আল্ মাহমুদের সাহিত্যে নারী প্রসঙ্গ

572

একজন প্রুফ রিডার থেকে কবি হয়ে উঠা গল্পের নায়ক বাংলা সাহিত্যে একজনই। তিনি আর কেউ নন প্রিয়কবি আল মাহমুদ। পুরো নাম মীর আবদুস শাকুর আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯)। কবি হিসেবেই পরিচয় দিতেই যিনি গর্ব এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বি.বাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামের মোল্লা বাড়ির ছেলের বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কালের কবি হয়ে উঠা এক ব্যাপক বিস্ময়! নর-নারীর প্রেম-ভালবাসা, বিরহ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমাজ-সংসার, দেশকাল, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, ভাষা সংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ, সমাজতন্ত্র এবং শ্বাশত আদর্শ ইসলাম কোন বিষয়ই বাদ যায়নি তাঁর লেখনিতে। তিনি একাধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোট গল্পকার, সমাজ চিন্ত্যক, শিশু সাহিত্যিক, সম্পাদক এবং সাংবাদিক। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্ভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। শিরোনামে উল্লেখিত নারী বিষয়ক কথামালাই আলোচ্য নিবন্ধের মূল প্রয়াস। যেহেতু নারী তাঁর লেখার অন্যতম উপজীব্য বিষয়। তাঁর স্বগতোক্তি :“আমার কবিতায় বিস্তর নারী এসেছেন নানারূপে, নানা বিশ্বাসে, নানা ভাবনায়। আমার প্রেমের কবিতা যারা পড়েছেন তাদের আর নতুন করে এসব বলে দেওয়ার দরকার নেই।… …সেখানে যেসব নারীদের কথা আমি বলেছি সেগুলো কোনো কারণে এক নারী নয়। তারা তৈরি হয়েছে বিভিন্ন নারীর বিভিন্ন সময়ের ভাবনার অভিঘাতে।” লিখেছে অজ¯্র কবিতা। বের হয়েছে অনেকগুলো কাব্যগ্রন্থ, গল্প ও উপন্যাস।
নর-নারীর দৈহিক তথা মানবীয় প্রেম নিয়ে যেমন অজস্র লিখেছেন তেমনি শ্বাশত সত্যের জয়গানে নারীকে তিনি উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। তাঁর অমর কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’এ দেখি মানবীয় প্রেমের জয়গান। এই কাব্যগ্রন্থের ব্যাপ্তি এবং লেখনির দ্যুতিও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।
“সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়োনা হরিণী
যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ন কোনোকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ভালবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,
ছলনা জানিনা বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি
দেহ দিলে দেহ পাবে দেহের অধিক মূলধন
আমারতো নেই শখি, যেই পণ্যে অলংকার কিনি।”
আগেই বলা হয়েছে আল মাহমুদের কবিতার অন্যতম প্রধান অবলম্বন নারী। ছত্রে ছত্রে উঠে এসেছে নারীরা বহুরূপে। তিনি বলেন, “কোনো কোনো নারী আমাকে উদ্বাস্তু করেছে, কোনো নারী আমাকে ঘর দিয়েছে। কবিতা হয়ে উঠে বিমূর্ত নারীদের নিয়ে যে নারী একজন নয় শতেক নারী মিশ্রণ।”
“প্রেয়সী তোমাকে ছাড়া কবিতার আর মৌল বিষয় খুঁজি না।
এদা প্রকৃতি ছিলো, ছিলো দেশ, সময় সুদিন
জয়-রাজয়ে ক্ষুব্ধ আত্মার দুলুনি ছিলো বুকের ভেতরে
অবিশ্বাসী লাল চোখে নুনের ছিটার মতো মনে হতো যাকে
আজ সেই তুমি ছাড়া সৌন্দর্যের অন্য কোন তুলনা কী আছে?”
(প্রেয়সী তোমাকে, অদৃষ্টবাদীদের রান্না বান্না)
সৌন্দর্যবোধের কবি আল মাহমুদ নারীর বাহ্যিক গুণ লজ্জা এবং আভ্যন্তরীণ গুণ ও সহনশীলতা তাকে বেশ আকৃষ্ট করে। আর নারীর সেবাপরায়ণতা ও ভালোবাসাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অলংকার বলে মনে করেন। নারীদের ‘সংসার’ নামক ধর্মের তীব্র কায়ক্লেশের ভুয়সী প্রশংসার করেন তিনি। ‘নারী’ কবিতায় তিনি লিখেন,
“এ কোন সাহসে নারী
যাতনার এই সংসার দাও পাড়ি?
আকাশে ঝরার বিজুলির রেখা
বাতাসে তুহিন নামে
তুমি স্থির, তুমি উদ্যত থাকো বামে
আল্লাহর তরবারি।”
(নারী, বখতিয়ারের ঘোড়া)
প্রিয় নারী মায়ের জাতির সুরক্ষিত গর্ভে জন্মে ধন্য তিনি। মানব জনম সার্থকরূপে পরিগণিত হয় একজন রত্মগর্ভা মা পেলে। মা, জন্মদাত্রীর চেয়ে কে বড় আছেন ধরায় একমাত্র বিধাতা ছাড়া? সন্তান মানেই মায়ের এক একটি অঙ্গ দিয়ে গাঁথা এক অপরূপ শিল্পকর্ম। মায়ের গর্ভে ধারণ ব্যতীত মানুষ পৃথিবীতে আগমন অসম্ভব বৈকি!
“কারণ নারীর গর্ভে আমারও যে জন্ম হয়েছিল।
জন্মে পরেই মানুষের বাচ্চার মতোই
দারুণ চিৎকার করে কোন এক সেমেটিক
নারীর বুকের রক্তিম দুধের বোঁটা নাগালে মধ্যে পেয়ে যাই।”
(জীবনানন্দের প্রতি, আরব্য রজনীর রাজহাঁস)
ব্যক্তি বা কবি আল মাহমুদ নারী বিদ্বেষী নন। তারপরও “চেহারার চতুরঙ্গ” উপন্যাসে নারী মডেলদের নিয়ে একটু আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমাই ছিল। এ নিয়ে কিছুটা সমালোচনার মুখে পড়েন। কিন্তু তিনি বলেন, “আমি অবাস্তব কিছুু লিখিনি। সমাজে এ ধরনের ঘটনা চলমান। সবচেয়ে বড়কথা হচ্ছে নারীর প্রকৃত স্থান এবং মর্যাদা আমি উর্ধ্বে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম।” তিনি বারবার বলেন এবং স্বীকার করেন আসলেই তিনি একজন প্রেমিক কবি। যিনি সবসময়ই নারীর সংস্পর্শে ছিলেন। এজন্যে উচ্ছ্বাসবোধ করেন। কোন রাখঢাক নেই। নিখাদ সরল স্বীকারোক্তি,“আমার কাছে অনেক মেয়েই আসতো। হয়তো বা কবি বলেই আসতো। তাদের সাথে মেলামেলাও হয়েছে। সবটার যে খারাপ দিক আছে তা আমি মনে করি না। আমি নিজেকে অবশ্যই একজন ভালো মানুষ বলে দাবি করি। এই মেশামেশির নিয়ে অনেকের উপর কবিতা লিখেছি।”
সহধর্মিণীর প্রতি ভালবাসা সহজাত এবং স্বাভাবিক। তারপরও তিনি স্ত্রী সৈয়দা নাদিরা মাহমুদকে ভালোবাসার সাম্পান্নে ভাসিয়েছেন। তাঁর অনেকগুলো বই উৎসর্গ করেছেন সেই ভালোবাসার নারী সৈয়দা নাদিরা মাহমুদকে। এটা কেবল সহধর্মিনী হিসেবে নয়, সকল নারীর প্রতি নিখাদ ভালোবাসার নমুনাই দেখিয়েছেন। নারীর জন্যই পৃথিবীর সবকিছু। যুদ্ধ-সংঘাত, প্রেম-ভালবাসা, মহাকাব্য সব নারীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। তাকে প্রশ্ন করা মাত্রই প্রিয় নারীর তালিকাটি অর্ধাঙ্গিনী নাদিরার জন্যই বরাদ্দ রাখেন। নির্ধিদ্বায় বলেন, পৃথিবীতে স্ত্রৈণরাই পৃথিবীতে বেশি সুখি! বন্ধু বলেন, কল্যাণকামী বলেন, তাঁর স্ত্রীই তাঁর জন্যে সবকিছু।
তাঁর অনেকগুলো গল্প, উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থ নারীকেন্দ্রিক নামকরণ করে নারীপ্রীতিরই অন্যতম কারণ। কয়েকটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। নিশিন্দা নারী, আগুনের মেয়ে, ডাহুকী, কাবিলের বোন, দোয়েল ও দয়িতা, তোমার জন্য দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী, ময়ুরী মুখ ইত্যাদি। ব্যাপারটি সাদামাটা হলেও বেশ লক্ষণীয়। অন্যদিকে তার কবিতার নামকরণেও নারীবাচক ঢং বিদ্যমান। ‘অস্ত্রবতীর গান, রাত্রির গান, সম্মতির সংকেত, জিনিয়ার জন্য তিনটি কবিতা, জুলেখার আহব্বান, জোহরা তারার প্রতি, এক সুহাসিনী বোনের জন্য, মিতুর জন্য ছ’টি কবিতা, সমুদ্রের সতীন, চতুর্দশপদী, বিপাশার চোখ, কবিতার কথা, যাব না তোমার সাথে দেশজননী, নারী শতাব্দীতে নাদিরার জন্য, অমরতার আলেয়া, জাহরা ভাদুগড়ী, স্বপ্নের ভেতর দর্জি মেয়েটি, অপরাজিতার বনে প্রভৃতি কাব্যে নারীর প্রতি এক সূক্ষ টান দেখা যায়। এভাবে আরো অনেক উদাহরণ দেয়ার বোধ হয় দরকার পড়ে না!
তাঁর গল্প-উপন্যাসের নায়িকা বা নারীদের চমৎকার চরিত্র বর্ণনা করেছেন আপন ভঙ্গিমায়। আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’র শোভা চরিত্র, ‘ডাহুকী’ উপন্যাসের আতেকা, সুফিয়া, ফিরোজা, গিনি চরিত্র, কবি ও কোলাহল’র দিশা চরিত্র, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাসের নন্দিনী, হামিদা বানু, আরেক শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘কাবিলের বোন’র রোকসানা, মোমেনা এবং ‘নিশিন্দা নারী’ উপন্যাসের নিশিন্দা’রা বাংলাদেশের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠা এক একটি কিংবদন্তী নারীর সফল রূপায়ন! ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’র শোভা এবং অন্যান্য মেয়েদেরকে তিনি নারী বলতে নারাজ। তিনি তাদের বালিকা বলে হেসেই উড়িয়ে দেন! সীতাকুন্ডের অপরূপ দৃশ্য, কর্ণফুলী নদী, চট্টগ্রাম নগরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যবোধে তিনি স্কুলজীবনেই আলোড়িত হন। এক লায়লার কাহিনী কবিতায় লায়লা চোখ দু’টিকে তুলনা করেন বাড়বকুন্ডের জলাধারের সাথে।
“লায়লাকে কেউ সুন্দরী বলবে না। তবে তার
কেশ রাশি দেখে লায়লার নামটি সার্থক ভাবি
যেন সে খোঁপায় পেঁচিয়ে রেখেছে একহাজার রাত্রি।
সুরমা টানা চোখ দু’টি তার বাড়কুন্ডের রক্ষিত জলাধার”।
(এক লায়লার কাহিনী, মিথ্যেবাদী রাখাল)
আল মাহমুদ এবং নারী। তাঁর সাহিত্যের পরতে পরতে রয়েছে তার স্বাক্ষর। নদীর সাথে নারীর তুলনা করেছেন অহরহ। নদী ও নারীর মধ্যে অনেক মিল আছে। জীবন বৈচিত্র্য, ভাঙন, জোয়ার-ভাটা, রহস্য, ছলনা সবই আছে। তবুও নারী নারী-ই। যার কোন তুলনা চলে না কারো সাথে এই নিখিল প্রেমময় ভুবনে।
“তোমার তুলনা চলে বস্তু বিশ্বে নেই কোন প্রাণী।
আমার প্রেয়সী ছাড়া আর সবি দৃশ্যের ছলনা
প্রকৃতি সবুজগন্ধি বায়ু ছাড়া কী আছে বল না
আমার প্রেমকে দেখো, অন্য চোখে দেখা অরণ্যানী
তার দেহে নদী আছে, পাহাড়, পর্বত, আসমান
স্পর্শে জাগে রোমকুপ তালতৃষ্ণা সমুদ্রের গান।”
(তোমার জন্য দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী)
তথ্যসূত্র :
১। আল্ মাহমুদ : কবি ও কথাশিল্পী, কমরুদ্দিন আহমদ ২। পূবাকাশ-পোয়েটিকস্, চট্টগ্রাম
৩। কথোপকথন: আল মাহমুদ-ওমর বিশ্বাস সম্পাদিত
৪। আল মাহমুদ কাব্যসমগ্র-১ ও ২ : অনন্যা প্রকাশনী