আসামে বিজেপি’র ডিটেক্ট, ডিলিট ডিপোর্ট ফর্মুলা সচল হচ্ছে?

23

প্রথমত কথিত অবৈধদের চিহ্নিত তথা ডিটেক্ট করা, দ্বিতীয়ত তাদের বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নেওয়া তথা ডিলিট করা এবং তৃতীয়ত তাদেরকে তাড়িয়ে বাংলাদেশে পাঠানো তথা ডিপোর্ট করা; আসামে এটাই হলো বিজেপির রাজনৈতিক ফর্মুলা। ৩১ আগস্ট চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা প্রণয়নের মধ্য দিয়ে এর প্রথম ধাপ (ডিটেক্ট) শুরু হতে যাচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, এই ফর্মুলা খুব মসৃণভাবে বাস্তবায়নের কোনও সুযোগ নেই। পর্যবেক্ষকদের একটা বড় অংশ মনে করেন, আসামের নাগরিক তালিকা সংশোধনের নেপথ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল সেখান থেকে মুসলিম বাঙালিদের বাংলাদেশে পাঠানো। তবে সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা গেছে, তালিকায় এখনও স্থান না পাওয়া ৪১ লাখ অধিবাসীর বড় অংশটি বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষ, যাদের মধ্যে বিজেপির বিপুল সংখ্যক ভোটার রয়েছে। তাদেরকে তাড়িয়ে দিলে রাজনৈতিকভাবে বিজেপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর বাংলাদেশও আসামের নাগরিক তালিকার বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখে। ঢাকার দাবি অনুযায়ী, সেখানে কোনও অবৈধ বাংলাদেশি নেই। তাই ভারত চাইলেই এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হবে না। সবমিলে তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষদের নিয়ে সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।শনিবার সকালে ঘড়িতে দশটা বাজতে না-বাজতেই ভারতের উত্তর- পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম হুমড়ি খেয়ে পড়বে নিজেদের মোবাইল ফোনে, কিংবা ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে। যাদের কাছে ইন্টারনেটের সুবিধা নেই, তারা গিয়ে ভিড় করবেন নিকটবর্তী ‘এনআরসি সেবাকেন্দ্রে’ ঝুলিয়ে দেওয়া তালিকা দেখতে। পড়িমড়ি করে তারা শুধু জানতে চাইবেন একটাই প্রশ্নের উত্তর, জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর চূড়ান্ত তালিকায় (এনআরসি) তাদের নাম থাকছে কি থাকছে না!
আসাম বহুকাল ধরেই জাতিসত্ত¡ার দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ এক ভৌগোলিক ভূখন্ড। ব্রহ্মপুত্র বা বরাকের অববাহিকায় জাতি-ভাষা-ধর্ম নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ইতিহাসও অনেক বছরের পুরনো। আশির দশকের আসাম আন্দোলন, বাঙালি খেদাও কিংবা নেলির মুসলিম গণহত্যার নির্মম মাইলস্টোনগুলো পেরিয়ে এই সংঘাত এখন এক চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছেছে এনআরসি তালিকাকে ঘিরে। বছরখানেক আগে যখন এনআরসি-র দ্বিতীয় খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল তা থেকে বাদ পড়েছিল রাজ্যের প্রায় ৪১ লাখ বাসিন্দার নাম- যাদের প্রায় সবাই ছিলেন বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু বা মুসলিম। গত কয়েক মাসের ভেতর তাদের মধ্যে থেকে আরও কয়েক লক্ষ লোক যদি নিজেদের ভারতীয় নাগরিক বলে প্রমাণ করেও থাকতে পারেন, তার পরেও লক্ষ লক্ষ লোকের রাতারাতি রাষ্ট্রহীন হওয়ার আশঙ্কা থাকছে পুরো মাত্রাতেই। অনেকে মনে করছেন আসামে কাদের আইনগতভাবে যাবতীয় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকার অধিকার আছে, তার একটা ‘এসপার-ওসপার’ করে দেবে এই জাতীয় নাগরিকপঞ্জী। অন্য এক দল পর্যবেক্ষকের অভিমত সংঘাতের অবসান তো দূরস্থান, লাখ লাখ রাষ্ট্রহীন নাগরিককে নিয়ে এক নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক ও কূটনৈতিক যুদ্ধের সূচনা করবে এই এনআরসি। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ঠিক কী কী ঘটতে পারে বা বিশ্লেষকরা কী ধরনের ঘটনাপ্রবাহের পূর্বাভাস করছেন, নিচে তা তুলে ধরা হলো।
অনলাইনে প্রকাশকরা বা সেবাকেন্দ্রে ঝুলিয়ে দেওয়া তালিকায় যাদের নাম থাকবে না, তাদের অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই বিদেশিদের জন্য বন্দী শিবিরে (ডিটেনশন সেন্টার) পুরে দেওয়া হবে কিংবা বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করা হবে, ব্যাপারটা তেমন নয়। আসাম সরকার জানাচ্ছে, নানা নথিপত্র পেশ করেও যারা নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারেননি, তাদের ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে’ আবেদন করার সুযোগ থাকবে। আসাম জুড়ে এই ধরনের প্রায় একশোটি ট্রাইব্যুনাল এর মধ্যেই কাজ করছে আগামী এক সপ্তাহের ভেতর চালু করা হবে আরও একশোটি। মাস কয়েকের ভেতর মোট হাজারখানেক ট্রাইব্যুনালে এই ‘চিহ্নিত’ বিদেশিদের আবেদনের শুনানি হবে। ট্রাইব্যুনালেও আবেদন ব্যর্থ হলে তাদের সুযোগ থাকবে উচ্চতর আদালতে অর্থাৎ হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার। রাজ্যের যে সব গরিব প্রান্তিক মানুষজন এতদিনেও ঠিকমতো কাগজপত্র দিতে পারেননি, বা প্রতি বছরের বন্যায় যাদের ঘরের সর্বস্ব ভেসে যায় তারা ট্রাইব্যুনালে বা হাইকোর্টে গিয়ে নতুন নথিপত্র পেশ করে এনআরসি-র রায় উল্টে দিতে পারবেন এমনটা কেউই আশা করছেন না বলা চলে। ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, শনিবারই মোটামুটি স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রহীনের তকমা লেগে যাচ্ছে আসামের লাখ লাখ মানুষের কপালে।