আলো নিভিয়ে কালোরাতের শহীদদের স্মরণ

56

২৫ মার্চের ঐতিহাসিক গণহত্যা দিবসকে স্মরণ করে দেশব্যাপি প্রতীকী ব্ল্যাকআউট কর্মসূচি পালন করলেন দেশবাসী। সরকারি আদেশের অংশ হিসেবে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। গতকাল সোমবার রাত ৯ টা থেকে ৯ টা ১ মিনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বন্ধ রেখে এ ব্ল্যাকআউট কর্মসূচি পালন করা হয়।
রাজধানীতে ব্ল্যাকআউট কর্মসূচির প্রধান স্থান ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। আর চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসনসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এই কর্মসূচি পালন করে নগরীর ফয়’স লেকস্থ পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে। ঘড়ির কাঁটায় ৯ টা বাজতেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ল্যাম্পপোস্টের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। এসময় সবাই একাত্তরের গণহত্যার ভয়াল মুহূর্তকে স্মরণ করেন। ১ মিনিট পরই স্বাধীনতার ৪৮ বছর উপলক্ষে মশাল জ্বালানো হয়। পরে সবাই মোমবাতি হাতে আলোর মিছিল নিয়ে জগন্নাথ হল অভিমুখে রওনা দেন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রমুখ। এদিকে ঘড়ির কাঁটায় রাত ৯ টা বাজতেই নিভে যায় জগন্নাথ হলের সব লাইট। মাইকে ভেসে আসে গোলাগুলির শব্দ, আর বিপদগ্রস্ত মানুষের আর্তনাদ। সেই আবহে কিছুক্ষণের জন্য যেন ফুটে উঠেছিল ১৯৭১ সালের ভয়াবহ সেই রাতের চিত্র। এছাড়া রাজধানীর শাহবাগ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, পুরানা পল্টন এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী প্রতীকী ব্ল্যাকআউট কর্মসূচি পালন করা হয়।
ব্ল্যাকআউট সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফায়েদ মাহমুদ স্বার্থক বলেন, এর আগে কখনো আমি ব্ল্যাকআউটের স্বাক্ষী হইনি। এবারই প্রথম। অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেই বর্বরোচিত হামলায় সমগ্র বাঙালি জাতির পাশাপাশি পুরো বিশ্ববাসী হতবাক হয়েছিলো। মধ্যযুগীয় কায়দায় পাকবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, পিলখানা, ইপিআর সদর দফতর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো ঢাকা মহানগরীতে চালায় হত্যাযজ্ঞ ও অগ্নিসংযোগ। এই অন্ধকারে তারই যেন ভাব ফুটে উঠলো।
ব্ল্যাকআউট কর্মসূচি বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় বিশেষ ব্যবস্থা। জরুরি স্থাপনা ও চলমান যানবাহন ছাড়া সারাদেশে প্রতীকী ব্ল্যাকআউট কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করে তারা। এসময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ব্ল্যাকআউট নিয়ে তৎপর ছিলেন।
এর আগে গণহত্যা দিবস পালন উপলক্ষে ২৫ মার্চ রাত ৯ টা থেকে ৯ টা ১ মিনিট পর্যন্ত সারাদেশে প্রতীকী ব্ল্যাকআউট পালন করা হবে বলে জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি জানান, এই ব্ল্যাকআউটের সময় যানবাহন ও কেপিআইগুলো (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) এর আওতার বাইরে থাকবে। কর্মসূচি পালনের সময় সারাদেশে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জাতীয় সংসদের স্বীকৃতির পর একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের দিনটিকে ২০১৭ সালে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। খবর বাংলানিউজের
চট্টগ্রামে গণহত্যা দিবসে নানা আয়োজনে শহীদদের স্মরণ
এদিকে গণহত্যা দিবসে শহীদদের স্মরণে নানা আয়োজন হয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও। দিনব্যাপি কর্মসূচির মধ্যে ছিল ফয়’স লেক বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ, মোমবাতি প্রজ্বালন, ব্ল্যাকআউট, আলোচনা সভা, মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা ইত্যাদি।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন : ১৯৭১ সালের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ফয়’স লেকের বধ্যভূমিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন প্যানেল মেয়র চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী। এ সময় কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব, আবিদা আজাদ, চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা, সচিব আবু শাহেদ চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরে নগর ভবনের কেবি আবদুছ ছত্তার মিলনায়তনে দোয়া ও মিলাদ মাহ্ফিল অনুষ্ঠিত হয়। মিলাদ পরিচালনা করেন চসিকের মাদ্রাসা পরিদর্শক মাওলানা হারুনুর রশিদ। ব্ল্যাকআউট কর্মসূচির আওতায় নগরীর বিদ্যুৎ ঠিক রাত ৯ টায় বন্ধ হয়ে ৯ টা ১ মিনিটে ফিরে আসে। এই সময়ে চসিকের পক্ষ থেকে বর্বরতার শিকার শহীদদের সম্মান জানানো হয় মোমবাতি প্রজ্বালনের মাধ্যমে।
জেলা প্রশাসন : গণহত্যার উপর দুর্লভ আলোকচিত্র প্রদর্শনী, শহীদদের স্মরণে বিশেষ প্রার্থনা, গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা এবং মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ফয়’স লেকের বধ্যভূমিতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচি পালিত হয়। এসব কর্মসূচিতে অংশ নেন বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান, জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেনসহ জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) : গণহত্যা দিবসে শহীদের স্মরণে গতকাল সোমবার (২৫ মার্চ) রাত ৮ টায় দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের সামনে সড়কের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মোমবাতি প্রজ্বালন করেন পুলিশ সদস্যরা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সিএমপির কমিশনার মো. মাহাবুবুর রহমান।
উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন) কুসুম দেওয়ান, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) আমেনা বেগম, পুলিশের ডিসি (উত্তর) মিজানুর রহমান, ডিসি (সদর) শ্যামল কুমার নাথ, ডিসি (পশ্চিম) মেহেদী হাসান, ডিসি (দক্ষিণ) বিজয় বশাক।
চট্টগ্রাম একাডেমি : বিকেল ৪ টায় চট্টগ্রাম একাডেমির স্বাধীনতা উৎসব ও লেখক-পাঠক সম্মিলনে মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। একাডেমির পরিচালক প্রফেসর রীতা দত্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট শফিউল বশরকে সংবর্ধিত করা হয়। আলোচক ছিলেন কবি ওমর কায়সার, লেখক সেলিম সোলায়মান, প্রাবন্ধিক সাখাওয়াত হোসেন মজনু, উৎসব আহবায়ক ড. আনোয়ারা আলম, মহাসচিব নেছার আহমদ। সূচনা বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক অরুণ শীল। অনুভূতি ব্যক্ত করেন অ্যাড. শফিউল বশরের পক্ষে আবু সাইদ সরদার। সঞ্চালনা করেন বাচিকশিল্পী আয়েশা হক শিমু ও কবি মর্জিনা আখতার।
বোধন : বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রামের আয়োজনে ‘এখনো ঘাতক বিক্ষত করে সোনার বাংলাদেশ’ শীর্ষক পথ আয়োজন নগরের জামালখান সড়কে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ছিল প্রদীপ প্রজ্বালন, মুক্তিযুদ্ধের কবিতা আবৃত্তি ও কথামালা। কথমালায় অংশ নেন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নাজিমুদ্দীন শ্যামল, কবি কামরুল হাসান বাদল, কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন ও বোধনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইসমাঈল সোহেল।
এসময় বক্তারা বলেন, স্বাধীনতা লাভের এতো বছর পরেও এ দিনটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। তাই এই দিন ঘিরে কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের কাছে স্বীকৃতি দাবি করা হয়।
শেষে সঞ্জয় পালের নির্দেশনায় পরিবেশন করা হয় বৃন্দ আবৃত্তি ‘মিছিলের রাজপথ’। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা পরিবেশন করেন একক আবৃত্তি।