাকা আদায় করা হয়। টাকার বিরপীতে যে টোকেন দেওয়া হয় তাতে কোনো প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষে সিল থাকে না। তবে দিন-তারিখ এবং টাকার অংক উল্লেখ থাকে। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কাতালগঞ্জ, নবাব ওয়ালি খাঁ মসজিদের মোড় থেকে কাঁচাবাজার হয়ে কেবি আমান আলী সড়ক এবং কাপাসগোলা পর্যন্ত সড়কে চলে এই চাঁদাবাজি। তবে নিয়ম রয়েছে শুধু ইজারা দেওয়া বাজার এলাকার রাস্তা বা ফুটপাতে সিটি করপোরেশনের বেঁধে দেওয়া সময়ে ব্যবসা করতে গেলে চাঁদা দিতে হয়।
এদিকে চকবাজার কাঁচাবাজার ইজারা নিয়ে যেন পুরো এলাকায় চাঁদাবাজির লাইসেন্স পেয়েছে এই চক্রটি। শুধু বাজার নয় পুরো এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ চক্রটির হাতে। আগে এই চক্রের নিয়ন্ত্রক ছিল এক যুবলীগ নেতা। এখন তার জায়গায় দেলোয়ার হোসেন ফরহাদের নেতৃত্বে চাঁদাবাজি চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাজারের হাসিলের নামে ভাসমান দোকান-হকার থেকে চাঁদা তোলেন বক্কর, মেহেদি, হাসান ও মাসুদ নামের কয়েকজন ব্যক্তি। তারা নানা ভয়-ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করেন। এছাড়াও চক্রটির বিরুদ্ধে টেম্পুস্ট্যান্ড থেকে চাঁদাবাজি, মাদকের নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ ও জুয়ার বোর্ড বসানোর অভিযোগও রয়েছে।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ১৪২৭ সনে চকবাজার কাঁচাবাজার ইজারা হয় ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। আগের জরাজীর্ণ বাজার ভেঙে সিটি করপোরেশন নতুন ভবন করে দিয়েছে। কিন্তু হাসিলের মাধ্যমে সড়কে ইজারাদারের ভাসমান হকার বসানোর কারণে বাজারটির দ্বিতীয় তলা জমে উঠছে না। এমনকি দ্বিতীয় তলায় এখনও ১১টি দোকান বরাদ্দ হয়নি। ইজারাদারের ভাসমান হকার প্রীতির কারণে সিটি করপোরেশনের বাজারটির বেহাল দশা বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।
পুরো চকবাজার এলাকা থেকে হাসিল তোলার বিষয়ে সিটি করপোরেশনের কাগজে-কলমে ইজারাদার মো. ইদ্রিছের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত সীমানায় বসলেই হাসিল নেয়া হয়। তবে তিনি বললেন, বাজারটি আমার নামে ইজারা থাকলেও আমি তদারকি করি না। আমি এখন ঢাকায় অবস্থান করছি। যিনি বাজার তদারকি করেন তার মোবাইল নাম্বার ক্ষুদেবার্তায় পাঠানোর কথা বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
পরে তার পাঠানো নাম্বারে যোগাযোগ করলে মেহেদি নামের একজন জানান, কাঁচাবাজারের বাইরে ধুনির পুলের আগে পর্যন্ত যারা ভ্যানে করে মালামাল বিক্রি করেন শুধুমাত্র তাদের কাছ থেকে হাসিল তোলা হয়। এর বাইরে আর কোনো এলাকা থেকে টাকা তোলা হয় না। তিনি আরও জানান, কাঁচাবাজারের হাসিলে তাদের পোষায় না। তাই সিটি করপোরেশনকে বারবার তাগাদা দিয়ে আসছেন কাঁচাবাজারটা করপোরেশন মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় যেনো সম্প্রসারণ করা হয়। কারণ নিচে যে বাজারটি রয়েছে সেটি শুধুমাত্র মাছের জন্য বরাদ্দ। এছাড়াও বাজারটি ইদ্রিছের নামে থাকলেও সবাই যৌথভাবে ইজারা নিয়েছেন বলে জানান। এদের মধ্যে দেলোয়ার হোসেন ফরহাদ, আমিন ছাড়াও তাদের আরও কয়েকজন বন্ধু রয়েছেন বলে জানান তিনি।
বৃহত্তর চকবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবু সাদাত সায়েম পূর্বদেশকে বলেন, তারা সিটি করপোরেশন থেকে শুধু চকবাজার কাঁচাবাজার ইজারা নিয়েছে। কিন্তু হাসিলের নামে চাঁদা তুলছে পুরো চকবাজার এলাকা থেকে। রাস্তা-ফুটপাত যে যেখানে বসছে সেখান থেকেই চাঁদা তুলছে। এভাবে তো সাধারণ মানুষকে হয়রানি করতে পারে না। চাঁদাবাজি বন্ধে সিটি করপোরেশনের কার্যকরী ভূমিকা প্রত্যাশা করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিন বলেন, ইজারাদারের বিষয়ে আমি মন্তব্য করবো না। পুলিশের নামে টাকা তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে অবগত নন বলে সাফ জানিয়ে দেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছি এবং এটাও জেনেছি যে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগসাজশে সিটি করপোরেশনের ইজারার নাম ভাঙ্গিয়ে সড়কে চাঁজাবাজি করছেন। তিনি বলেন, তারা ইজারার শর্ত ভঙ্গ ও সিটি করপোরেশনের সুনাম ক্ষুন্ন করছেন। চকবাজার কাঁচাবাজারের ইজারার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযোগ সত্য হলে ইজারা বাতিলসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে মন্তব্য করেন চসিক প্রশাসক সুজন।