আশার আলো দেখাচ্ছে পরিচিত এসব ওষুধ

23

মারণ ভাইরাস করোনায় বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ২০ লাখ। মৃত্যু হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের। বিপর্যস্ত মানবজাতি এখন উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে একটা ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধকের। অপেক্ষায় আছেন কখন একটা সুখবর দেবেন বিজ্ঞানীরা। তবে আশার কথা, এই কয়েক মাসে বাড়ানো হয়েছে করোনা রোগীদের চিকিৎসার পরিকাঠামো। ফলে মৃত্যুর মিছিলে কিছুটা লাগাম পড়েছে। কভিড-১৯ রোগের নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য জানতে পারছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।
ফেব্রূয়ারি-মার্চ মাসে যখন করোনার সংক্রমণে রোগীরা কষ্টের শেষ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছিলেন, তখন বিশ্বের বড় বড় চিকিৎসক মারাত্মক শ্বাসকষ্ট কমানোর জন্য রোগীকে অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা করছিলেন। ছিল না কোনো ওষুধ। এখন তারা নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা করে রোগীদের কষ্ট কমানোর পাশাপাশি মৃত্যুহার কম করতেও সফল হয়েছেন।
টেক্সাস মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন কভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যাপারে ৬টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা জানিয়েছেন।
১. মার্চ-এপ্রিলে কভিড-১৯ ভাইরাসে রোগীর মারাত্মক শ্বাসকষ্ট ও কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছিল শ্বাসনালীসহ ফুসফুসের জটিল সংক্রমণকে। ওই সময় রোগীদের কষ্ট কমাতে ও প্রাণ বাঁচাতে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে শ্বাসনালী ও ফুসফুসে
সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসের সূ² রক্তনালীতে রক্তের জমাট অংশ বা ডেলা তৈরি করে। এর ফলে শরীরে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত চলাচল করতে পারে না।
২. শরীরে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়ায় শ্বাসকষ্ট বাড়ে। এই কারণে কভিড রোগীর শ্বাসকষ্ট কমাতে রক্ত পাতলা করার ওষুধ অ্যাসপিরিন ও হেপারিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ভারতের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী জানান, কভিড আক্রান্ত রোগীদের মাইক্রোভাস্কুলার ব্লাড ক্লট হচ্ছে। অর্থাৎ খুব সূক্ষসূক্ষ রক্তনালীতে রক্তের ডেলা আটকে যাওয়ায় রোগীদের মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হয়। ব্যাপারটাকে হার্টের ইস্কিমিয়ার সঙ্গে তুলনা করা চলে। রক্ত জমাট বাঁধা আটকাতে ব্লাড থিনার জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যাচ্ছে বলে জানালেন এই চিকিৎসক।
৩. কভিড-১৯ আক্রান্তদের প্রধান সমস্যা শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া। এই ভাইরাস শরীরে গেলেই যে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট শুরু হবে তা নয়, বললেন মেডিসিনের চিকিৎসক দীপঙ্কর সরকার। তবে হাইপারটেনশন, ফুসফুসের ক্রনিক অসুখ, ডায়াবেটিস বা হার্টের অসুখের মতো অসুখ থাকলে রোগীদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণত শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ ৯০ শতাংশের থেকে কমে গেলে শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে। তাই করোনা আক্রান্তের বিশেষ কোনো শারীরিক উপসর্গ না থাকলে রোগীকে বাড়িতে আলাদা রেখে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। তবে রোগীর অন্যান্য শারীরিক উপসর্গের উপর খেয়াল রাখতে হবে। পালস অক্সিমিটারের সাহায্যে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা মাপতে হবে। যদি অক্সিজেনের মাত্রা ৯৩ শতাংশ বা তার থেকে কম হয় তাহলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে ব্লাড থিনার ও দরকার হলে অক্সিজেন দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে।
৪. ওষুধ প্রসঙ্গে দীপঙ্কর সরকার জানালেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাসঘটিত অসুখে ওষুধের ব্যবহার সীমিত। কেননা ডেঙ্গু বা অন্যান্য ভাইরাস ঘটিত অসুখ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেলফ লিমিটিং। কিন্তু কভিড-১৯ যে শুধু চট করে সারে না তা নয়, মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। এই কারণেই ওষুধ নিয়ে সবাই চিন্তিত। কিছু কিছু ওষুধ যা ভাইরাসঘটিত অসুখের জন্য তৈরি করা হয়েছিল সেগুলোই করোনা রোগীদের উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে এগুলো যে করোনার জন্যই আবিষ্কার করা হয়েছে তা কিন্তু নয়। রেমডেসিভির ওষুধটি ইবোলার জন্য বানানো হয়েছিল আর ফ্ল্যাভিপিরাভির মূলত ইনফ্লুয়েঞ্জার ওষুধ। করোনার চিকিৎসায় এই দু’টি ওষুধ ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে।
৫. করোনা আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুর কারণ শুধুই যে কভিড-১৯ ভাইরাস তা কিন্তু নয়। অনেক সময় রোগীর শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সাইটোকাইন স্ট্রম তৈরি করায় রোগী মারা যান। এ ক্ষেত্রে স্টেরয়েড ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া যায়।
৬. কভিড-১৯ আক্রান্তের শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়া হলে ভেন্টিলেশন দেওয়ার সময় প্রন পোজিশন, অর্থাৎ রোগীকে উল্টো করে শুইয়ে চিকিৎসা করা হলে রোগী দ্রুত আরাম পান। তাই করোনার রোগীদের প্রন পজিশনে ভেন্টিলেশন দেওয়া উচিত। স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের ফুসফুসের কিছু অংশ কম কাজ করে, আমরা বলি ডিপেন্ডেন্ট পার্ট অব লাংস। যখন দাঁড়িয়ে থাকি, তখন ফুসফুসের নীচের অংশ এবং যখন সোজা হয়ে শুয়ে থাকি তখন ফুসফুসের পিঠের দিকের অংশে অপ্রয়োজনীয় জিনিস থিতিয়ে পড়ায় কর্মক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে কম থাকে। রোগীকে সোজা করে শুইয়ে ভেন্টিলেশন দিলে অক্সিজেন ও ওষুধ ফুসফুসের পেছনের অংশে পৌঁছায় না। উল্টো দিক করে শুইয়ে ভেন্টিলেশন দিলে রোগীর ফুসফুসের পেছনের অংশে ওষুধ ও অক্সিজেন পৌঁছে যায়। ফলে কষ্ট কমে ও রোগী দ্রুত সুস্থ হওয়ার দিকে এগিয়ে যান।
তবে কভিড-১৯ প্রতিরোধের দিকে বেশি জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন চিকিৎসকেরা। এই জন্য মানুষে মানুষে অন্তত ৬ ফুট দূরত্ব রক্ষা করার পাশাপাশি হাত সাবান দিয়ে ধোওয়া, নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরা, ভিড়ের জায়গা এড়িয়ে চলা ও অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে না যাওয়ার নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলতে পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। সূত্র আনন্দবাজার পত্রিকা