আল্লামা আবদুল মালেক নুরী (রহ.) স্মরণে

160


চাঁদের মাটিতে প্রথম মর্ত্যরে মানুষের পদার্পণকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল সভ্যতার এক বিশাল উত্তরণ হিসেবে। কিন্তু সেই চাঁদের ছায়াতেই লালিত হচ্ছে দরিদ্র বিশ্বের ক্ষুধা, হতাশা, জড়তা, শিক্ষাবঞ্চিত আর নিশ্চেষ্টতা। এ যেন সভ্যতারই নির্মম পরিহাস। কারণ সুকৌশলে এই বঞ্চিত দরিদ্র্যের শ্রম ও ঘামই ব্যবহার হয়েছে সভ্যতার বিনির্মাণে। সভ্যতার চাকার নিস্পেষন এবং সুবিধাভোগী শ্রেণীর অহমিকা নিঃসন্দেহে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে সভ্যতা-নির্মাতাদের। ইতিহাসের চোরা-গলিতে এই ব্যবস্থা পাকাপোক্ত থেকেছে বারে বারে, বলা হয়েছে, গরিবের এই নিয়তি। শিক্ষাহীন মানুষের এ নিয়ম থেকে বের হওয়ার কোন সুযোগই নেই। ইতিহাস পরিক্রমায় দেখা গেছে শিক্ষার আলো পৌঁছাতে পারলেই মানুষ অসাধ্যকে হাতের মুঠো নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষা নামের মহান আলোর দিশারীর নামেই- শিক্ষক। তিনিই মোমের ন্যায়ে নিজে জ্বলে- অন্যের উপকারে জীবনকে বিলিয়ে দেন। গড়ে তুলে আলোকিত ভূবন, সম্ভাবনার পৃথিবী। যে পৃথিবীতে গরিব-অশিক্ষা এ নিয়তি মেনে নিয়ে সভ্যতার আয়োজনে নিজের হিস্সার কথা প্রায় ভুলতেই বসেছে। সেখানেই আলোর পথযাত্রী মাওলানা আবদুল মালেক নুরীর যাত্রা। মাওলানা আবদুল মালেক নুরী হতাশা-দরিদ্রের জীবনমান নির্ণয়ে আলোর প্রদীপ হাতে গড়ে তুলেন দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চাঁদের আলোকে হার মানিয়ে গড়ে উঠে প্রতিদিন সোনার মানুষ। আলোর ভুবনে শিক্ষা নামের বিশাল কর্মকাÐে মাওলানা আবদুল মালেক নুরী হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন পুষ্পের সমাহারে। তাঁর সেই আলোভুবন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজ প্রতিষ্ঠিত হাজার হাজার ছাত্র, যারা দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করছেন দ্বীন, ধর্ম, শিক্ষা ও মানবতার জন্য। যেসব ক্ষণজন্মা মহান ব্যক্তিত্ব অসাধারণ মেধা, ধীশক্তি, জ্ঞান, প্রতিভা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে শিক্ষা ও দ্বীন-মাযহাবের প্রসার, সত্য প্রতিষ্ঠা, জনহিতকর কাজে নানাবিধ অবদান রাখেন এবং এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে ও সর্বস্তরের মানুষের কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে হযরতুলহাজ্ব আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল মালেক নুরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি অন্যতম। তাঁর মধ্যে বহু গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি ছিলেন শীর্ষস্থানীয় বরণীয় ব্যক্তিত্ব আর পরবর্তীদের জন্য অন্যতম আদর্শ। তাঁর বরকতপূর্ণ সান্নিধ্য ও জ্ঞানালোকে দীপ্ত হয়ে ধন্য হয়েছেন অগণিত শিক্ষার্থী ও সত্যসন্ধানী মানুষ। হাদিসে পাকের নুরানী ভাষায় তাঁর বিদায় ছিলো সত্যিকার অর্থে পুরো জাহানের মৃত্যুতুল্য।
আজীবন সংগ্রামী এ ব্যক্তিত্ব জীবনের সকল বাধাকে অতিক্রম করে নিজেকে একজন বরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছেন। আবদুল মালেক নুরী (রহঃ) ১৯৪৮ সালের দিকে মদিনাতুল আউলিয়া খ্যাত চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানাধীন পশ্চিম এলাহাবাদ গ্রামে সাধারণ এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালে তৎকালীন প্রবীণ শিক্ষাগুরু মাওলানা ইসহাকের (রহঃ) গভীর স্নেহে হাশিমপুর মকবুলিয়া ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করে দ্বীনি জ্ঞানার্জনের যে ধারা শুরু করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় ঐ মাদ্রাসা থেকে ১৯৬৫ সালে দাখিল এবং ১৯৬৭ সালে আলিম পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। তারপর ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল(তৎকালীন উলা) ও ১৯৭০ সালে একই মাদ্রাসা থেকে কামিল হাদীছ( তৎকালীন টাইটেল) সমাপ্ত করেন। কামিল অধ্যয়নকালে সে সময়ের যুগশ্রেষ্ঠ আলেম শায়খুল হাদীছ মাওলানা ফোরকান ছাহেব (রহঃ), মুফতি মাওলানা আমিন ছাহেব (রহঃ), মুহাদ্দিস ও শায়ের মাওলানা মতিউর রহমান নেজামী ছাহেব (রহঃ) ও আল্লামা ইসমাঈল আরকানী ছাহেব (রহঃ) প্রমুখ হুজুরদের একান্ত সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন।
৭১ সালে তিনি চন্দনাইশের তৎকালীন অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তাঁহার স্মৃতি বিজড়িত বিদ্যাপীঠ হাশিমপুর মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ মাওলানা ইছহাকের অনুরোধে শিক্ষক পদে চাকুরি নেওয়ার মধ্য দিয়ে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন। সুন্নিয়ত ভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে দিনের বেলায় কুরআান হাদিসের জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি রাত্রিবেলায় সুমধুর ও বলিষ্ঠ কন্ঠে ওয়াজ নসীহতের মাধ্যমে তিনি এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, শুধু ইসলামবিরোধী আক্বিদা নয়, মানবরচিত যাবতীয় মতবাদ পরিত্যাগ করে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমপর্ণের মধ্যেই মানবের ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন নাজাত নিহীত। সারাটা জীবন তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দ্বীন ইসলামের বাণী প্রচারে এবং রাসুল পাক সাল্লল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের পবিত্র আদর্শ বাস্তবায়নে ব্যয় করেছেন। পরবর্তীতে তিনি মাওলানা এম এ ছবুর সাহেবকে সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমান সময়ে সুন্নিয়তের মশাল প্রজ্বলনকারী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “পশ্চিম এলাহাবাদ আহমদিয়া সুন্নিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা”। ১৯৯৬ সালে নবগঠিত প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা উপাধ্যক্ষের ( নায়েব সাহেব) পদ গ্রহণ করে মাদ্রাসার সার্বিক উন্নয়নে তিনি নিরলস ত্যাগ স্বীকার করেছেন। নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানে কষ্টার্জিত টাকা থেকে শুরু করে এমনকি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে তিনি মাদ্রাসার কর্মরত শিক্ষকদের বেতন ভাতা যোগান দিয়েছেন। সামনে থেকে যেকোন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের সুনাম অক্ষুণœ রাখতে অতন্দ্র প্রহরীর মতো নেতৃত্ব দিয়েছেন।
মাওলানা আবদুল মালেক নুরী এত উঁচু মাপের একজন বরেণ্য আলেম হয়েও তিনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করেছেন। অহংবোধ বলতে হুজুরের চরিত্রে ছিলো না। মিষ্টিভাষী এ ব্যক্তিত্বের সাথে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সুসম্পর্ক ছিলো। এলাকার মাটি ও মানুষের প্রতি তাঁর এতটাই দরদ ছিলো যে তিনি তাদেরকে ছেড়ে নিজের পকেট ভারী করতে কোনখানে জান নি। এলাহাবাদ গ্রামে অবস্থিত সর্বপ্রাচীন মসজিদ হযরত কাজী আব্দুর রাজ্জাক (র.) জামে মসজিদে তিনি দীর্ঘ ৪৮ বছর বিনা পয়সায় খেতাবতের দায়িত্ব পালন করে এলাকার মুসল্লিদের আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দ.) এর প্রেমিক বানিয়ে একমাত্র নাজাতপ্রাপ্ত দল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারী বানিয়েছেন। মহান এই শিক্ষাব্রতী ও ধর্মীয় সাধক দীর্ঘদিন যাবত ক্যান্সার রোগে ভোগছিলেন। গত ১২ মার্চ ২০১৯ইং হাজার হাজার হুজুরের ভক্ত অনুরাগী ও ছাত্রদের শোকসাগরে ভাসিয়ে তিনি মহান খোদার দিদার লাভ করেন। আল্লাহ হুজুরকে জান্নাতের উঁচু স্থানের বাসিন্দা হিসেবে কবুল করুন। আমিন। ১২ মার্চ হুজুরের জানাজা হুজুরের প্রতিষ্ঠিত পশ্চিম এলাহাবাদ মাদরাসা মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। হুজুরের অন্যতম ছাত্র ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক অধ্যাপক আবু তালেব বেলালের পরিচালনায় সংক্ষিপ্ত জানাজাপূর্ব সভায় দেশবরেণ্য আলেম, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বক্তব্য রাখেন। হাজারো মসল্লির অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত জানাজার নামাজের আগে যারা স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁরা এ পশ্চিম এলাহাবাদ মাদরাসার একটি একাডেমিক ভবন হুজুরের নামে নামকরণের দাবি জানান। মহান আল্লাহ হুজুরের রেখে যাওয়া আদর্শের পথে চলার তৌফিক দান করুন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইতিহাস লেখক