আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই মুমিনের জীবনের লক্ষ্য

15

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম

দৈনন্দিন জীবনে আমরা কত কাজই করি। চলাফেরা থেকে শুরু করে চাকরিবাকরি, ব্যবসাবাণিজ্যসহ অনেক কাজ। পাশাপাশি ইবাদাত-বন্দেগী করি। আমাদের সব কাজ কি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য হয়ে থাকে? আমরা কি কখনো এ বিষয়টি চিন্তা করেছি? পবিত্র কুরআনের সুরা আন’আমে আল্লাহ পাক বলেন, ‘বল আমার নামাজ, আমার কোরবানী, আমার জীবন-মরণ সবকিছু হে আল্লাহ একমাত্র তোমারই জন্য।’ মুমিনের জীবনের লক্ষ্য কী হতে পারে তা পবিত্র কুরআনের এই আয়াতের দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায়। মুমিনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিষয়ে একই সুরার অন্য আয়াতে বলা হয়েছে ‘প্রকৃত মুমিনরা বলবে আমি, একনিষ্ঠভাবে তার দিকে মুখ ফেরাচ্ছি, যিনি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’
আমাদের সব ভালো কাজ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টিুর জন্য হয়ে থাকে তাহলে মনে কোন প্রকার দুঃখ থাকেনা, কষ্ট থাকেনা। কিন্তু তা যদি অন্যের সন্তুষ্টি কিংবা মানুষের বাহবা পাওয়ার জন্য হয়ে থাকে তবে তাতে যেমন খুশি করা সবসময় সম্ভব হয়না তেমনি মনে কষ্টও হয়। আর মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন কোন মুমিনের লক্ষ্য থাকাও ঠিক নয়। আমি আপনি যতই তোষামোদি কিংবা মানুষের সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিইনা কেন আল্লাহর কাছে তার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। বরং আল্লাহই আপনার ভালো কাজে সন্তুষ্ট হবেন। তিনিই ভালো কাজের পুরষ্কার দুনিয়া ও আখিরাতে দেবেন।
আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন প্রশংসা না করলে অখুশি হন কিংবা প্রচার না পেলে দুঃখ করেন। সেটা ঠিক নয়। হ্যাঁ, আমার একটা ভালো কাজ যদি প্রচারের কারণে অন্যরা উদ্বুদ্ধ হন তবে তাতে দোষের কিছু থাকেনা, কিন্তু কাজটি হওয়া উচিত আল্লাহকে খুশি করার জন্য। তিনি যদি খুশি হয়ে যান তাহলে আপনি সফল।
যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে তার জন্য আখেরাতের সফলতা অবধারিত হয়ে যায়। শুধু আখেরাতের সফলতাই শেষ নয় বরং যে মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্য নেয় তার সঙ্গে সঙ্গে তার আল্লাহর সন্তুষ্টি জাগতিক জীবনও কল্যাণ ও বরকতে ধন্য হয়। আল্লাহ তার চলার পথকে সহজ করে দেন। তার জন্য রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের অসন্তুষ্টির বিনিময়ে (হলেও) আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, আল্লাহ মানুষের দায়িত্ব নির্বাহে তার সাহায্যকারী হিসেবে যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর অসন্তুষ্টির বিনিময়ে মানুষের সন্তুষ্টি কামনা করে, আল্লাহ তাকে মানুষের ওপরই সোপর্দ করে দেন।’ (তিরমিজি শরিফ)
সুতরাং, মুমিনের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কোন বিকল্প নেই।
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে আমাদের নেক আমল করতে হবে। যে কাজে আল্লাহ পাক অসন্তুষ্ট হবেন সে ধরণের কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। মহানবি (সা:) এর নির্দেশিত পথ ও মতকে প্রাধান্য দিতে হবে আমাদের সব কাজে। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে জীবন গঠন করতে হবে। নিজের ধ্যানধারণার বশবর্তী না হয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা:) এর আদেশ, নিষেধকে মেনে চলে জীবনযাপন করতে পারলে ধন্য হবে আমাদের জীবন, খুশি হবেন আল্লাহ তায়ালা। দুনিয়া ও আখিরাতে পাবো সফলতা।
আল্লাহ সন্তুষ্টির জন্য আমাদের জিহবা, অন্তর, কাজ এবং অবস্থার মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে বললেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল! নিশ্চয়ই ইসলামের বিধিবিধানগুলো আমাদের উপর আধিক্যতা লাভ করেছে। তাই আমাদের এমন এক ব্যাপক বিষয় শিক্ষা দিন যা আমরা আঁকড়ে ধরব’। উত্তরে তিনি বললেন: ‘তোমার জিহবা যেন সর্বদা আল্লাহর স্মরণে ভিজা থাকে।’ ( সুনানে ইবন মাজাহ)। পাশাপাশি যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। আল্লাহর ভয় নিয়ে কাজ করতে পারলে সত্য ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব হবে।
আল্লাহর হুকুম এবং রাসুল (সা.)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী আমল করলে সে আমল আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে। দুনিয়ার যশ-খ্যাতি এবং কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়া, ভালো চাকরি করা, ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ দক্ষ হওয়া, এগুলোর কোনোটিই তার ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রমাণ নয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন তিনি জিব্রাঈল (আ.)-কে ডেকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন, কাজেই তুমিও তাকে ভালোবাসো। তখন জিব্রাঈল (আ.)-ও তাকে ভালোবাসেন এবং জিব্রাঈল (আ.) আকাশের অধিবাসীদের মধ্যে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ অমুক বান্দাহকে ভালোবাসেন। কাজেই তোমরা তাকে ভালোবাস। তখন আকাশের অধিবাসী তাকে ভালোবাসতে থাকে। অতঃপর পৃথিবীতেও তাকে সম্মানিত করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।’ (সহিহ বুখারি)।
একজন ইমানদারের সর্বশেষ ঠিকানা এবং চিরস্থায়ী সুখ ও শান্তির জায়গা হলো জান্নাত। জান্নাতের অধিবাসীদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ জান্নাতিদের ডেকে বলবেন, তোমরা কি সন্তুষ্ট হয়েছো?’ তারা জবাব দেবে, হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদের যে অপরিসীম নিয়ামতে ধন্য করেছেন, তাতে কী করে আমরা অসন্তুষ্ট থাকতে পারি! তখন আল্লাহ বলবেন, ‘আমি তোমাদের এর চেয়েও উত্তম নিয়ামত দেব। তা হলো, এখন থেকে আমি তোমাদের প্রতি চিরসন্তুষ্ট হয়ে গেলাম। আর কখনো অসন্তুষ্ট হব না।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।
আমরা যেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে সঠিক জীবনযাপনের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি সে তাওফীক তিনি আমাদের দিন। আমিন।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক