সা মর্থ্য নেই বলে কি মানুষের সখ বলে কিছু থাকতে নেই? এ যেন আয়নার ফ্রেমে বাঁধা নিজের প্রতিকৃতিকে নয় অন্য কোন অচেনা মানুষকে প্রশ্ন করছে মলি। একটু অবসর পেলেই সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে। এটা ছেলেবেলাকার অভ্যাস। আগে শুধু তাকিয়ে থাকতো। প্রশ্ন পর্বের সংযোজন হয়েছে মাত্র একবছর আগে। এই ভ্রুকুটি কি নিজের জন্য নাকি অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে এটা ঠিক বোঝা যায় না। সম্ভবত অরণ্যই মূল হোতা। যাই হোক না কেন, সে মনে করে প্রতিটি মানুষের কিছু না কিছু ব্যক্তিগত অভিরুচি থাকা প্রয়োজন। যে কাজটি করে সে আনন্দ পাবে। একটু স্বস্থি। এমন সখ মৌমিতারও আছে। অরণ্যেরও। যদিও তার স্বামী বিষয়টি এড়িয়ে যায়।
মলি মাঝে মধ্যে মধ্যরাতের ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে বিছানার পাশে হাত রেখে দেখে অরণ্য নেই। জানালার স্বচ্ছ পর্দা ভেদ করে আবছা মানুষের অবয়ব দেখা যায়। সিগারেটের গন্ধ। ব্যাপারটা ঠিক স্বপ্নের মতো। দেখতে দেখতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। প্রতিদিন যে এমন ঘটে তা নয়। অথচ সেই অরণ্য মলির সৌখিনতাকে প্রায় বিদ্রুপ করে, বলে, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের অতো সখটখ থাকতে নেই। মলি তখনো চুপ।
অফিসের বাথরুমের দেয়ালে অতি সাধারণ গোছের একটি আয়না ঝুলানো। সেই আয়নার অসাধারণ কীর্তি আছে। যা কেউ জানে না। সে কাউকে বলেনি। এমনকি মৌমিতাকেও নয়। এই আয়নায় মলিন চেহারা বেশ সুন্দর দেখায়। মলি একপলক দেখে। থমকে দাঁড়ায়। আরও কয়েকবার মোহগ্রস্ত। দেখতে দেখতে মুগ্ধ। এক একবার সন্দেহ জাগে, প্রতিবিম্বের মতো বাস্তবের মেয়েটাও কি এতটাই সুন্দর। নাকি এ শুধু আয়নার কারসাজি। এ সময় স্নো হোয়াইট অ্যান্ড ম্যাজিক মিরর গল্পের কথা মনে হয় তার।
ববরাবরের মতো আয়না আজও নিরুত্তর। তবুও মিলি তাকিয়ে থাকে। কল্পনায় ডুব দেয়। মিলির বেডরুমে যে বেলজিয়ামের আয়না বহুদিন শোভা পাচ্ছে সেই আয়নার অবশ্য ভিন্ন বক্তব্য। বাসার মেয়েটির মুখে অসংখ্য কালো দাগ। বয়সের ছাপ। কিছুটা বিষণèতাও বুঝি উঁকিঝুঁকি দেয়। কপালের প্রতিটি চিন্তার রেখাস্পষ্ট। অথচ অফিসের মেয়েটি যেন রাই কিশোরী। স্বতঃস্ফ‚র্ত। বাসার আটপৌরে মেয়ের সাথে কোনও মিল নেই। যেন এখনি বনেবাদাড়ে ছুটে যাবে। মায়াহরিণকে পেছনে ফেলে ঐ তো মগডালে উঠে যাচ্ছে। এই টুপ করে আম পাড়ল। ঐ বাগানমালি চিৎকার করছে। এবার দৌড়। রাইকিশোরী ছুটছে। এসব দূরদূরান্তের স্মৃতির পাশে হঠাৎ কোথা থেকে যেন হাজির হয় লক্করঝক্কর মার্কা একটি বাস। মলি ধাক্কাধাক্কি করে উঠে যায়। বাসে কোন সিট নেই। প্রতিদিন এ সময়টাতে মানুষ গিজগিজ করে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আজও মলি মাথার ওপরের রেলিং ধরে ঝুলছে। হঠাৎ কোমরের কাছটা আলগোছে ছুঁয়ে দেয় পাশের পুরুষ। সে জানে এসব ইচ্ছাকৃত। কিন্তু কিছু বলতে গেলেই বিপদ। হয়তো দেখা যাবে, কাল থেকে আরও অনেক পুরুষের টার্গেট হয়ে যাবে। ধুস শালা! সব জাহান্নামে যাক। ইস! কী যে গরম পড়ছে। ও পাশ থেকে উৎকট ঘামের গন্ধ। সিগারেটের ধোঁয়া। এসবের মধ্যেই খোলা জানালা দিয়ে এক চিলতে আমুদে বাতাস এসে গা ছুঁয়ে দেয়। কোমলতা। শান্তি। ‘এই যে, এভাবে ধাক্কা দিচ্ছেন কেন? একটু সরে দাঁড়াতে পারেন না?’ মলি নিজেই একটু সতর্ক হয়। মারমুখী ভঙ্গিতে ঝুলতে থাকে। তার কষ্ট দেখে কোন পুরুষ উঠে দাঁড়ায় না। অবশ্য সে কারও করুণাও চায় না। অতো সস্তা নয় সে। পরের স্টেশনে অনেকে নেমে যাবে। ভাগ্য ভালো থাকলে তখন একটা সিট পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য দু’দিন আগে পুরো রাস্তাটাই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। সেদিন ভীষণ জ্যাম। হয়তো কোন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাঁর গাড়ি বহর নিয়ে যাচ্ছেন, তাই আশেপাশের সংলগ্ন সব সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
অফিসের সময়টা কেমন হুহু করে উড়ে যায়। অথচ বাসায় এলে সময় কাটতেই চায় না। ইদানিং অরণ্য ফিরতে ফিরতে অনেক রাত করে। কেন এতো রাত হয় এ প্রশ্নের জবাব তার কাছে থাকে না। আমতা আমতা করে কী সব যে বলে, বোঝাও যায় না। মলির আজ চোখজুড়ে ঘুম। ক্লান্তি। বিছানায় শুয়ে পড়তেই চোখ বুঝে আসে। এক ঘুমে সকাল। ঘড়ির এলার্ম শুনে চোখ মেলে দেখে ছয়টা বাজে অথচ অরণ্য পাশে নেই। তখন মনে পড়ে গতরাতের ঘটনা। মলি তাড়াতাড়ি ফোন দেয়। কিন্তু অরণ্যের ফোন বন্ধ। আগে কখনো এমন হয়নি। একটা ভয় পেয়ে বসে। সে কয়েক জায়গায় ফোন করে। অরণ্যের বড়বোনের ফোনও বন্ধ। এ বিষয়ে ছোটবোন কিছু জানবে বলে মনে হয় না। ছোটবোনের সাথে সম্পর্কটা একটু ফিকে হয়ে আসা বিকেলের মতো নাজুক। গেলে বড় আপার ওখানেই যাবে। একটু ইতস্তত করে মলি ফোন করে শাশুড়িকে, মা, ‘আপনার ওখানে কি অরণ্য গেছে?’
‘আমার কাছে আসবে নাতো কার কাছে যাবে? তোমার কি মনে হয় আমার ছেলে প্রেম করে বেড়ায়? আর করলেই বা দোষের কী? বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেছে। এখনো ছেলেপুলে…’
‘মা, আমার অফিস আছে’ বলেই ফোন কেটে দেয়।
মলির কী খুব কষ্ট হয় ? অভিমান ? সে নিজেও বুঝতে পারে না। গলার কাছে কী যেন একটা বিঁধে আছে। অরণ্য ফোন করে তাকে জানাতে পারতো। অবশ্য এখন এসব ভেবে লাভ নেই। তাকে অফিসে যেতে হবে। মলি নিজেকে তাগাদা দেয় । তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে সবকিছু গুছগাছ করে বের হতে হতে সাড়ে সাতটা। একটু হাঁটতেই বাসও পেয়ে যায়। মুগদা, বাসাবো হয়ে মতিঝিল পৌঁছে ঠিক সাড়ে আটটায়। বাস থেকে নামতেই জুতার চাপে জল ছোটে এদিক-সেদিক। গতরাতের তুমুল বৃষ্টিতে এখনো রাস্তাঘাট ভেজা। এখানে-সেখানে জলের পুকুর। কিছুদূর এগোতে না এগোতেই স্যান্ডেলের ফিতা ছুটে যায়। দুর্যোগের দিনে এমনি হয়। একের পর এক বাধা। সেভাবেই খুঁড়িয়ে, এলোমেলোভাবে কয়েক পা এগিয়ে যায় মলি। প্রতিদিন এ পথটুকু হেঁটেই যায়। বড়জোর দশ মিনিট লাগে। তাতে অন্তত বিশ টাকার সাশ্রয়। কিন্তু আজ কেন জানি মন বিষিয়ে আছে। হয়তো অরণ্যের বিষয়টি দগ্ধ করছে। অন্যদিন হলে জুতো হাতে নিয়েই হেঁটে যেতো। অফিসের কাছাকাছি এক মুচি আছে তার কাছ থেকে অনেকবার জুতা ঠিক করে নিয়ে অফিসেও গেছে। আজ সে হাত তুলে এক রিক্সাঅলার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ‘এই মতিঝিল যাবে?’
এখনো অফিসের আধঘন্টা বাকি বলে রক্ষে। নইলে ঠিক দেরি হয়ে যেত। আর বেশি পথ তো নেই। এই চত্বর পার হলেই ডানদিকে তার অফিস। এমন সময় মোবাইল ফোনের চিৎকার। মলি বিরক্ত হয়, বাজুক মোবাইল। নিশ্চিত মৌমিতা ফোন করেছে। যেদিন বস তাড়াতাড়ি অফিসে পৌঁছে সেদিন দায়িত্বটুকু অক্ষরে অক্ষরে পালন করে মৌ। মলি রিক্সাঅলাকে তাগাদা দেয়, ‘ও ভাই আর একটু জোরে চালাও না।’ আর মাত্র বিশ মিনিট। মুচির ওখানেও মিনিট পাঁচেক তো লাগবেই। কলেজে থাকতেও মলি এভাবেই ছুটত। কোন কোনদিন কলেজ বাস মিস হয়ে গেলে সে কী কষ্ট! সেই কষ্টের যেন শেষ নেই। চলছে তো চলছেই। ভেবেছিল, বিয়ের পর মুক্তি মিলবে। নির্ঝঞ্ঝাট সংসার করার ইচ্ছেতে পড়ালেখাও শেষ করেনি। কিন্তু বিয়ের দুই বছর গড়াতে না গড়াতে সবকিছু পাল্টে যায়। স্বামীর বাচ্চা চাই। বংশের প্রদীপ। দুই দুইটা মিসক্যারেজের পর কনসিভও হচ্ছে না। অরণ্যও আগের মতো নেই। অল্পতেই রেগে যায়। গড়গড় করে বলে,
‘মলি তোমার মন থাকে কোথায়?’
‘কেন? কী হয়েছে?’
‘তরকারিতে কি লবণ দিয়েছিলে? রান্নাটাও একটু যত্ন নিয়ে করতে পারো না।’
অরণ্যের মতো আয়নার গল্পগুলোও কেমন যেন পাথর পাথর। রুক্ষ। শুধু অফিসের এই আয়নাটাই যা রাইকিশোরীর গল্প শোনায়। ইচ্ছে করে অরণ্যকে ডেকে বলে, আয়নার কথা। কিন্তু দূরত্ব মুছে ফেলে অতো কাছে যাওয়া কি আর সম্ভব? এ প্রশ্নটা নিজের জন্য বরাদ্দ। একেবারে ব্যক্তিগত। চন্দনবৃক্ষের সুগন্ধি ছড়ানো সময়গুলি হারিয়ে যাচ্ছে মহাকালের অন্ধকারে। সে জানে, এ সময় আর ফিরবে না। বুকের ভেতর একটা হাহাকার। একটা শিশুর ছায়া রাতদিন তাড়া করে। কিন্তু স্বপ্ন বুনতে চাইলে সরিয়ে রাখে মানুষটা, বলে, আর কেন? দু’দুবার স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেছে। যেন স্বপ্ন ভাঙ্গার জন্য সেই দায়ী।
অফিসে প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে বাথরুমে যায় মলি। প্রতিদিন প্রায় একই নিয়ম।
এই আয়নায় মুখ দেখলে অনেক ঘুমন্ত স্বপ্ন জেগে উঠে। বাবা বলতেন, স্বপ্ন জিঁইয়ে রাখার নামই জীবন। স্বপ্ন পূরণ হোক বা না হোক তাতে সমস্যা নেই। একদম হঠাৎ বেখেয়ালে কিনা কে জানে, বাম হাত লেগে স্থানচ্যুত হয়ে পড়ে যায় আয়না। মলি ধরার সমূহ চেষ্টা করে। ধরতে যেয়ে আয়নার ফ্রেম লেগে তীব্র ব্যথা। তার আগেই ঝনঝন শব্দ। সেই শব্দ শুনে ছুটে আসে পিয়ন। দরজার ওপাশে তার উদ্বীগ্ন কণ্ঠস্বর, ‘আপা, কী হইছে?’ মলি দরজা খোলে। ততক্ষণে অফিসের আরও কয়েকজন এসে জড় হয়েছে। সবার প্রশ্নবোধক চাহনির জবাবে মলি বলে, ‘কিভাবে যেন হাত লেগে আয়নাটা পড়ে গেছে……’
পিছন থেকে মৌমিতা প্রশ্ন করে, ‘তুই ঠিক আছিস তো। কোথাও লেগেছে?’ সহকর্মীদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা কিছুই স্পর্শ করে না মলিকে। অফিসে অবস্থান করছে এটাও তার মন থেকে মুছে যায়। সে আয়নার টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। সেখানে অসংখ্য মলি। তাদের চোখ বেয়ে জল নামছে। নাম না জানা নদীর জন্মের উৎসের মতো বাঁধহীন জল।