আল্লামা শফীর জানাজায় লাখো মানুষের ঢল

81

লাখো ভক্তকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন হেফাজতে ইসলামের আমির ও কওমি অঙ্গনের শীর্ষ আলেম আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী। ভক্ত-অনুসারীদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত আল্লামা শফী চিরঘুমে শায়িত হলেন।
গতকাল শনিবার দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে হাটহাজারী ডাক বাংলো চত্বরে তাঁর নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। তাঁর দীর্ঘদিনের প্রিয় কর্মস্থল হাটহাজারীর ‘বড় মাদ্রাসা’ হিসেবে পরিচিত আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলামের মাঠ প্রাঙ্গণে স্থান সংকুলন না হওয়ায় ডাক বাংলো চত্বরে জানাজা সম্পন্ন হয়।
এতে ইমামতি করেন আল্লামা শফীর বড় ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইউসূফ। এর আগে তিনি উপস্থিত লোকজনসহ দেশবাসীর কাছে তাঁর বাবার জন্য দোয়া চান। জানাজা শেষে ওসিয়ত অনুসারে তাঁর প্রিয় হাটহাজারী মাদ্রাসার পাশে বাইতুল আতিক জামে মসজিদ সংলগ্ন ‘মাকবাতুল জামিয়া’ কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
স্মরণকালের সবচেয়ে বড় এ জানাজায় আলেম, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তাসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে কয়েক লাখ ধর্মপ্রাণ জনতা অংশ নেন। এ সময় আল্লামা শফীর সহকর্মী, ছাত্র, ভক্ত ও অনুসারীসহ জানাজায় আসা সকলে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অবতারণা হয় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের। দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভক্ত-অনুরাগীরা ছিলেন শোকাহত।
জানাজা উপলক্ষে এলাকাজুড়ে ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা।নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৬ শতাধিক র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি ১০ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয় হাটহাজারী, পটিয়া, রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়িতে। এছাড়া ৪ উপজেলায় দায়িত্ব পালন করেন ৭ জন ম্যাজিস্ট্রেট।
হাটহাাজরীতে দায়িত্ব পালন করেন সহাকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শরীফ উল্লাহ, আবদুস সামাদ শিকদার, মামনুন আহমেদ অনীক, উমর ফারুক। এছাড়া সহাকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফখরুল ইসলাম রাঙ্গুনিয়ায়, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইনামুল হাছান পটিয়ায় এবং গালিব চৌধুরী ফটিকছড়িতে দায়িত্ব পালন করেন।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ফরিদাবাদ মাদ্রাসা থেকে রওনা হয়ে সকাল ৯টায় তাঁর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি হাটহাজারীতে এসে পৌঁছে। এরপর মাদ্রাসার অদূরে কেন্দ্রীয় ঈদাগাহ সংলগ্ন তাঁর বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ২৫ মিনিট অ্যাম্বুলেন্সটি অবস্থান করে। এ সময় আত্মীয়-স্বজনরা তাকে এক নজর দেখে নেন। তারপর তাকে নেওয়া হয় তাঁর প্রায় ৭৪ বছরের প্রিয় কর্মস্থল হাটহাজারী মাদ্রাসায়।
এ সময় ছাত্র, সহকর্মী, ভক্ত ও অনুসারীসহ উপস্থিত সকলে শেষবারের মত তাদের প্রিয় হুজুরকে দেখার জন্য উপচে পড়েন। ওই সময় মূল ফটক দিয়ে মাদ্রাসার ভিতরে ঢোকার সময় ভিড়ের চাপে পড়ে ৮-১০ জন আহত হন বলে জানা গেছে।
এদিকে জোহরের নামাজের আগে হেফাজতের মহাসচিব ও মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালক মাওলানা শেখ আহম্মদসহ মাদ্রাসার কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন।
আল্লামা বাবুনগরী বলেন, আমার শিক্ষক ও সকলের মুরব্বি আল্লামা শফী চলে যাওয়ায় আমাদের কওমি অঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তবে অচিরেই হুজুরের রেখে যাওয়া কর্মসূচিকে সামনে রেখে হেফাজত ও হাটহাজারী মাদ্রাসাকে আমরা সকলে এগিয়ে নিয়ে যাব। এজন্য আপানাদের সকলকে সহযোগিতা ও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
এদিকে প্রবীণ এ আলেমের মৃত্যুর খবরে গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে হাটহাজারী মাদ্রাসার সামনে সর্বস্তরের জনতা ভিড় করে। গভীর রাতে মরদেহ নিয়ে ঢাকা থেকে গাড়ি যাত্রা করে চট্টগ্রামের উদ্দেশে। রাত থেকেই চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলার দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন হাটহাজারীতে আসতে শুরু করে ‘বড় হুজুরকে’ একনজর দেখতে। ভোর থেকে বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাস-মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন যানবাহন নিয়েও হাটহাজারীতে লোকজন আসতে থাকেন। তবে সকালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড মোড় ও মেডিকেলের সামনে চেকপোস্ট বসিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। মাদ্রাসার আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। স্থানীয়রা তীব্র গরমের কারণে হাজার হাজার জনতাকে শরবত পান করান।
সিলেট থেকে এসেছেন মাওলানা মো. আবদুল গফুর। নিজেকে প্রাক্তন ছাত্র পরিচয় দিয়ে বলেন, হুজুরকে শেষবারের মতো একবার দেখতে এসেছি। দেরিতে আসলে দেখতে পাবো না। তাই সকাল সাড়ে ১০টার আগেই মাদ্রাসায় চলে এসেছি। তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। আমাদের কওমি অঙ্গনের অভিভাবক ছিলেন।
একইভাবে জানান আবু হুরাইরা। তিনি বলেন, আমি সরাসরি উনার ছাত্র ছিলাম না। এখান থেকে হেফজ বিভাগ থেকে পড়েছি। ২০০১ সালে মাদ্রাসা থেকে গিয়ে এখন অন্য একটি মাদ্রাসায় পড়াই। হুজুর মারা গেছেন শুনে সবকিছু বাদ দিয়ে চলে এসেছি, উনাকে এক নজর দেখবো তাই।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে আসা হাফেজ মাওলানা জয়নাল আবেদিন এক সময় পটিয়ার জিরি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। তিনি বলেন, আজীবন সত্য ও হকের পক্ষে ছিলেন শাহ আহমদ শফী। তিনি শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব সেরা আলেমদের একজন। জীবনের সবটুকু সময় তিনি দ্বীনের খেদমত করেছেন।
জানাজায় অংশগ্রহন করেন হাটহাজারী থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, গাজীপুরের মেয়র অ্যাড. জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক এমপি জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বদিউল আলম, চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার রশিদুল হক, র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মশিউর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মশিউদ্দৌলা রেজা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাটহাজারী সার্কেল আবদুল্লাহ আল মাসুম, হাটহাজারী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মাসুদ আলমসহ বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, আল্লামা শফীর জানাজা ও দাফনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলাসহ সার্বিক বিষয়ে সর্বোচ্চভাবেই সতর্ক ছিলাম। তাই কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই জানাজাসহ যাবতীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়েছে।
এদিকে হেফাজতে আমিরের উন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সাংসদ ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ সালাম, সাবেক মন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, হাটহাজারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম রাশেদুল আলম, মেজর জেনারেল (অব.) ইব্রাহীম বীর প্রতীক, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এসএম ফজলুল হক, হাটহাজারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী, সম্পাদক সোহরাব হোসেন নোমান, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মীর হেলাল, উত্তর জেলা বিএনপির আহŸায়ক কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম চৌধুরী, হাটহাজারী ইউপি চেয়ারম্যান সমিতির সভাপতি হাসানুজ্জামান বাচ্চু ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল আহছান লাভু। তারা মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার আসগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন আল্লামা শফী।